ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিএম মোস্তফা

স্মৃতির আয়নায় মহানায়ক

প্রকাশিত: ০০:০২, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

স্মৃতির আয়নায় মহানায়ক

অনেকটা অসময়েই পৃথিবী ছাড়লেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছেন ‘ফুটবল ঈশ্বর।’ গত বুধবার তিগ্রেতে নিজ বাসায় হার্ট এ্যাটাক হয় তার। হাসপাতালে নেয়ার পর আর ফিরতে পারেননি তিনি। যার ফলে মাত্র ৬০ বছরেই তাই অতীত হয়ে যান বিশ্ব ফুটবলের রোমাঞ্চ ছড়ানো এই নাম। একজন ম্যারাডোনার মৃত্যুতে ফুটবল জগত হারালো একজন মহানায়ককে। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে প্রায় একাই বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেবার মেক্সিকোতে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার দুনিয়া কাঁপানো দুই গোলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিতে ওঠে আর্জেন্টিনা। ৫১ মিনিটে করা প্রথম গোলটি ছিল লাফিয়ে উঠে করা হাতের পাঞ্চে। যা চোখ এড়িয়ে যায় রেফারি ও দুই লাইন্সম্যানের। না হলে ইচ্ছাকৃত হ্যান্ডবলের কারণে লালকার্ড পেতে পারতেন তিনি। সেই গোলই পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ম্যারাডোনার তুমুল আলোচিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল হিসেবে। সদ্যপ্রয়াত ফুটবল ঈশ্বরকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী শোক পালনের মধ্যেই ম্যারাডোনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য ফাঁস করেছেন সাবেক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি জিকো। তার দাবি, ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগেও হাত দিয়ে গোল করেছিলেন। জিকো বলেন, ম্যারাডোনার প্রথম ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল ছিল ইতালীয় লীগে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের দুই বছর আগে নেপোলির হয়ে উদিনিসের বিরুদ্ধে সেই গোল করেছিলেন তিনি। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৫ মিনিটে করা ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোল নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। আছে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। মাঝমাঠ থেকে কয়েকজনকে কাটিয়ে করা গোল পরবর্তীতে খেতাব পায় শতাব্দীর সেরা গোলের তকমা। ম্যারাডোনাকে দিয়ে এমন গোল করাতে পেরে সেই রেফারিও গর্বিত। তিউনিসিয়ার সেই রেফারি আলি বিন নাসের ম্যারাডোনার প্রয়াণের পর বললেন, ‘আমি যদি এ্যাডভান্টেজ না দিয়ে ফাউলের বাঁশি বাজাতাম তাহলে এই অসাধারণ গোলটা আর দেখা হতো না। এরকম কিছুর সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত।’ পরের বিশ্বকাপেও দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। তবে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ডোপ কেলেঙ্কারিতে মাঝপথে নিষিদ্ধ হয়ে ফিরতে হয় ম্যারাডোনাকে। খেলা ছাড়ার পর মাদকাসক্তির কারণে বারবার খবরে আসেন তিনি। নানান সময় নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে কাটাতে হয়েছে তাকে। ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচের ভূমিকায় ছিলেন মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখা এই ফুটবলার। লিওনেল মেসিদের নিয়ে সেবার আনতে পারেননি সাফল্য। তবে ফুটবলীয় কৌশলগত দক্ষতায় দুনিয়ার কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীর মনে তার আসন একেবারেই আলাদা। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে ১৬ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শুরু ম্যারাডোনার। ১৯৭৬ থেকে পাঁচ বছর খেলে ১৬৭ ম্যাচে করেছিলেন ১১৬ গোল। এরপর বোকা জুনিয়র্স, বার্সিলোনা, নেপোলি, সেভিয়া, নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে দেখিয়েছেন বাঁ পায়ের জাদু। কোচ হিসেবেও সফল এই কিংবদন্তি। কেননা ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুঃসময়ে। লিওনেল মেসিরা তখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে বাদ পড়ার কিনারে। ঠিক সেখান থেকেই ম্যারাডোনার জাদুর ছোঁয়ায় আর্জেন্টিনা পৌঁছে ২০১০ বিশ্বকাপে। এরপর জাতীয় দলের দায়িত্ব ছেড়ে সামলেছেন কয়েকটি ক্লাবের দায়িত্ব। সর্বশেষ আর্জেন্টাইন ক্লাব জিমনাসিয়ার কোচ ছিলেন ম্যারাডোনা। ৬০তম জন্মদিনে সর্বশেষ এসেছিলেন তার দল জিমনাসিয়ার ম্যাচ দেখতে। অসুস্থতার কারণে ৩০ মিনিট পরই ছাড়েন মাঠ। ম্যারাডোনার স্বপ্ন পুরুষ কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা বিশ্বজনীন বিপ্লবী বলে পরিচিত চে গুয়েভারা। মূলত তারই হাত ধরে ফিদেল কাস্ত্রোর অনুরাগী হন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই ম্যারাডোনা ছিলেন গুয়েভারার খাঁটি সৈনিক। সমাজতান্ত্রিক দর্শন থেকেই চে’র উল্কি হাতে এঁকেছিলেন ম্যারাডোনা। পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে গেছেন ম্যারাডোনা। বিপ্লবী বন্ধুদের সান্নিধ্য পেতে ছুটে গেছেন কিউবায়। ক্রমেই কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে অন্যরকম বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন ম্যারাডোনা। তাদের দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধন এতটাই দৃঢ় ছিল যে দেশের সীমানা পেরিয়ে সে বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছিল আত্মার বন্ধনের মতোই। ২০১৬ সালের ২৫ নবেম্বর ৯০ বছর বয়সে কিউবার রাজধানী হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুর সময় শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! চার বছর পর ঠিক একইদিন সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন আর্জেন্টাইন তারকা ম্যারাডোনাও। নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর দিনটিকেই নিজের বিদায়ের জন্য বেছে নিলেন বিশ্ব ফুটবলের বরপুত্র। বিশ্বকে কাঁদিয়ে ম্যারাডোনা অন্যলোকে পাড়ি জমানোর পর এখন উঠছে নানা বিতর্ক আর প্রশ্ন। প্রতিটিদিনই যেন তার মৃত্যু ঘিরে ধোঁয়াশা বাড়ছে। প্রথমে অভিযোগ উঠেছিল তাকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা নার্সরা দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেননি। এখন অভিযোগ উঠছে তার ব্যক্তিগত ডাক্তার লিওপোলদো লুকের বিরুদ্ধেই। ‘অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা’র অভিযোগ লুকের বিরুদ্ধে, যে কারণে এরইমধ্যে তার বাড়িঘর ও ক্লিনিক তল্লাশি করেছে পুলিশ। ম্যারাডোনার অস্ত্রোপচারের পর দেখভালে কোন অবহেলা ছিল কি না, সেটি খতিয়ে দেখছে। ম্যারাডোনার তিন মেয়ে দালমা, জিয়ান্নিনা ও ইয়ানা তাদের বাবাকে কি কি ওষুধ দেয়া হতো সে ব্যাপারে আরও তথ্য জানার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ৩০ জনের মতো পুলিশ কর্মকর্তা লুকের বাড়িতে তল্লাশি চালান, আরও ৩০ জনের মতো পুলিশ কর্মকর্তা তল্লাশি চালান বুয়েন্স এয়ার্সের ক্লিনিকে। ম্যারাডোনার শেষ দিনগুলো কিভাবে কেটেছে, তার চিকিৎসা ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না, সেটির একটি চিত্র বের করতে দায়িত্বরত সরকারী কৌঁসুলির নির্দেশে চলছে এই তল্লাশি। যদিওবা ডাক্তার লুক বলেছেন, ‘নিজেকে দোষারোপ করার কিছু কখনও খুঁজে পাইনি আমি। আমি দিয়েগোকে (ম্যারাডোনা) ভালবাসতাম। ডিয়েগোর জন্য আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকুই করেছি।’
×