ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

জোন্স ছিলেন টাইগার ক্রিকেটের ভক্ত

প্রকাশিত: ০০:০১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

জোন্স ছিলেন টাইগার ক্রিকেটের ভক্ত

করোনার কারণে ভারতের জনপ্রিয় ঘরোয়া টি-২০ আসর আইপিএল এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে মরুর দেশ আরব আমিরাতে। কিন্তু মুম্বাইর ট্রাইডেন্ট হোটেল থেকে স্টার গ্রুপের একটি চ্যানেল ‘সিলেক্ট ডাগ আউট’ নামে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এই আয়োজনে ডিন জোন্সের সঙ্গে ছিলেন কেভিন পিটারসেন, ব্রায়ান লারা, স্কট স্টাইরিস, ব্রেট লির মতো তারকা। ২৪ সেপ্টেম্বর ম্যাচ শুরুর আগের শো’য়ে জোন্সের সঙ্গে বিশ্লেষকের চেয়ারে ছিলেন লি ও স্টাইরিস। কথা বলার মাঝেই হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েন জোন্স। সঙ্গে সঙ্গে লি তাকে ধরে ফেলেন। সাহায্যের জন্য বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন, এ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। এমনকি সিপিআর দেয়ার সময়েও পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু ফেরাতে পারেননি। ৫৯ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান। আইপিএলের মাঝে তার হঠাৎ মৃত্যু ক্রিকেট বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের ক্রিকটের বড় ভক্ত ছিলেন জোন্স। জীবদ্দশায় তার একাধিক মন্তব্যে সেটি ছিল পরিষ্কার। ঘটনা এক, ২০১৫ সালে ঢাকায় হালি আর্টিজানে সন্ত্রাসী ঘটনার পর বাংলাদেশ সফর বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া। জোন্স সেই সময় সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে লিখেছিলেন, ‘জঙ্গীদের ভয়ে নয়, পরাজয়ের ভয়ে বাংলাদেশ সফর বাতিল করছে অস্ট্রেলিয়া। উপমহাদেশে অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড এমনিতেই খুব খারাপ। বাংলাদশের ক্রিকেট এখন অনেক উন্নতি করেছে। ওরা কিন্তু এখন অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ক্ষমতা রাখে।’ ঘটনা দুই, ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ দল সেই সময় দারুণ ফর্মে। জোন্স অসিদের সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘টাইগারদের হারাতে হলে অস্ট্রেলিয়াকে সেরা খেলাটাই খেলতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে হালকাভাবে নিলে অস্ট্রেলিয়ার হার নিশ্চিত।’ প্রথমবারে মতো অসিদের হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল টাইগাররা। ঘটনা তিন, ২০১৭ চ্যম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ,‘৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ২৬৫ রান তাড়া করে জেতা সহজ নয়। সাকিবকে বন্দুকের মতো মনে হলো। তবে মাহমুদউল্লাহকেও কৃতিত্ব দিতে চাই।’ টুইট করেছিলেন জোন্স। উপরের তিনটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, ডিন জোনস ছিলেন টাইগার ক্রিকেটের শুভাকাক্সক্ষী। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন আগের জেয়ে অনেক উন্নতি করেছে। আর জোন্স সব সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে উৎসাহ জোগাতেন। তার হঠাৎ মৃত্যুতে বাংলাদেশের ক্রিকেট মহলেও নামে শোকের ছায়া। বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন একজন অভিভাবককে হারিয়েছে। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটি লাল রঙের জার্সি পরে মাত্র একটি ম্যাচ (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে) খেলেছিল। জোন্স সেই জার্সিকে বিশ্বকাপের সেরা বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমন একজন মানুষকে হারিয়ে বাংলাদেশেরও যে ভীষণ মন খারাপ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) জোন্সের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে। ১৯৮৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের এই সদস্য খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ধারাভাষ্যকার হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি-২০ আসরেও ধারাভাষ্য দিয়েছেন এবং ২০১২ সালে বিপিএলের প্রথম আসরে চিটাগং ভাইকিংস ফ্র্যাঞ্চাইজির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে একবার খেলেছিলেন ক্রিকেটার জোন্স। সেই ম্যাচে তিনি মাত্র ১৯ রানে সাজঘরে ফিরেছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর অফস্পিনে। ১৯৯০ সালের ৩০ এপ্রিল অস্ট্রেলেশিয়া কাপে শারজায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৯৮৪ সালে টেস্ট ও ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল জোন্সের। ১৯৯২ সালে শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন তিনি। ওয়ানডেতে জাতীয় দলের জার্সিতে শেষ খেলেন ১৯৯৪ সালে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৫২ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন জোন্স। তিনি ৩ হাজার ৬৫১ রান করেছিলেন। ছিলেন এ্যালান বোর্ডারের সাড়া জাগানো দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনার। টেস্টে ১১টি সেঞ্চুরি করেছেন। ওয়ানডেতেও দারুণ খেলেছেন, ১৬৪ ম্যাচ খেলে ৬ হাজার ৬৮ রান। ৭টি সেঞ্চুরি ও ৪৬টি হাফসেঞ্চুরি। পরিসংখ্যান দিয়ে জোন্সের গ্রেটনেস বোঝানো যায় না, বোঝা যায় শচীন টেন্ডুলকরের মন্তব্যে,‘আমার কাছে সবসময় মনে হতো ডিন জোন্স ছিলেন ভয়-ভীতিহীন। খালি ওয়ানডেই নয়, টেস্টেও তার বেশ কিছু অসাধারণ ইনিংস ছিল। তখন শুধু ওয়ানডে আর টেস্ট ক্রিকেটই ছিল কিন্তু তিনি ছিলেন ভীতিহীন আর দেহের ভাষা প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরিয়ে দিত। এই কারণেই তাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। জোন্সের বিপক্ষে খেলতে পারাটা সবসময়ই বিশেষ কিছু। রেকর্ড বলবে ৯০ দশকে সবচেয়ে শক্তিশালী দলটা ছিল তাদের এবং জোন্স ছিলেন সেই দলের অংশ।’ টুইট ভারতীয় গ্রেটের। জোন্স ও ভিভ রিচার্ডস একে অপরের বিপক্ষে অনেক খেলেছেন। সেখান থেকেই দুইজনের মধ্যে গড়ে উঠে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান তার টুইাটার এ্যাকাউন্টে লিখেছেন, সব সময় তার হৃদয়ে থাকবেন জোন্স, ‘ভয়ঙ্কর এক সংবাদ শুনে উঠলাম তুমি, আমার কাছে একজন ক্রিকেটারের চেয়েও বেশি কিছু। তুমি আমার বন্ধু, আমার ভাই। বিশ্বের যেখানেই ক্রিকেট খেলা হোক, সেখানেই তোমার হাসি ও উপস্থিতি মিস করব। শান্তিতে ঘুমাও ডিন। পৃথিবীর তোমার থেকে আরও কিছু পাওয়ার ছিল। সব সময় আমার হৃদয়ে থাকবে।’ ক্রিকেট ছাড়ার পর বিশ্লেষক হিসেবেই বেশি সময় পার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান এই কিংবদন্তি। তবে ২০১৬ সালে এসে কোচিং পেশায়ও নাম লিখিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের ফ্র্যাঞ্চাইজি ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের হয়ে কোচিং পেশায় যাত্রা করেন। দুই মৌসুমে এই দলটির দায়িত্বে ছিলেন জোন্স। ২০১৭ সালে আফগানিস্তান জাতীয় দলেরও দায়িত্ব পান এই অসি-কিংবদন্তি। ২০১৯ সালে করাচী কিংসের দায়িত্ব নেয়া ছিল জোন্সের সর্বশেষ কোচিং অভিজ্ঞতা। গত বছরই জোন্সকে স্থান দেয়া হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট হল অব ফেম-এ।
×