ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট ২০০৪- ফিরে দেখা

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

২১ আগস্ট ২০০৪- ফিরে দেখা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিস (২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ) থেকে এক প্রতিবাদী মিছিল শুরু করতে চেয়েছিল। প্রতিবাদ ছিল তখনকার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে, বিশেষত সহিংস অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের ব্যর্থতার কারণে। দাবি ছিল সরকারের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের। মিছিল শুরু করার আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা দেয়ার কথাছিল। আশা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন। বিকেল ৩টা থেকে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে লোকজন জমায়েত হতে শুরু করেন। আমি পৌঁছি সাড়ে চারটার দিকে। প্রায় ৫০ হাজার লোক-আওয়ামী লীগ কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ-তখন কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ও চারদিকে। দেখলাম, রাইফেল ও কোমরে পিস্তল নিয়ে প্রায় ৫০ জন পুলিশ, পশ্চিম দিকে এভিনিউর প্রবেশ পথে দাঁড়ানো। তেমনি ৫০ জন এ্যাভিনিউর পূর্বদিকে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। সভা বা মিছিলে যোগদানকারী লোকজনের ওপর নজর রাখা বা প্রয়োজনে তাদের তল্লাশি করায় তাদের কোন মনোযোগ নেই। এ্যাভিনিউর ওপরে, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসের পূর্ব পাশে বাটার দোকানের দক্ষিণে একটি ট্রাক দাঁড় করানো ছিল। ট্রাকের ওপরে কয়েকটি মাইক্রোফোন সংযুক্ত একটি পোডিয়াম রাখা হয়েছিল। প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা সাধারণত যেমনটি করেন তেমনি আমি ওই সময়ের জন্য বানানো একটি অস্থায়ী সিঁড়ি বেয়ে পেছন দিয়ে ট্রাকটির ডেকে উঠে প্রেসিডিয়ামের অন্যান্য সদস্য জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, শেখ সেলিম, কাজী জাফরুল্লাহ্, সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, আওয়ামী আইন পরিষদ প্রধান এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এ্যাডভোকেট রহমত আলী, ত্রাণ ও কল্যাণ সচিব নাজমা রহমান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সঙ্গে দাঁড়াই। ট্রাকটিকে পূর্বমুখী করে দাঁড় করানো হয়েছিল। বিকেল ৫টার দিকে শেখ হাসিনা পশ্চিম দিক থেকে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেনজ জীপে চড়ে সভাস্থলে পৌঁছেন। তার জীপের সামনে একটি পাইলট পুলিশ প্রতিরক্ষণ পিকআপ ভ্যান আর পেছনে সে রকম দুটি ভ্যান ছিল। পেছনের প্রথম ভ্যানে ছিল তার প্রতিরক্ষণের জন্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সাদা পোশাকের এবং দ্বিতীয়টিতে ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। দুটি পিকআপ ভ্যানের মাঝখানে দুটি এসইউভিতে (জীপে) তার ব্যক্তিগত কর্মচারীরা এসেছিলেন। এসব কর্মচারী ও পুলিশের সহায়তায় জনতার ভিড় এড়িয়ে তিনি ট্রাকের ওপরে ওঠেন, জনতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার বক্তৃতা শুরু করেন। প্রায় ১৫ জন সাংবাদিক, টেলিভিশন কর্মী ও ফটোগ্রাফার ট্রাক-ডেকের বিভিন্ন অংশে ও নিচে দুই ধারে এবং ট্রাকের সামনের কেবিনের ওপরে অবস্থান নিয়ে সংবাদ আহরণের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ট্রাক-ডেকে অন্য নেতৃবৃন্দসহ আমি শেখ হাসিনার পেছনে ও পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি ট্রাক-ডেকের পেছনে পশ্চিমমুখী হয়ে বক্তৃতা করছিলেন। ট্রাকটি এ্যাভিনিউর মাঝখান থেকে প্রায় ৩ গজ উত্তরে, বাটার দোকান যে ইমারতে অবস্থিত তার কাছাকাছি, দক্ষিণ দিকের ইমারতগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে দাঁড়ানো ছিল। বক্তৃতারত শেখ হাসিনার বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম ও জিল্লুর রহমান। এই দু’জনের মাঝে এক পা পেছনে ছিলেন সাধারণ সম্পাক আবদুল জলিল। আবদুল জলিলের ঠিক পেছনেই ছিলাম আমি। আমার দু’পাশে ছিলেন য্গ্মু-সম্পাদক মুকুল বোস ও শেখ হাসিনার সহকারী হাজী নজীব। তার ডান দিকে ছিলেন যথাক্রমে প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও সাবেক মেয়র হানিফ। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও হানিফের এক পা সামনে ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। আমাদের সবাই পশ্চিমমুখী থাকায় সূর্যের আলো ও তাপ আমাদের চোখে ও শরীরে বেশ লাগছিল। পাঁচটা পনেরোর দিকে সূর্যের তাপে ও পেছনের লোকের চাপে শ্রান্ত হয়ে একজন পেছনের দিকে সড়ে আসলে শেখ হাসিনার ঠিক পেছনে আমি দাঁড়িয়ে যাই। এই সময় আমি নেত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার (অব) মামুনকে আমার বাঁ দিকে এক পা পেছনে দেখতে পাই। মিনিটখানেক পরে তার পাশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বাহাউদ্দীন নাছিম এসে দাঁড়ান। তারা দু’জনই এর পর জিল্লুর রহমানের সামনে শেখ হাসিনার পায়ের কাছে বসে পড়েন। সমাগমে লোক হয়েছিল অনেক-আমার হিসাবে ১ লাখেরও বেশি। পশ্চিমে পীর ইয়ামেনী মার্কেট থেকে নূর হোসেন চত্বর পেরিয়ে সচিবালয়ের পূর্ব পাশের সড়ক ছাড়িয়ে মুক্তাঙ্গন (বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আসার সময় আমি জনতার ঢল দেখেছিলাম), পূর্বদিক বঙ্গবন্ধু ও ভাসানী স্টেডিয়াম এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে দক্ষিণের দুই সড়কের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গোলাপ শাহ্ মাজার পর্যন্ত সমগ্র এলাকা ব্যানার হাতে স্লোগান মুখর জনতায় ভরে গিয়েছিল। জনতার ভিড়ে আমি মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান ও হাসিনা মমতাজকে (মহানগর মহিলা লীগ নেত্রী) শ’খানেক মহিলা কর্মীদের নিয়ে ট্রাক থেকে ১০ গজ দূরে উত্তর-পশ্চিমে কোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাদের পেছনে অন্যদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ নাসিম, আবদুল মতিন খসরু ও ওবায়দুল কাদের। তাদের দক্ষিণে প্রায় ৭ গজ দূরে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রেসিডেন্ট বাহাউদ্দীন নাছিম। বাহাউদ্দীন নাছিম পরে ট্রাকের ডেকের ওপরে আসেন এবং স্কোয়াড্রন লিডার (অব) মামুনের সঙ্গে বসেন। ভিড়ের মধ্যে আমি রফিক মোল্লাকে (আদা চাচা) দেখেছি। তিনি স্বভাব সুলভভাবে টিনের কৌটা থেকে সিদ্ধ ও শুকনো আদা বের করে যারা স্লোগান দিচ্ছিলেন কিংবা বক্তৃতা করেছেন তাদের মাঝে হেসে হেসে বিতরণ করছিলেন। শেখ হাসিনার জীপ, ট্রাক থেকে প্রায় ১৫ গজ দূরে রাখা হয়েছিল। জীপ থেকে যথাক্রমে প্রায় ২০ ও ৬০ গজ দূরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশদের নিয়ে ছিল পিকআপ ভ্যান দুটি। এই দুটির মাঝে ছিল ২টি এসইউভি। শেখ হাসিনার জীপের সামনে ও ট্রাকের পেছনে ছিল পাইলট পিকআপ ভ্যান। এসব গাড়ি জনতা ঘিরে রেখেছে। গাড়িগুলোকে একটি অনুকল্পিত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রেখে জনতাকে তার বাইরে সরিয়ে নেয়ার কোন চেষ্টা পুলিশ এ সময় করেছে বলে চোখে পড়েনি। খালেদা জিয়ার শাসনামলে পুলিশ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সভাসমাবেশ করার জন্য আওয়ামী লীগকে কোন মঞ্চ বা প্লাটফর্ম তৈরি করতে দিত না। এ জন্য এ স্থানে সভা সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেয়ার জন্য এভাবে ট্রাক-ডেক ব্যবহার করা হতো। দুই দিকে ইমারত ঘেরা স্থানে ট্রাক-ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়ানক বিপদসঙ্কুল, চোরাগোপ্তা গুলি সহজেই আঘাত হানতে পারে। সাধারণত এ স্থানে শেখ হাসিনার সভা অনুষ্ঠানের দিনে ও সময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস ইমারত ছাড়া দু’পাশের ইমারতের ছাদে সশস্ত্র পুলিশ নিয়োজিত থাকে। তারা সম্ভাব্য চোরাগোপ্তা গুলি কিংবা বোমা বা পটকা ছোড়ার প্রতিকূলে পাহারা দেয়। ওই দিন আমি এসব ইমারতের ছাদে পাহারায় নিযুক্ত কোন পুলিশ দেখিনি। বিশেষত ট্রাক-ডেক থেকে ২০ গজ দক্ষিণ-পূর্বের সিটি হোটেল ইমারত ও দশ গজ উত্তর-পূর্ব দিকে রাজ্জাকস নামে নিচ তলায় দোকান সংবলিত ইমারতের ছাদের ওপরে সশস্ত্র বা টেলিসকোপিক বা ভিডিও ক্যামেরা সজ্জিত কোন পুলিশকে সমাগমের সময় দেখা যায়নি। সাধারণত এরূপ সমাবেশের সময়ে এসব ইমারতের ছাদে পাহারায় নিয়োজিত পুলিশদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীদেরও সতর্কতামূলকভাবে মোতায়েন করা হত। ঘটনার পরে সন্ধ্যার সময়ে জানতে পেরেছি যে, ওইদিন পুলিশ আমাদের কর্মীদের এ দুটি ইমারতে প্রবেশ করতে বা তাদেরসহ ওপর তলায় বা ছাদে যেতে দেয়নি। শেখ হাসিনা যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন ট্রাক-ডেকের দু’পাশে, প্রায় ১০ গজ দূরে জনতার মাঝে ৬-৭ জন পুলিশকে মিশে থাকতে দেখেছি। এই জায়গায় আগে এই ধরনের সমাবেশে যত সংখ্যক পুলিশ নিয়োজিত থাকত, তার তুলনায় সংখ্যা ছিল অনেক কম। লোকজনকে ট্রাক বা শেখ হাসিনা থেকে একটি অনুকল্পিত নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে রাখা, যা রুটিন নিরাপত্তা রক্ষণমূলক কাজ হিসেবে আগে পুলিশ করত, তা এদিন এ সময়ে তারা করেছে বলে চোখে পড়েনি। বিকেল পাঁচটা পঁচিশের দিকে শেখ হাসিনা যখন জয়বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু বলে তার বক্তৃতা শেষ করে ট্রাক-ডেক থেকে নেমে যাচ্ছিলেন, তখন ২ জন দেরিতে আসা ফটোসাংবাদিক তাকে ফিরে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে ফের দাঁড়াতে অনুরোধ করে। শেখ হাসিনা তাদের অনুরোধ মতো মাইক্রোফোনের সামনে ২ মিনিট দাঁড়িয়ে তাদের ফটো তোলার সুযোগ দিয়ে ট্রাক-ডেকের দক্ষিণ-পশ্চিমের কোন দিয়ে নেমে যাচ্ছিলেন। তখন আমি একটি ফ্লাসের ঝলকানি দেখে ও বিস্ফোরণের শব্দ গুনে চমকে উঠলাম। শব্দ শুনে মনে হলো, দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে লোকজনের ওপর দিয়ে একটি বোমা ট্রাকের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপরে পড়েছে। আমাদের পেছনে কে যেন চিৎকার করে বললেন, এ যে গ্রেনেড! ট্রাক-ডেকের ওপরে আমরা চমকে উঠলাম, কিন্তু বিমূঢ় হলাম না। একে শেখ হাসিনার ওপর বোমা বা গ্রেনেড হামলা ধরে নিয়ে আমরা তখনই তার চার পাশে মানব-দেয়াল গড়ে তুললাম। এরপর আবার আরও একটি ফ্লাস আমার চোখ ধাঁধিয়ে ট্রাকটি পার হয়ে উত্তর-পশ্চিমে ট্রাক থেকে প্রায় ৩ গজ দূরে গিয়ে পড়ল। দেখলাম আইভি রহমানের দেহ রাস্তা থেকে প্রায় ৪ ফুট ওপরে উঠে নিচে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে (সাবেক) মেয়র হানিফ চিৎকার করে শেখ হাসিনাকে বসে পড়তে বললেন। তিনি বসে পড়লেন, কিন্তু মাথা উঁচু করেই রইলেন। স্কোয়াড্রন লিডার (অব) মামুন তার বাঁ হাত টেনে তাকে শুয়ে পড়তে ইশারা করলেন। তিনি ডেকের ওপর লম্বালম্বি করে তার দু’হাত বিছিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করেই পশ্চিম দিকে ঝুঁকে গেলেন। আমরা সবাই ঝুঁকে ও হাঁটু আধা গেড়ে তার ওপর এবং চারদিকে মানব দেয়াল দৃঢ়তর করলাম। এভাবে ঝুঁকে যাওয়ার সময় আমি বাঁ হাতে প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানকে টেনে ট্রাক-ডেকে শুইয়ে দিলাম। যদ্দুর মনে পরে দ্বিতীয় ব্লাস্টের পর ৫ থকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে আরও পাঁচটি ব্লাস্ট হয়েছিল। মনে পড়ে ৭ম ব্লাস্টর পর গ্রেনেড বা বোমা হামলায় যেন খানিক বিরতি এলো। দেখলাম শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ জীপটি ধীরে ধীরে ট্রাকটির দিকে, ডান দিকে সামান্য ঘুরে তিনি উঠলেই যাতে ট্রাকটি বাইপাস করে তা যেতে পারে সেজন্য এগোচ্ছে। আমরা ভাবলাম তাকে জীপের দিকে নিয়ে গিয়ে জীপে ওঠাতে পারলে তিনি নিরাপদ হবেন। হামলা শেষ হয়েছে ভেবে সহযোগীরা প্রায় হামাগুঁড়ি দিয়ে তাকে ট্রাক থেকে নামার অস্থায়ী সিঁড়ি ধরে নামিয়ে জীপের সামনের বাঁ দিকের সিটের দিকে নিয়ে গেলেন। স্কোয়াড্রন লিডার (অব) মামুন সিঁড়ির ওপর থেকে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে তাকে প্রতিরক্ষণ দিয়েছেন, সহকারী হাজী নজীব ও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মেজর (অব) শোয়েব নিচে দাঁড়িয়ে তাকে নামতে সাহায্য করেন। এরূপ প্রতিরক্ষণ ও সহায়তা নিয়ে তিনি মাথা উঁচু করে ট্রাক থেকে নেমে তার জীপে উঠলেন। তার জীপে ওঠা এবং তার জীপের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে জনতার ভিড় ভেদ করে তার দিকে বন্দুক/পিস্তলের গুলি আসার আওয়াজ শুনলাম। গুলিগুলো জীপের উইন্ডশীন্ডে, দরজার গ্লাস প্যানে ও দু’পাশের স্টিল-বেড়ায় লাগছিল। মনে হলো পূর্ব দিকের দু’পাশ ও ট্রাকটির উত্তর-দক্ষিণ দিক এবং এ্যাভিনিউর দক্ষিণ দিয়ে পেট্রোল পাম্পের দিকের রাস্তা থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলিগুলো ছোড়া হচ্ছিল। জীপের বুলেটপ্রুফ উইন্ডশীলন্ড ও জানালার গ্লাসপ্যানে শেখ হাসিনাকে এসব ব্লাস্ট ও বুলেট থেকে রক্ষা করেছিল। জীপের বাঁ পাশের দরজা শেখ হাসিনার জন্য খুলে তাকে তুলে দিয়ে দেহরক্ষী মাহবুব (অবসর প্রাপ্ত ল্যান্স নায়েক) জীপের পেছনে গিয়ে উঠতে চাচ্ছিলেন। এই সময় আমি আরেকটি ফ্লাসের ঝিলিক দেখি ও ব্লাস্টের আওয়াজ শুনতে পাই। মনে হলো এই সময় একটি গ্রেনেড জীপটির প্রায় ৩ ফুট উত্তরে গিয়ে পড়েছে। গ্রেনেডের স্পিøন্টার এবং সম্ভবত পিস্তল বা রিভলবার থেকে বেরিয়ে আসা একটি বা দুটি গুলি মাহবুবকে আঘাত করে। তিনি সেখানে বীরের মৃত্যু বরণ করেন। গ্রেনেডের স্পিøন্টার জীপটির গায়েও লেগেছে মনে হলো। অন্যদের মধ্যে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও মেজর (অব) শোয়েব জীপটির পেছনের বাঁদিকে উঠে দাঁড়ান। জীপটি ডানদিকে একটু ঘুরে সামনে পূর্ব দিকে ধীরে ধীরে রাস্তায় ছড়ানো লাশগুলো এড়িয়ে দলের কর্মীদের দিয়ে সৃষ্ট পথ ধরে চলে যায়। নেত্রীর প্রতিরক্ষণের জন্য সরকার প্রদত্ত পুলিশ ভ্যানটি এই সময় কোথায়ও দেখা যায়নি। পরে জেনেছি প্রথম ব্লাস্টের পর পরই ভ্যান ও ভ্যানে নিয়োজিত পুলিশ রক্ষীরা অকুস্থল থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। জীপটির পেছনে সাদা পোশাকের পুলিশ রক্ষীসহ পুলিশ ভ্যানটি, যা আগে থেকেই জীপের পেছনে দাঁড়ানো ছিল, জীপটিকে অনুসরণ করে। এর পেছনে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মচারী আরোহিত একটি এসইউভি চলা শুরু করে। অন্য পুলিশ ভ্যানটি কিছু সময় নিয়ে জীপটির অনুসারী হয়। পরে শুনেছি যে, এই পুলিশ ভ্যানটির সরকারী চালক অকুস্থান থেকে পালিয়ে যাওয়ায় শেখ হাসিনার এক ব্যক্তিগত অনুচর এটিকে চালানোর ভার গ্রহণ করেন। গ্রেনেড বা বোমা হামলার সময় শেখ হাসিনার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত পুলিশ রক্ষীগণ তাকে রক্ষা করার জন্য কোন চেষ্টাই করেনি। তাদের কাছে দেয়া অস্ত্র-ব্যবহার করেনি, কিংবা যারা তাকে আক্রমন করেছিল, তাদের ধাওয়া করেনি। পরে এও জেনেছি যে, জীপটি ওই দুটি গাড়িসহ সুধাসদনে প্রায় ২০ মিনিট পরে পৌঁছেছিল। হামলা শেষে জানা গেল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের তাক করে সেদিন সর্বমোট ১২টি গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। প্রথম গ্রেনেডটি সিটি হোটেল ইমারত থেকে ছোড়া হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়টি একই গতিপথ অনুসরণ করেছিল। অন্যগুলো রাজ্জাকস নামীয় দোকান সংবলিত ইমারত থেকে ছোড়া হয়ে থাকতে পারে। একটি সম্ভবত রমনা ভবনের পূর্ব পাশে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার সড়ক, যা পেট্রোল পাম্প স্ট্রিট নামে অভিহিত, থেকেও ছোড়া হতে পারে। ট্রাকের চারপাশে জনতার মাঝে লুকিয়ে আততায়ীরা সম্ভবত গ্রেনেড ছোড়েনি। ওসব স্থান থেকে ছোড়া হয়ে থাকলে যে বা যারা ছুড়েছিল তাকে বা তাদের (গ্রেনেড ছোড়ার পর যে গ্রেনেড ছুড়েছে সে প্রতিরক্ষণবিহীন হয়ে যায়) সহজে শনাক্ত করা ও ধরা যেত। পিস্তল/রিভলভারের গুলি সম্ভবত ট্রাকের উত্তর-পশ্চিম কোন থেকে প্রশিক্ষিত পেশাদাররা জনতার ভিড়ে লুকিয়ে থেকে ছুড়েছিল। রাইফেল/বন্দুকের গুলি দু’পাশের ইমারত, সম্ভবত উত্তর-পূর্ব দিকের রাজ্জাকস নামীয় দোকান সংবলিত এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সিটি হোটেল ইমারত থেকে ছোড়া হয়েছিল। গ্রেনেডগুলো পরে অর্জেস ৮৪ লেখা গ্রেনেড হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। এসব গ্রেনেড দেশের বাইরে, সম্ভবত অস্ট্রিয়ায় তৈরি। এগুলো সশস্ত্র প্রশিক্ষণ বা ওই ধরনের যুদ্ধে ব্যবহার্য। এগুলো হয় সেনাবাহিনীর জন্য আমদানি করা, কিংবা দেশের অভ্যন্তরে বা প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতা চালনার জন্য চোরাচালান করে আনা হয়েছিল। পরে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মেজর (অব) শোয়েব আমাকে বলেছেন এই ধরনের গ্রেনেড (আর্জেস-৮৪) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। তিনি আরও বলেছেন যে, কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির প্রত্যন্ত এলাকার জেটি দিয়ে অস্ত্র চোরাচালানের সময় পুলিশ যেসব গ্রেনেড আটক করেছিল বলে দেখান হয়েছে, এসব ওই ধরনের গ্রেনেড। জানা যায়, যেসব গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল তার মধ্যে ৩টি ফাটেনি। পরে পুলিশ এগুলো উদ্ধার করে এদের ফরেনসিক, ধাতুগত বা বিস্ফোরক ক্ষমতা পরীক্ষা না করেই ফাটিয়ে ধ্বংস করেছিল। মেজর (অব) শোয়েব বলেছেন অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলো নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল না এবং পুলিশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় এগুলো যে ভাবে ও যে সময় ফাটিয়েছে, সেভাবে ও সে সময়ে সেগুলো ফাটানোর প্রয়োজন ছিল না। আমার বিবেচনায় এভাবে গ্রেনেডগুলো ফাটিয়ে বেআইনীভাবে সাক্ষ্যমূলক উপাদান নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। জানা মতে, পরে বা কোন সময়েই পুলিশ অকুস্থল থেকে গুলির খোসা, পুড়ে যাওয়া স্পিøন্টার, বুলেট বা পেলেট বা এই নারকীয় ঘটনার সম্ভাব্য সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ বা উদ্ধার করার কোন চেষ্টা করেনি। চলবে... লেখক : এমপি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
×