ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মীম মিজান

কল্পচিত্রের কবি

প্রকাশিত: ২১:১৬, ২৮ মে ২০২১

কল্পচিত্রের কবি

কবিতা এক নান্দনিক মাধ্যম। কী ব্যঞ্জনা না এ মাধ্যমের প্রত্যেক শব্দে শব্দে! শব্দের পরে শব্দ বসালেই কি কবিতা হয়? আবশ্যই না। শব্দ তো মূক। তাকে বাঙময়, ব্যঞ্জনা আর সুরলহরীর কারিশমায় অন্তর্ভুক্ত করার নামই কবিতা। আর যিনি এই ক্যারিশমাটিক ¯্রষ্টা কবি তার বৈশিষ্ট্য তাহলে কী রকম হবে? কী রকম রুচির পরিচয় দিতে হবে তাকে? তা নিশ্চয়ই জানা আছে পাঠকের। বাঙময় করানোর জন্য কী শৈল্পিকতার পরিচয় দিতে হয় কবিকে! শব্দ নিয়ে সাধনা করতে হয়। অতঃপর পায়রার মতো বাক বাকুম করে ওঠে শব্দমালা। ঝর্নার পানির ন্যায় স্বচ্ছতা নিয়ে কুলুকুলু বয়ে চলে গন্তব্যে। এরকম শব্দমালাকে বাক দিতেন, দিতেন এক মনোরম গতি আর শব্দের সমাহারে নির্মাণ করতেন এক কল্পচিত্র তিনিই আমাদের সদ্য প্রয়াত হাবীবুল্লাহ সিরাজী (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮-২৪ মে, ২০২১)। তাঁর জীবন কবিতার। কবিতায় যাপনের। কবিতার আন্দোলনের। সঙ্গে ইতিহাস ভ্রমণের। নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন বিশ্বের নানা সমৃদ্ধ নগর-সভ্যতা ভ্রমণে। আর নিজের শেকড়কে ধারণ করেছেন মর্মে। ফলে সে শেকড়ের উপস্থিতি তার কাব্যে জ্বলজ্বল করছে। কবি তো সময়ের সন্তান। তাঁর স্বসময় যেমন তাকে আলোড়িত করবে তেমনি অতীত তাঁকে প্রেরণা জোগাবে। সঙ্গে পূর্ববর্তী কবিগণও। তিনি যেমন সিরাজী তেমনি ফারসি সাহিত্যে প্রখ্যাত কয়েকজন কবি আছেন শিরাজি উপাধিতে। যেমন হাফেজ শিরাজি (১৩১০/১৩২৫-১৩৮৮/৮৯), শেখ সা’দি শিরাজি (১২১০-১২৯১/৯২) প্রমুখ। উপর্যুক্ত কবিগণ কাব্যের অনুষঙ্গ হিশেবে এসেছেন তাঁর কাব্যে। যেমন, স্পর্শ কিংবা ছোঁয়া শীর্ষক কবিতায় কবি লিখছেন : নাভিমূলে কাঁটা ফুটে আছে আণগুলের অগ্রভাগে পাখির প্রণয় গোলাপ কী বুলবুলি হাফিজ যদিও জানেন রুটি-মদ, ক’প্রস্ত সোনালি অক্ষর কার নেই অভিযোগ সিরাজের সঙ্গে মানে কবির বরাত।’ হ্যামলেট, ভেনিস, ট্রাফালগার স্কয়ার, পলাশী ইত্যাদি শব্দরাজি যখন তাঁর কবিতায় দেখি তখন বুঝি যে, তিনি ইতিহাসের ফলের নির্যাস তাঁর কাব্যে বুনছেন। ইতিহাস ও বিশ্ব তাঁর কাব্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠার পাশাপাশি জীবনের বোধ, গভীর সংবেদ, উপলব্ধি আর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সম্মিলন ঘটিয়েছেন নিজ কাব্যে। পারিপার্শ্বিক কত কিছুর সঙ্গে মানুষের জীবনের নানা বিষয়ে-প্রসঙ্গকে সম্পর্কিত করে আমাদের দেখার চোখকে করেছেন শাণিত। আমরা বিস্মিত হই সম্পর্কিত বিষয়াদির উদাহরণে। যেমন, তাঁর কবিতায় পৃথিবী, নীল আকাশের এক আশ্চর্য সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছেন সালাদ-এর দস্তরখানায় নানা উপাদানের সাথে। জীবনের যে বোধ আর উপলব্ধি তার ব্যতিক্রমী উপস্থাপনাও হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যকে করেছে শ্লাঘ্য। জীবন মানেই তা স্থায়ী নয়। একসময় চলে যেতে হবে অপারের কাছে। সব লেনদেন পড়ে থাকবে পৃথিবীতে। তিনি অন্বিষ্ট ছিলেন মানব জীবনের এই জীবন-মৃত্যুর রহস্যের সন্ধানে। আর তা উপলব্ধি করে পাঠককে জানাচ্ছেন যে, এ জীবন সায়াহ্ন আমাদের কাছে অন্ধ, মোহ-কামনার দ্বার উম্মোচন করবে। আমি-তুমি চলে যাবো। এখানেই আবার নব প্রজন্ম আসবে। হয়তো তারাও আমাদের মতো মেতে থাকবে। সে রহস্যের কথা লিখছেন এভাবে: খুলে দেয় অন্ধ সম্মোহন মেলে দেয় নগ্ন বিবেচনা ফের দগ্ধ ফের মাটি পুনরায় নবীন সূচনা। (ভয় ও মৃত্যু) এইযে রহস্যের সন্ধান তা শহুরে পাথুরে মানুষজন অতটা ভাবে না। অবিরাম ছুটে চলে সুখ, সম্মোহনের দিকে। কিন্তু, বিপরীত গ্রামীণ মানুষজন। তাদের সারা বছরের ঘরের ভাত থাকলে অতটা থাকে না টানাপোড়েন। জীবনকে, আধ্যাত্বিক বিষয়কে উপলব্ধি করতে তারা সচেষ্ট হন। এসব কাজে তাদেরকে গ্রামীণ আবহ দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেয়। আর গ্রামীণ আবহ মানুষকে কোমল করে। করে বন্ধুবৎসল। কবিও এসব আবহে নিজেকে তুলে ধরে চিরায়ত গ্রাম-বাংলাকে সবার কাছে আবেদনময়ী করে তুলেছেন। কবি মানুষ। তাই তাঁর ভিতরে মানবিক যে বিষয়াবলী আছে তা জাগ্রত ছিলো। সেগুলোর নানা প্রসঙ্গ নিয়েও কবি বাঙময় করেছেন গেঁথে দেয়া শব্দমালাকে। প্রিয়জনের কাছে অনেক না হলেও কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে। আবার সেই প্রিয়জনও আমার কাছে অনুরূপ দাবিদার। দাবি একটু প্রেমের। খানিক অভিসারের। একান্তে কাছে পাওয়ার বা শ্রান্তি লাঘবের কোন স্থানে পরম সঙ্গী হওয়ার। কিন্তু, যখন তার ব্যত্যয় ঘটে তখন স্পর্শকাতর কবিমন ব্যাকুল হয়ে কাতরায়। অশ্রু ঝরায়। লোনা পানির ধারা সাক্ষী হয়ে থাকে। কবির মান-অভিমানে জারিত কবিতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মাছরাঙ্গা, কৃষ্ণচূড়া আর মঞ্জুমালা নামক কবিতাটি। যেখানে তিনি লিখছেন : তোমাকে ভালোবাসবো ব’লে মাছরাঙ্গা ধ’রে রেখেছিলাম খাঁচায়, আশায় একটি কৃষ্ণচূড়া পুঁতেছিলাম টবে চুম্বনে ভরাবো ঠোঁট-ডানায় কী ডালে শক্তপোক্ত ঋতুবাস মঞ্জুমালা তুমি আর কিছুই নিলে না মাছরাঙ্গা উড়ে গেলো, খোলা তার রং কৃষ্ণচূড়া বনবাসী, আকাশ সমান গলা এরকম চল্লিশ বছর! কবির কবিতা পাঠ করলেই নিজেকে মনে হয় একজন পরিব্রাজক। নানা প্রান্তে, আবহে ঘুরে ঘুরে চোখকে শীতল করছি। কবি গ্রামীণ আবহের বর্ণনা দিয়েছেন, প্রেমের বর্ণনা দিয়েছেন মান-অভিমান জারিত রসের সাথে। ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনার সাথে মিথের ব্যবহার তাঁর কাব্যকে করেছেন হৃদয়গ্রাহী। সবথেকে হৃদয়গ্রাহী বিষয় যেটি, সেটি হচ্ছে ভাষার ক্ষেত্রে। কেননা, নেই দুর্বোধ্যতা, আছে সহজ-সরল শব্দের উপমা, উপলব্ধির বুনন। তিরিক্ষি হবে না মেজাজ। গতিশীলতায় টানবে কাব্যের শেষ পর্যন্ত।
×