ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ধনী দেশগুলো ক্রয়ের চুক্তি করলেও গরিব দেশগুলো চুক্তির বাইরে

আগামী মাসে আসছে করোনার ভ্যাকসিন

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৮ জুলাই ২০২০

আগামী মাসে আসছে করোনার ভ্যাকসিন

রশিদ মামুন ॥ আগামী মাসেই বাজারে আসতে পারে কোভিড-১৯’র ভ্যাকসিন। চীন এবং রাশিয়ার পর এবার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সাফল্যের দাবি করছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল। তবে অক্সফোর্ডের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা না এলেও প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা বলছেন, ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিনটি ৮০ শতাংশই সফল হয়েছে। ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রয়োগের বিষয় উল্লেখ করে বিবিসি, টেলিগ্রাফ, ইকোনমিস্ট এবং স্কাই নিউজের খবর বলছে- যে কোন সময় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে অক্সফোর্ড। চলতি সপ্তাহে চিকিৎসা সাময়িকী দ্যা ল্যানসেটে ক্লিনিক্যাল প্রথম ট্রায়ালের আদ্যোপান্ত তুলে ধরে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশেরও খবর দিচ্ছে প্রভাবশালী এসব গণমাধ্যম। সফলতার এই গল্পের সঙ্গে কবে নাগাদ সাধারণ মানুষের হাতে ভ্যাকসিন পৌঁছাবে তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে জোর আলোচনা। ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিনই নানামুখী খবরে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কেউ বলছে ভ্যাকসিন সফল হয়েছে। শীঘ্রই মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। আবার কেউ বলছেন কার্যকর একটি ভ্যাকসিন পেতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু কোভিড-১৯’র কোন সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই তাই ভ্যাকসিনের দিকেই চোখ রেখেছে বিশ্ব। পুরোপুরি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ফিরতে বিজ্ঞানীরাও দিনরাত চেষ্টা করছেন একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। কিন্তু স্বল্পতম সময়েও ভ্যাকসিন পেতে আবিষ্কারের পর নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে প্রায় দেড় বছরের মতো সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে পরীক্ষার সময় কমিয়ে এনে দ্রুত আরোগ্যের জন্য একটি ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। করোনাতে বিশ্বে আক্রান্তের সাত ভাগ মানুষই মারা যাচ্ছেন। পরিসংখ্যান বলছে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত এক কোটি ৩৯ লাখ ৬৯ হাজার মানুষের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ জন মৃত্যুবরণ করেছে। আর এখনও সারা বিশ্বের ৫০ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি মানুষ কোভিড-১৯’র বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এদের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রতিদিনই যেমন বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সেরকম বাড়ছে মৃত্যু আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এসব মানুষকে বাঁচাতে ভ্যাকসিনের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু হলে কারা প্রথমে পাবে তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর কোন নির্দিষ্ট প্রস্তুতকারী এবং বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব পালন করবে। ফলে তাদের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায়ে আপাতত ভ্যাকসিন পাওয়ার খুব একটা আশা করা উচিত নয়। ডব্লিউএইচও বলছে, যেখানেই প্রয়োজন সেখানে আগে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। তবে ডব্লিউএইচও’র এই নির্দেশনা মানতে কেউ বাধ্য নয়। ফলে যে কোনভাবেই উৎপাদনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসাকেই যুক্তিসঙ্গত পথ বলছে অনেকে। যদিও বিশ্ব নেতারা বলেছেন, বিশ্বের সকল নাগরিকের জন্য করোনা ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু কবে এবং কিভাবে হবে সে আলোচনা থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছেন সকলে। তবে গ্লোবাল এ্যালেয়েন্স ফর ভ্যাকসিন (গাভি) বলছে, তারা চেষ্টা করছে বিশ্বের গরিব দেশগুলোর ২০ শতাংশের কাছে যেন ভ্যাকসিন প্রস্তুতের পর পরই তা পৌঁছে দেয়া যায়। গাভির প্রধান নির্বাহী ড. সিথ বার্কলি বলেছেন, এজন্য তারা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারীদের সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য এই তিনটি দেশ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সফল হওয়ার দাবি করছে। তবে এর মধ্যে দুটি দেশের ভ্যাকসিন বাজারজাত করার কৌশল সম্পর্কে এখনও কিছুই জানা যায়নি। উপরন্তু রাশিয়ার হ্যাকারদের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের তথ্য হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, দেশটির একটি হ্যাকার গ্রুপ প্রাণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের তথ্য চুরি করতে চেয়েছে। এজন্য দেশগুলোকে শুক্রবার সতর্ক করা হয়েছে। আর চীন ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন এখনও নিজেদের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সীমিত রেখেছে। অন্যদিকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি আন্তর্জাতিকভাবে দ্রুত ও বিস্তৃত আকারে সরবরাহের জন্য সাপ্লাই চেন তৈরি করছে যুক্তরাজ্যের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এ্যাস্ট্রাজেনেকা। অক্সফোর্ডের করোনার ভ্যাকসিনের ২০০ কোটি ডোজের সরবরাহ আদেশ পেয়েছে এই কোম্পানি। তবে নির্দিষ্ট দাম ঠিক না হলেও বলা হচ্ছে এই দাম সকলের হাতের নাগালেই থাকবে। হতে পারে এক কাপ কফির সমান এই দর। করোনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে এ্যাস্ট্রাজেনেকার কর্মী প্যাস্কাল সোরিয়োট বলেন, ভ্যাকসিনটি এক বছরের মতো মানুষকে করোনা থেকে দূরে রাখতে পারবে। যুক্তরাজ্যে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়াতে ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়েছিল অক্সফোর্ড। লেমানন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ব্রাজিলে করোনার হটস্পট সাও পাওলো ও রিও ডি জেনিরোতে মোট তিন হাজার জনকে দেয়া হয় ভ্যাকসিন। তার মধ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সাও পাওলোতে দুই হাজার ও রিও ডি জেনিরোতে এক হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়। পরবর্তী পর্যায়ে আরও বেশি মানুষকে এই ট্রায়ালের আওতায় আনা হবে। ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলের খবর জানিয়ে টেলিগ্রাফ বলছে, মানবদেহে ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রথম ধাপে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে সংগৃহীত রক্তের নমুনায় এ্যান্টিবডি ও টি-সেল উৎপাদন হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ যেসব স্বেচ্ছাসেবক ভ্যাকসিনটি গ্রহণ করেছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুইভাবে বেড়েছে। এক. এ্যান্টিবডি, দুই. টি সেল। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে টি সেল। এপ্রিলে প্রথমবার মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করেছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। প্রথম দু’জনের শরীরে ভ্যাকসিনটি দেয়া হয়। তাঁদের মধ্যে এলিসা গ্রানাটো একজন বিজ্ঞানী। এর পর আরও ৮০০ জনকে দুটি দলে ভাগ করে কন্ট্রোলড ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছিল যুক্তরাজ্যেই। এছাড়া আমেরিকার মডার্না বলছে, আগামী ২৭ জুলাই থেকে ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করা হবে। একসঙ্গে ৩০ হাজার আমেরিকান এই ট্রায়ালে অংশ নেবেন। মডার্নার প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা নিয়েও আশার সঞ্চার হয়েছে। চীনের সিনোভ্যাক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া আরেক বহুজাতিক কোম্পানি জনসন এ্যান্ড জনসনও জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে তারা শেষ পর্যায়ের কাজ শুরু করবে। জার্মানির বায়োনটেক মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা ফাইজারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শীঘ্রই ভ্যাকসিন নিয়ে ট্রায়ালের পরিকল্পনা জানিয়েছে। এখন সারা বিশ্বে ১৬৬টিরও বেশি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এরমধ্যে মানবদেহে চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে চারটি ভ্যাকসিনের। আর প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় রয়েছে আরও ২৬টি ভ্যাকসিন। আর মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়নি এমন ভ্যাকসিনের সংখ্যা ১৩৫টি। চীনের সামরিক বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে তৈরি একটি ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রথম ধাপে এর নিরাপত্তা এবং ডোজ পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে ভ্যাকসিনটি কতটা নিরাপদ তা পরীক্ষা করা হয়। সেখানে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে শেষ ধাপের পরীক্ষায় বিপুলসংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে ফলাফল জানা হয়। মূলত এই ধাপের পরীক্ষা শেষেই তা মানুষের শরীরে প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়।
×