ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাবুল আনোয়ার

বাংলাভাষা বনাম একুশের ভাষা

প্রকাশিত: ০০:২৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাভাষা বনাম একুশের ভাষা

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের চিরচেনা মৃত্তিকার প্রাণ মৃত্তিকার ঘ্রাণ, আমাদের কথামালা, আবেগ, অনুরাগ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের বাহন। বাংলা ভাষা হাজার বছরের। পদ্মা মেঘনার জলস্রোতের মতো নিরন্তরভাবে বহমান। এর প্রকাশ ও বিকাশ অনেক বাঁক পেরিয়ে এখন সমৃদ্ধির সোপানে। তবে বাংলা ভাষা বিকাশের পাশাপাশি সংস্কৃতি, শিল্প, সঙ্গীত নানাভাবে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম বাংলা ভাষার অবয়বে নতুন বিভা ছড়িয়েছে। আর এ কাজটি হয়েছে ১৯৫২ সালের পর থেকে অন্তত এদেশে। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অর্জন তা তা একুশের নিজস্ব এক ভাষা সৃষ্টি করেছে। এ ভাষা হলো একুশের একুশের চেতনা, একুশের মূল্যবোধ। একুশের একটি অন্তর্লীন অভিব্যক্তি ও তাৎপর্য রয়েছে। যাকে একুশের ভাষা বলা যায়। আমাদের যাপিত জীবন ঘিরে যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারা বহমান তাই একুশের ভাষা হয়েই প্রতিফলিত। একুশের ভাষার অচ্ছেদ্য বন্ধনে নানা মত, পথ, ধর্ম সবই একই সূত্রে গ্রথিত। মানবিকতার পরিশুদ্ধ চেতনায় পরিস্ফুটিত। এর বাইরে যে পরিচর্যা ও প্রতিপালনের চেষ্টা তা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছা বা অবচেতনায় হোক একুশের ভাষার বৈপরীত্য। এ প্রক্রিয়া যখন প্রসারিত হয়, প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্যে হোক একুশের ভাষা তখন বাকরুদ্ধতার বিবরে মুখ থুবড়ে পড়ে। তার বিরূপ প্রতিফলন ঘটে। একুশের আশা বা প্রত্যাশার বাস্তবায়নে সৃষ্টি হয় বাস্তব, মানসিক অস্বস্তি ও বিড়ম্বনা। একুশের ভাষার বিশ্লেষণে বলা যায় চিরায়ত বাঙালিত্বের ধারাকে ধারণ, বহমান ও অক্ষুণ্ন রাখা। আমাদের চিন্তা-চেতনার প্রশ্রয়ে তা সমুন্নত রাখা, তা পালন, লালন ও যুগের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করা। এ প্রক্রিয়ায় আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ থাকা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একুশের ভাষা বাস্তবে মূর্তমান হয়। বলা যায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। নববোধ ও মননের সংবেদে জ্বলে ওঠে বাংলা ভাষা। তার অভিব্যক্তি, অভিপ্রায়, স্বপ্ন ও স্বর এক অবিনশ্বর মহিমায় আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কি তাহলে এর আগে স্বমহিমায় বিকশিত হয়নি? এর উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই হয়েছে। তবে তার বিকাশ ঘটেছে ক্রমশ নানাভাবে অন্তর্মুখী অভিযাত্রায়। এ যাত্রাও সব সময় নির্বিঘ্ন ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে অন্ধত্ব, কুসংস্কার, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা কখনও কখনও বাধার সৃষ্টি করেছে। তবে তা সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক ও ধর্মীয় শোষণের সীমিত কলেবরে সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনীতি কলকব্জা নাড়িয়েছে দূর থেকে। তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয় নীরবে, অনেকটা অনানুষ্ঠানিক স্বতঃস্ফূর্ততায়। তবে গতি শ্লোথ হলেও তা ছিল নিরবচ্ছিন্ন ও নিবিড়। মানবিকবোধ, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার প্রগাঢ়তায় গভীর ও উজ্জ্বল। একুশের ভাষা তখন এভাবেই মূর্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের কথা, জীবনাচার, আনন্দ-বেদনায়। ১৯৫২ সালে একুশের ভাষা প্রথম জাতীয় আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে ঐক্যবদ্ধ চেতনায় বিস্ফোরিত হয়। ভাষার প্রকাশ ঘটে মানুষের চেতনাবোধে, জাগরণে, বাঁচা মরার আন্দোলনে। এর পর থেকে একুশের ভাষাগত চেতনা নাড়া দিয়ে ওঠে। ক্রমে তা সম্প্রসারিত হয় জাতীয়তাবোধের আন্তঃপ্রবাহ হিসেবে। বঙালী জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদের অন্তর্লীন জ্বালানি হিসেবে। শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে নয় এদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত একুশ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও সঙ্কটে আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখায়। একুশের ভাষা বিমূর্ত থেকে মূর্ততায় অজর হয়ে উঠেছে। একুশের ভাষা আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যাপক ও সুদূদরপ্রসারী গুরুত্বে বাঙালী চেতনার রঙে বর্ণাঢ্য হয়েছে। একুশের ভাষা আমাদের যাপিত জীবন, সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। ভাষা আন্দোলনের রক্তের বেগবান ধারায় বাঙালী জনগোষ্ঠীর মানসিক জাগরণ, বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধই একুশের ভাষা। হাজার বছর ধরে যে জীবন যাপন পদ্ধতি, যে সংস্কৃতি, আবহাওয়া, প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা তাকে কেন্দ্র করে নিয়ত পথ চলার স্বপ্নময়তাই একুশের ভাষা। সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস করা। বাংলা ভাষার উচ্চারিত কথা, শব্দমালা ও এর গ্রন্থিত রূপই একুশের ভাষার বাহ্যিক প্রকাশ। এর ব্যতায়, এর বিপরীতে যে অবস্থান, যে তৎপরতা তা একুশের ভাষার অন্তরায়। তা যেভাবেই আসুক না কেন, তার প্রতিবাদ, প্রতিরোধের যে প্রকাশ তার মধ্য দিয়েই একুশের ভাষা অভিব্যক্ত হয়। একুশের ভাষা একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ও পরিব্যাপ্তি লাভ করে। এ চেতনার স্ফুরণই একুশের ভাষার বড় অর্জন। জাতি সত্তার শেকড়কে তা উর্বর পলির সজীব আস্তরণে ঢেকে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একুশের অর্জন হিসেবে একুশের ভাষা পূর্ণ অবয়ব পায়। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি এনে দেয়। পাকিস্তানের জান্তা সরকার অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকার করে নেয় বা বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি সম্মান জানানো ও তাদের স্মৃতিকে ধারণ করে গড়ে ওঠে ‘শহীদ মিনার।’ এ শহীদ মিনার পরিণত হয় বাঙালী জনগোষ্ঠীর ঐক্য, সংহতি ও জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীকে। ফেব্রুয়ারির এ আন্দোলন বাংলা ভাষা, সাহিত্যের ক্ষেত্রে উন্মোচন করে সৃষ্টিশীলতা, জাগরণের এক নতুন দিগন্ত। শিল্প, সংস্কৃতির চিরায়ত ধারাকে নব চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ক্রমশ তা স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রেরণা শক্তি হিসেবেও কাজ করেছে। সকল স্তরের মানুষ সেদিনের আন্দোলন, সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন ভাষা ও দেশপ্রেমের টানে, অস্তিত্ব রক্ষার অন্তর্গত অতল তাগিদে। একুশের আন্দোলন এদেশের মানুষের মননে অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন চেতনার এক শক্ত ভিত তৈরি করে। একুশের ফেব্রুয়ারির এ অর্জন আন্তর্জাতিক মহলে বাঙালী জাতির পরিচয় ও প্রসারের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে। মাথা উঁচঁ করে দাঁড়াবার শক্তি জোগায়। নিজ ভাষা, সংস্কৃতির জন্য বিশ্বে প্রথম রক্তদানকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমীহ ও সম্মান লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। একুশের ভাষা এভাবেই প্রসারে ও বিভায় দীপ্তমান। তবে একুশের ভাষা আজ নানা কারণে আজ মাঝে মাঝে স্তিমিত হয়ে পড়ে। বিমর্ষতা আসে। তার মুক্ত চলাচলে বিরূপ আবহাওয়া ছায়া ফেলে। শহীদদের আত্মত্যাগ ও স্বপ্নের বাস্তবায়নে যখন সুদূরপরাহত বিষয়ে পরিণত হয় তখন। সে ছায়া এখনও অপসারিত হয়নি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে দীর্ঘসূত্রতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কোন কোন মহলের অনীহা। বিরূপ বাস্তবতার তিমিরে মহান একুশের ভাষা যেন পথ হারিয়ে ফেলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ, বিশ্বায়নের এ যুগে জাগতিক জীবনের পরিধি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে অনাকাক্সিক্ষত অনেক কিছু। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রসার, আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার নিজ সংস্কৃতির বলয়ে আঘাত করছে নিয়ত। বিশ্ব সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার জন্য, প্রতিযোগিতায় প্রত্যয়দীপ্ত অংশগ্রহণ, টিকে থাকার প্রশ্নে আমাদের অবশ্যই আধুনিকতার অরিহার্য অনুষঙ্গসমূহ গ্রহণ করতে হবে। অন্য ভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতির সৃজনশীল, মৌলিক বিষয়গুলো আহরণ, চর্চায় সচেষ্ট ও মনোযোগী হতে হবে। তবে আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতি, অপচর্চা হবে আত্মনিধনেরই নামান্তর। এ প্রবণতার প্রসার আজ আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেয়ালে ফাটল তৈরি করছে। মহান একুশের ভাষা ও অর্জন আজ এরূপ বিরূপ বাস্তবতার মুখোমুখি। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক ও বিছিন্নতাবাদী মনোভাবকে উস্কে দিচ্ছে। কখনও কখনও রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, ক্ষমতা মোহ, ক্ষমতার চর্চার বাড়াবাড়ি এসব কিছই একুশের ভাষা ও চেতনার বিরোধী। সামাজিক সংহতি, ঐক্য ও দেশপ্রেমের পরিপন্থী। এ থেকে উত্তরণে একুশের ভাষার, একুশের চেতনার জাগরণই হতে হবে অন্যতম প্রধান নিয়ামক শক্তি। জাতিসত্তার প্রেরণাদানকারী এ একুশের অর্জন, একুশের চেতনাকে ধারণ ও বাস্তবায়ন করেই একুশের ভাষায় কথা বলতে হবে। চর্চা করতে হবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্যে, সংস্কৃতির বিকাশ, প্রসার, উন্নয়নে একুশের ভাষায় হোক প্রধান বাহন ও লালনের শীর্ষ বিষয়।
×