ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এ এক অন্য রাবি

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

এ এক অন্য রাবি

তখন পাখিদের নীড়ে ফেরার সময়। ১৮ আগস্ট। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের কাজলা গেট। অন্যরকম এক প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলছি। গেটের শুধু অর্ধেকটা খোলা। সেখানে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে গল্প করছে। প্রায় পাঁচ মাস পর আজ আবার এসেছি আবেগের এই বিশ^বিদ্যালয়টিতে। কয়েক পা এগোনোর পর চোখে পড়ে শেখ রাসেল স্কুলের নবনির্মিত ভবনটি। যখন ক্যাম্পাস ছুটি হয় তখন ভবনটির কলামগুলো হয়েছিল শুধু। আজ পুরো ভবনটি হয়ে গেছে। অবাক হয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম জুবেরি মাঠটাও আর আগের মতো নেই। অনেকটা খেলার অনুপযোগী হয়ে গেছে। মনে পড়ে যায় এই মাঠে খেলার দিনগুলো। মনে হতে লাগল ভেতরে না জানি কতই পরিবর্তন হয়েছে। আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকতেছি। মনটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। মিনিট দুয়েক হাটার পর দেখলাম এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা সেই প্রেম পুকুরের ঘাটে। এগিয়ে চলেছি প্যারিস রোডে। রাস্তাটির দুই ধার সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। দুইধারে দাঁড়িয়ে থাকা গগন শিরিষা গাছগুলো তাদের সবুজ পাতা দিয়ে রাস্তাটিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও রোদের ঝিলিক এসে পরছে। প্যারিস রোডের সৌন্দর্যের কথা সর্বজনবিদিত। তবে মনে হয় না প্যারিস রোড এর আগে প্রকৃতিকন্যার রূপের ছোয়ায় নিজেকে কখনো এভাবে সাজিয়েছিল। হাতের বাঁ-পাশে ড. মমতাজ উদ্দিন ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবনের সামনের আমগাছগুলোকে এতটা সুন্দর আগে কখনও দেখিনি। গাছগুলো তার ডালপালার সবুজ শ্যামল ছায়ায় নিচটাকে পুরো অন্ধকার করে রেখেছে। প্যারিস রোড ধরে সোজা চলে গেলাম প্রশাসনিক ভবনের সামনে অর্থাৎ জোহা চত্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা স্মরণে বিশ^বিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্যারের মাজারকে কেন্দ্র করে গোলাকার এই চত্বর। ক্যাম্পাস চলাকালীন প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই চত্বরে বসে আড্ডা দিত, ঝালমুড়ি খেত, কেউ বা ছবি তুলত। কিন্তু আজ এই ¯িœগ্ধ বিকেলে আড্ডা দেয়ার মতোও কেউ নেই আর ছবি তোলার মতোও কেউ নেই। সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। এক পা দুই পা করে সামনে এগিয়ে চলছি। উদ্দেশ্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আহা! কতদিন দেখা হয়নি। ভাবতে ভাবতেই এসে পড়লাম গর্বের সেই শহীদ মিনারটির সামনে। মাঠটা একদম ফাঁকা পড়ে আছে। একদম জনশূন্য। আগের মতো গোল হয়ে বসা জেলা সমিতি ও বিভিন্ন সংগঠনের মিটিংগুলো আজ আর চোখে পড়ল না। মনে হলো কোন এক অকূল পাথারে যেন আমি গন্তব্যহীন এক পথচারী। চোখ বেয়ে এল জল। বাঁ-হাতে চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এলাম। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের দিকে। মিলনায়তনটিকে দেখে মনে হলো হাজার বছর ধরে অযতেœ পরে থাকা পুরনো কোন এক জমিদারবাড়ি। প্যারিস রোডের সৌন্দর্যে মোহিত আমার মনটা কেমন যেন বিষণœ হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পরিবহন মার্কেট। তখন চারদিকে সাঁঝ-সাঁঝ ভাব। মসজিদে মাগরিবের আযান হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। রাস্তা থেকেই দেখলাম মার্কেটে দুটো ফটোস্ট্যাটের দোকান আর একটা চায়ের দোকান খোলা রয়েছে। আর সেখানে প্রায় পনেরো থেকে বিশজনের মতো লোক চায়ের বেশ জম্পেশ আড্ডা জমিয়েছে। কিন্তু মার্কেটটিতে তো কোন চায়ের দোকান ছিল না। তাহলে এই দোকানটি কোথা থেকে এলো? মনে প্রশ্ন জেগে উঠল। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে দেখি আরে এটা তো এনামুল ভাইয়ের দোকান। সেখানে আমিও চা-বিস্কুট খেতে বসে গেলাম। খেতে খেতেই এনামুল ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হলো। অনেকদিন বাদে তার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালই লাগল। এনামুল ভাইকে বিদায় বলে আবার হাঁটা শুরু করে দিলাম। চারদিকে প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। আশপাশে কেউ নেই। ভেতরে একটু একটু ভয়ও হচ্ছে। লাইব্রেরির সামনে গিয়ে দেখি একদম নীরব একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। লাইব্রেরিটিকে বড্ড একা একা লাগছিল। মনে হচ্ছিল এ পৃথিবীতে তার থেকে অসহায় বোধ হয় আর কেউ নেই। তখন মনে পড়ে যায় ক্যাম্পাস চলাকালীন লাইব্রেরির পরিবেশের কথা। যে লাইব্রেরিতে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের বই পড়ত আর আজ সেই লাইব্রেরি যেন শ্মশান হয়ে পড়ে আছে। কথাটা ভেবে খুব খারাপ লাগল। হৃদয়টা পুরোপুরি ভেঙে গেল যখন আমার চোখ পড়ল টুকিটাকি চত্বরের দিকে। কোথায় সেই হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ক্ষুধার জ্বালা নিবৃত্তকারী দোকানগুলো আর কোথায়ই বা সেই হাজার হাজার শিক্ষার্থী? বির্ভিন্ন আগাছা জন্মে জায়গাটা অনেকটা জঙ্গলে রূপলাভ করেছে। আর অন্ধকারে একটা ভুতুরে লাগছিল। দেখে মনে হচ্ছিল না এখানে আমাদের আবেগের সেই টুকিটাকি চত্বর ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের ওইদিকটায় অনেকটা কালো অন্ধকার নেমে এসেছে। ওইদিকে যাওয়ার আর সাহস হলো না। তাই আবার প্যারিসের পথ ধরে রওনা দিলাম মেসের উদ্দেশে। চারদিকটা দেখতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম এ যেন আমার দেখা এক অন্য রাবি। আর আপন মনে গেয়ে চললাম শাহ আব্দুল করিমের অমর সেই গানটি ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’
×