ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বল্প বসনা নারীদের জরিমানা করতে আইন করছে কম্বোডিয়া

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

স্বল্প বসনা নারীদের জরিমানা করতে আইন করছে কম্বোডিয়া

অনলাইন ডেস্ক ॥ কম্বোডিয়ায় ১৮ বছর বয়সী মলিকা টান যখন প্রথম জানতে পারলেন যে, নারীরা কী ধরনের পোশাক পরবেন এবং পরতে পারবেন না সে বিষয়ে সরকার একটি আইনের খসড়া তৈরি করছে, তখন তিনি এতোটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে তিনি একটি অনলাইন পিটিশন শুরু করে দিলেন। প্রস্তাবিত ওই আইনে কোন নারী শরীর দেখা যায় এরকম পোশাক পরলে তাকে জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনে নারীদের ‘খুব বেশি খাটো অথবা খুব বেশি খোলামেলা’ পোশাক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আইনটিতে পুরুষের খালি গায়ে থাকা নিষিদ্ধ করারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিলটি আনা হয়েছে। জানাজানি হওয়ার পর অবশ্য ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়েছে সরকারের এই উদ্যোগ। মলিকা মনে করেন, এ ধরনের একটি আইন করার উদ্যোগ নারীদের ওপর আক্রমণ। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ায় একজন তরুণী হিসেবে ঘরের বাইরে বের হলে আমি নিজেকে নিরাপদ বোধ করতে চাই, যে পোশাক পরতে আমার ভালো লাগবে আমি সেই কাপড় পরতে চাই। আমি আমার পরিহিত পোশাকের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চাই, এবং আমি চাই না সরকার এখানে কোন সীমা বেঁধে দিক।’ মালিকা আরও বলেন, ‘আমি মনে করি নারীদের খাটো স্কার্ট পরা বন্ধ করার জন্য আইন বাস্তবায়ন করা ছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার আরো অনেক উপায় আছে।’ মলিকা টানের ওই অনলাইন পিটিশন শুরু হয়েছে আগস্টে এবং এর মধ্যেই ২১ হাজারের বেশি মানুষ তাতে সই করেছেন। আরও অনেক নারী তার এই অবস্থানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিজেদের ছবি পোস্ট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, ‘এই জামা পরার জন্য কি আমার জরিমানা হবে?’ তারপর সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে সোশাল মিডিয়াতে #mybodymychoice এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে। মালিকা বলেন, ‘সব সময় আশা করা হয় আমরা যেন পুরুষের অনুগত দাস হয়ে থাকি এবং তাদের ইচ্ছে অনুসারে কাজ করি। তিনি মনে করেন বহু বছর ধরে প্রচলিত রীতি নীতি থেকে এসব আচরণ তৈরি হয়। সমাজ ধরেই নেয় যে নারীরা হবে নম্র এবং তারা কোন প্রতিবাদ করবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীরা খোলামেলা বা শরীর দেখা যায় এমন পোশাক পরলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, ‘যথাযথ’ পোশাক না পরলে গানের শিল্পী ও অভিনেত্রীদের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এপ্রিল মাসে একজন নারীকে পর্নোগ্রাফির অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে জামা কাপড় বিক্রি করার সময় তিনি শরীর দেখা যায় এরকম ‘অশোভন’ ও ‘উস্কানিমূলক’ পোশাক পরেছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী হুন সেন অনলাইনে নারীদের এ ধরনের লাইভ স্ট্রিমিংকে ‘আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, এসবের কারণে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। প্রস্তাবিত এই আইনটির প্রতিবাদে প্রচারণায় যোগ দেন ১৮-বছর বয়সী আরেকজন নারী আয়লান লিম। তিনি বলেছেন, কম্বোডিয়ায় সহিংসতার শিকার নারীকেই দোষারোপ করা হয়। এর ওপরেই তিনি জোর দিতে চান। তিনি বলেন, ‘এটি আইনে পরিণত হলে এই বিশ্বাসটাই জোরালো হবে যে যৌন অপরাধ করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে এবং মনে হতে পারে যে এটা তাদের কোন দোষ নয়। আমাকে সব সময় বলা হয়েছে আমাকে রাত আটটার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য, খুব বেশি শরীরে দেখাতেও না করা হয়েছে।’ প্রস্তাবিত আইনটিতে মূলত নারীর পোশাকের ব্যাপারে যেসব বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সে ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও, অনেকে বিলটির অন্যান্য বিষয় নিয়েও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। খসড়া আইনটিতে যারা ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ তাদের ‘জনসমক্ষে অবাধ’ হাঁটাচলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবও করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করতে বলা হয়েছে সব ধরনের ভিক্ষাবৃত্তিও। এ ছাড়াও কোন একটি জায়গায় জড়ো হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন কম্বোডিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের নির্বাহী পরিচালক চাক সোপিপ বলেছেন, বিলটি পাস হলে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, ‘এর ফলে দারিদ্র ও অসাম্য আরও বেড়ে যেতে পারে।’ সরকারের মন্ত্রীরা এবং জাতীয় পরিষদে বিলটি অনুমোদিত হলে এটি কার্যকর হবে আগামী বছর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওক কিমলেখ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, ‘এটি এখন খসড়া পর্যায়ে আছে।’ তবে মানবাধিকার আন্দোলনের একজন নেতা চাক সোপিপের আশঙ্কা হচ্ছে, জনগণের দিক থেকে চাপ দেয়া না হলে কোন ধরনের যাচাই বাছাই ছাড়াই হয়তো বিলটি পাস হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘কম্বোডিয়ায় প্রায়শই তাড়াহুড়ো করে আইন পাস হয়। সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে এ নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় না।’ তবে মলিকা টান আশাবাদী যে তার পিটিশনের ফলে লোকজনের মধ্যে এমন সচেতনতা তৈরি হবে যে শেষ পর্যন্ত সরকার প্রস্তাবিত আইনটি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×