ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালের অর্থনীতি (২)

রেমিটেন্সে প্রণোদনায় রিজার্ভে রেকর্ড

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ৫ নভেম্বর ২০২০

রেমিটেন্সে প্রণোদনায় রিজার্ভে রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ দেশে রেমিটেন্স পাঠালেই মিলছে ২-৩ শতাংশ প্রণোদনা। করোনা মহামারীতে এই প্রণোদনায় ভর করে চলতি অর্থবছরের ৪ মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দেড়গুণ বেশি। সর্বশেষ অক্টোবরে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ২১১ কোটি ২০ লাখ ডলার। মহামারীর প্রভাবে গত এপ্রিলে রেমিটেন্স কমলেও তারপর থেকে রেমিটেন্সে চলছে উর্ধগতির ধারা। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। মঙ্গলবার দিনশেষে রিজার্ভ ছিল ৪১.১৯ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরের মধ্যেই এই রিজার্ভ ৪২-৪৩ বিলিয়ন ডলারে যাবে। ২০২১ সালের মধ্যে তা ৫০ বিলিয়ন ডলারও ছাড়াবে বলে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী। জানা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা ১ কোটির বেশি বাংলাদেশীর পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। করোনা মহামারীর মধ্যেও রেমিটেন্স না কমায় ২ শতাংশ হারে প্রণোদনাকেও কারণ হিসেবে দেখছিল সরকার, তাই এই প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয় চলতি অর্থবছরের বাজেটে। অর্থাৎ বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও প্রবাসীরা ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ হয়ে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে রেমিটেন্স পাঠালে আরও এক শতাংশ বেশি প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ এ ব্যাংকে কেউ ১০০ টাকা রেমিটেন্স পাঠালে ব্যাংক তাকে দিচ্ছে ১০৩ টাকা। মূলত প্রণোদনায় ভর করে করোনা মহামারীর মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অক্টোবরে ২১১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)। একক মাস হিসেবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আহরণ। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে। ওই মাসে রেমিটেন্স এসেছে ২৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। চলতি বছরের অক্টোবরে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ কোটি ডলার বা ২৮ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। গত বছর অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিটেন্স এসেছে ৮৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় রেমিটেন্স এসেছিল ৬১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এদিকে ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সপ্রবাহ বেড়েছে এবং এ বছর প্রবাসী আয় আহরণে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে থাকবে বলে জানিয়েছে আস্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক। গত ২৯ অক্টোবর প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় সংস্থার ‘কোভিড-১৯ ক্রাইসিস থ্রু এ মাইগ্রেশন লেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, মহামারীর প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশে রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়তে থাকবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছর বাংলাদেশে রেমিটেন্সপ্রবাহ আরও ৮ শতাংশ বাড়বে। বাংলাদেশে চলতি বছর রেমিটেন্সপ্রবাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে বলা হয়, ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিটেন্সপ্রবাহের হার প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মূলত ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিটেন্সপ্রবাহ চলছে। বন্যার পর জুলাই মাসে বাংলাদেশে রেমিটেন্সপ্রবাহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে পাকিস্তানেও এ বছর রেমিটেন্সপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। চলতি বছর রেমিটেন্সপ্রবাহ ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দেশটির অবস্থান হবে ষষ্ঠ। ভারত মোট রেমিটেন্সপ্রবাহে প্রথম স্থানে থাকবে। গত বছরের চেয়ে এ বছর ভারতে রেমিটেন্সপ্রবাহ হ্রাস পেয়ে ৯ শতাংশে দাঁড়াবে। এদিকে মহামারীকালে গত চার মাসে দেশে ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এই মহামারীর মধ্যেও আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছেন। এতে আমরা সাহস পাচ্ছি। অর্থমন্ত্রী বলেন, রেমিটেন্স আরও বাড়বে। কারণ সরকার এ ক্ষেত্রে প্রণোদনার মাধ্যমে পাঠানোর খরচ দিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া রেমিটেন্স পাঠাতে যে ফরম পূরণ করতে হয়, তা সহজ করা হয়েছে। রেমিটেন্সের উচ্চহারে মহামারী মোকাবেলা করা দেশের জন্য সহজ হচ্ছে বলে জানান মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, এই রেমিটেন্সে দেশে লাখ লাখ পরিবার চলছে। ছোট ছোট ব্যবসা হচ্ছে। রেমিটেন্সে ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডিসেম্বরের মধ্যেই ৪২-৪৩ বিলিয়ন ডলারে যাবে। ২০২১ সালের মধ্যে তা ৫০ বিলিয়ন ডলারও ছাড়াবে বলে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী। মূলত দেশে প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স আসার কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একটার পর একটা রেকর্ড হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন মাসে ৭ বার রেকর্ড করেছে রিজার্ভ। বুধবার দিনশেষে রিজার্ভ ছিল ৪১.১৯ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান; যা পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
×