ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ যুক্তরাষ্ট্র কি বদলাবে!

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ যুক্তরাষ্ট্র কি বদলাবে!

জো বাইডেন এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এর চাইতে বড় খবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদায়। আমেরিকার ইতিহাসে এমন জঘন্য পাগল উন্মাদ প্রেসিডেন্ট আর আসেনি। আর আসবেও না এমন ধারণা রাখাই উত্তম। আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট মানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই শ’ বছরের ইতিহাস। আমরা উপমহাদেশে দুই শ’ বছর ইংল্যান্ডের অধীনে ছিলাম। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়ী মুঘলেরা আসে আজ থেকে পাঁচ শ’ বছর আগে। আমেরিকা তখন ঘুমন্ত দেশ। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের কারণেই এই দেশকে দৃশ্যপটে দেখতে পাই। আর আটলান্টিকের পাড়ে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত এই দেশ সামনে চলে আসে একটাই নেগেটিভ ঘটনার কারণে। তাদের ছোড়া পারমাণবিক বোমায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া হিরোশিমা নাগাসাকি শহরের ভারে ক্লান্ত জাপান যেমন পরাজতি হয়েছিল, তেমনি বিশ্বে নতুন এক শক্তিধর দেশের আবির্ভাব ঘটে, যার নাম আমেরিকা। প্রথম দশদিনেই তিনি বেশকিছু নির্বাহী আদেশ জারির কাজ শুরু করেছেন। এগুলো হলো- প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে জারি করা নির্বাহী আদেশ, যার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। এই তালিকায় সবার ওপরে আছে দুটি বিষয়। এক-বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বাতিল। তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিরাপত্তা হুমকির কারণ দেখিয়ে প্রধানত যেসব মুসলিম দেশ থেকে আমেরিকায় ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন সেগুলো প্রত্যাহার। আর দ্বিতীয়টি হলো- প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আবার ফেরা। এখনও কাগজে-কলমে এটাই এক নম্বর দেশ বিশ্বে। শক্তি ও অর্থনীতির বিচারে কত নম্বরে তা তর্কের বিষয় হলেও আমেরিকা ধরে আছে শীর্ষ অবস্থান। বিশেষজ্ঞ মহল বিশেষত বিবিসির বিশ্লেষণে জানা যায়, বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্ব পাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মোকাবেলার মতো বিষয়গুলো। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের দিকে থাকবে তাঁর মূল নজর। বাইডেন ন্যাটো ও বিশ্ব জোটের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় বিশ্বাসী। ফিরে যেতে চান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়। অন্যদিকে, ট্রাম্প এ সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একা চলার নীতি নিয়েছিলেন। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তিকে পুনরুদ্ধার করতে চান। একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে মোটেও বিশ্বাস করতেন না ট্রাম্প। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেবেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যোগ দেবেন। ট্রাম্প যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনকে অর্থনীতির জন্য হুমকি মনে করতেন, সেখানে বাইডেন এটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তিনি দূষণ কমাতে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি পরিকল্পনা করেছেন। ইরান পরমাণু কর্মসূচী থেকে সরে এলে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন বাইডেন। ট্রাম্প ২০১৮ সালে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের এই চুক্তি থেকে সরে যান। তিনি বলেন, এই চুক্তি ইরানের হুমকির তুলনায় দুর্বল। ইরানে আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প। দেশটিকে অর্থনৈতিক চাপের মুখে রাখেন। বাইডেন বলছেন, অতিরিক্ত চাপের কারণে ইরানের পরমাণু চুক্তি ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ কথাও জানান, ইরান যদি চুক্তি কঠোরভাবে না মানে তাহলে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলবেন না। ইয়েমেনে চলা সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বন্ধ করবেন বাইডেন। এই যুদ্ধে অনেকে হতাহত হয়েছেন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থী দল ও কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন আইন প্রণেতা এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেয়ার পক্ষে নন। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের বেলায় কি হবে? আমরা এটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ট্রাম্পের পাগলা নীতি থেকে সরে আসতে চাইছেন বাইডেন। সে কারণে তাঁর সরকারে ভারতীয়দের জয়জয়াকার। একজন দুজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকানও আছেন। এই সংযুক্তি মঙ্গলজনক। একদিকে যেমন আমাদের দেশ ও সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে, আরেকদিকে আবার গড়ে উঠতে পারে সহিষ্ণু মত ও মূল্যবোধের রাজনীতি। একটা বিষয়ে আগাম বলে দিতে পারি, ইসরাইল বা আরও অনেক বিষয়ে আমেরিকার নীতির পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ যে লবিং বা যে শক্তি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ায় তাকে অবহেলা বা এড়িয়ে চলা শুধু বাইডেন কেন, যে কারও জন্য অসম্ভব। সে দৃষ্টিকোণে পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় আগের মতোই থাকবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কও দেখার বিষয়। ট্রাম্প ও মোদির বন্ধুত্ব যদি হিসেবে ধরা হয় তাহলে বাইডেন-ইমরান দোস্তি হবার কথা। সেটা উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য হবে অমঙ্গলের। ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের সঙ্গে দূরের সম্পর্ক আর ন্যায়নীতির সম্পর্ক বজায় না রাখলে বাইডেনের সরকার উপমহাদেশে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আমাদের দেশের সঙ্গে যেসব অমীমাংসিত বিষয় বিশেষ করে রফতানি বাণিজ্য পোশাক শিল্পে সহযোগিতা কর ট্যারিফ নিয়ে ঝুটঝামেলা, সেগুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা না করলে মুখে মুখে সম্পর্ক ভাল হলেও কাজে হবে না। জানি এই প্রত্যাশা বাতুলতা। তবু আমরা চাইব আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের নাক গলানো বন্ধ হোক। তারা তাদের অবস্থানে থেকে সম্পর্ক বজায় রাখুক। বাইডেনের হাতে অনেক কাজ। তিনি কিভাবে কি করবেন তার জবাব দেবে সময়। সারা দুনিয়ায় তাদের যে নম্র ও পজিটিভ আচরণ কাম্য সেটাই যেন পায় মানুষ। জর্জ বুশ থেকে ট্রাম্প সব সময় যেন আতঙ্ক আর উদ্বেগ বিশ্বের জন্য। বারাক ওবামার জন্য আমরা আকুল হলেও তিনি তেমন সার্থক ছিলেন না। তাঁর সময় আমেরিকার অর্থনীতি বিপাকে ছিল। উল্টো ট্রাম্প আমেরিকান অর্থনীতিকে সচল রেখেছিলেন। সবচেয়ে যেটা ভয়ের ট্রাম্প সুপ্ত শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এটা কি শুধু তাঁর দায়? বিশ্বের কোথাও মুসলিম, কোথাও হিন্দু, কোথাও ইহুদী জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিলে আমেরিকায় সাদাদের জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতেই পারে। আমরা নিজেদের কথা মনে রাখি বটে, তাদের সময় হৈচৈ বাধাই। কাজেই আমাদের দায়িত্ব যেন ভুলে না যাই। স্বাগত জো বাইডেন। তিনি কি পারবেন আমেরিকার ভাবমূর্তি বদলে দিতে? সিডনি ২৪/০১/২১ [email protected]
×