ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাস্তব-পরাবাস্তব স্মৃতি ’৭১

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

বাস্তব-পরাবাস্তব স্মৃতি ’৭১

৭মার্চের দুপুর, স্বাধীনতার কী মহান উচ্চারণ বঙ্গবন্ধুর! বজ্রকণ্ঠে তর্জনী ইশারায় কেঁপে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দান, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাঙালী গোষ্ঠী। থর থর করে কাঁপন ধরেছিল জনসমুদ্রে। ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল পলল সন্তান অমিত বেগের বজ্রবাণীতে। সে মুহূর্ত থেকে অবরুদ্ধ স্বদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধর্ষণ চলত ক্রমান্বয়ে। পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল বাঙালী জনগোষ্ঠী। প্রতিটি গ্রাম ও শহর। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার শত্রুদের রুখে দেয়ার কোটি কোটি প্রাণের প্রত্যয়। প্রতিজ্ঞায় দৃপ্ত হয়েছিল ধনুর্ভঙ্গ পণে। এদিকে চলতে থাকে অমানবিক ও নির্মম নির্যাতন। বাঙালী নারী-পুরুষের ওপর। অত্যাচার আর নিপীড়নে ও সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য, প্রায় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল জেনোসাইডাল ধর্ষণ ও গণহত্যা। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানী বাহিনী সমগ্র বাঙালী জনগণকে মৃত্যুর মুুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। প্রথমত মধ্য বয়সী যুবক-যুবতীদের হাতে মার্চের পূর্বে, প্রতিরোধের কোন অস্ত্র ছিল না। স্বদেশ নির্মাণে গর্জন ও লাঠি নিয়ে আস্ফালনই ছিল একান্তভাবে। এটাই ছিল প্রথম প্রহরে অস্ত্র! ভারতে আশ্রয়ী আগ্রহীরাই ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগদান করেন, বুক চিতিয়ে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে। অকাতরে অস্ত্রের মুখে বারুদে বুলেটে ক্ষত বিক্ষত হয়, প্রাণ হারায়। তখনও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা আশাহত হননি! প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অনির্বাণ শিখার মতো। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রেরণা ও উদ্দীপনাময় ছিল। এটি এমনই এক অলৌকক সম্মোহন মন্ত্র-বাণী; যার ভূমিকা ও অবদান যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পুষ্টি, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বদা প্রস্তুত রাখে বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার আবেগে বাঙালী তরুণ-তরুণী যোদ্ধা জীবন্ত ও অতন্দ্র ছিল। দেশমৃত্তিকার প্রেমে অনুপ্রাণিত এক বক্তা, সেদিন তাঁর মুখাপেক্ষী জনতাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত সাধনের আহ্বান চিরন্তন করেছিল। সেদিন তাঁর ডাক বাঙালীদের অন্তরে পৌঁছেছিল। ১৯৭১ এর যুদ্ধ হয়ে ওঠে জীবনযুদ্ধ। কেউই প্রত্যাশা হারায়নি যে, জীবনের ওপর এমন একটা দুর্দশা এবং বাঁচার মতো বাঁচতে হলে; এমনই দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করে মৃত্যুর পদযাত্রীর নিশ্চিত সম্ভাবনা মেনে নেয়াই উত্তম বুদ্ধি। মনে পড়ে, ফেলে আসা ’৭১-এর যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি। ২৪ মার্চের পরে শহরে থাকা মানেই বোকামিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। বিপজ্জনক ভেবে, মা-বাবার সঙ্গে অভুক্ত চট্টগ্রাম থেকে একবস্ত্রে হেঁটে সীতাকুণ্ডু পাহাড় অতিক্রম করে নানার গ্রামের বাড়ি মীরসরাই পৌঁছার যে ইচ্ছায়, আমরা হাতে জীবন নিয়ে এগুচ্ছিলাম এগোচ্ছিলাম। কোন যানবাহন ছিল না, রাস্তা একেবারে ফাঁকা। কিন্তু পলায়নপর হাজার হাজার লোক, সকলের লক্ষ্য একটাই- সীমান্ত। প্রায় দুরাত তিনদিন ধরে হেঁটে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যেতে, কী যে চরম দুর্ভোগ! অন্যদিকে শরীরে ক্লান্তি ও ক্ষুধা, বাধ্য হয়ে পথে এক জীর্ণ কুটিরে আমরা সামান্য আশ্রয় পেলাম। ক্লান্তি ক্ষুধা পুষিয়ে নেয়ার জন্য মাটিতে ঘুমিয়ে রাতদিন কাটাই। হঠাৎ মা আমাদের জাগিয়ে বললেন, ওঠ-ওঠ, পালাও-পালাও। অদূরে সারা গ্রাম জ্বলছে দাউ-দাউ আগুনে। রাজাকার আর মিলিটারি গ্রামে নেমেছে। ভয়ে চিৎকারের আগেই মা বললেন, এদের হাতে মরার চাইতে, দেশের জন্য যুদ্ধ করে মর। যাও পালাও। আমি পালিয়ে রামগড়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ঢুকি, দেখি রীতিমতো কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার প্রয়াত প্রণব ভট্ট। ট্রেনিং বিরতির পর তিনি কী ভেবে, আমাকে এক প্রতিম আত্মীয় বাসায় রেখে বললেন, তুই এখানে থাক! মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের যুদ্ধ, এ যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে, যতদিন আমরা বাঙালী স্বাধীন না হই ততদিন বুকের ভেতর যুদ্ধ চেতনায় সম্মুখপাণে বেঁচে থাকব। আমি তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম এমনও কি দেশপ্রেমিক হয় পৃথিবীতে? মাইজদী বাজার, নোয়াখালী থেকে
×