ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

স্মৃতিতে নুরুল হক মানিক

প্রকাশিত: ০১:০০, ২৪ জুন ২০২০

স্মৃতিতে নুরুল হক মানিক

১৯৯৫ সালের ফেডারেশন কাপ ফাইনাল মোহামেডান-আবাহনী। ফ্লাইট ডিলে দেখে কলকাতায় তিনি প্লেনের দরজায় দাঁড়িয়ে সঙ্গে নেয়া রেডিওটা দিয়ে পুরা ফাইনাল খেলা শুনছিলেন। তখন খেলা অতিরিক্ত সময় শেষ হয়ে টাইব্রেকার চলছে। কিন্তু শেষ শট মারার সময় মোহামেডানের খেলোয়াড় যখন প্রস্তুত তখন প্লেনে যাত্রী ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে। বাধ্য হয়েই রেডিও বন্ধ করে তাকে প্লেনের ভেতরে চলে যেতে হয়েছিল। কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত দুই ঘণ্টার ফ্লাইটে সারাক্ষণ ভেবেছেন শেষ শটে কি গোল হয়েছিল? দিল্লীতে নামার পর হোটেলে যেতে যেতে এক ঘণ্টার উপর, তখনও জানে না শেষ শটে কি হয়েছিল! হোটেলের রুমে গিয়ে ঢাকা ফোন করে জিজ্ঞেস করে জানেন, শেষ শটে গোল হয়েছিল এবং মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন। যিনি ধারাভাষ্য শুনছিলেন তিনি মোহামেডানের একনিষ্ঠ সমর্থক সৈয়দ এনাম মুর্শেদ এবং যিনি শেষ শটে গোল করে ১৯৯৫ সালের ফেডারেশন কাপ মোহামেডানের ঘরে তুলেছিলেন তিনি সদ্যপ্রয়াত ফুটবলার নুরুল হক মানিক। প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক দিলু খন্দকার জানান, ঢাকা মাঠের দমের খেলোয়াড়দের নাম এলে বিআইডিসিতে খেলা সত্তর দশকের বাসু, রহমগঞ্জের সুলতান, হাসানুজ্জামান বাবলু এবং ৮০-৯০ দশকে রক্ষণভাগের আজমত, মধ্যমাঠের খুরশিদ বাবুলের সঙ্গে মধ্য মাঠের নুরুল হক মানিকের নাম অবলীলায় আসবে ! গত ১৪ জুন মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই মারা যান নুরুল হক মানিক। ক্রিকেট আম্পায়ার মেজবাহ উদ্দিন রেজা মানিক সম্পর্কে তার ছোট বেলার গল্প শোনান। অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়েই রেজা জানান, মানিক তার চোখের সামনেই বেড়ে উঠেছে। মতিঝিল এজিবি কলোনির ঈদ গাহের মাঠে এবং তার পাশের মাঠে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেই মানিক তার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেন। ৭৫-৭৬ সালের দিকে রেজা ভাইয়ের তত্ত¡ববোধানে ৪’-৮’’/৪’-১০’’ উচ্চতার ছোটদের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হতো। সেখানে অংশগ্রহণ করতেন মানিক এবং অপু। পরবর্তীতে সিনিয়ারদেরও টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে ফাইনালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড় (অব) মেজর হাফিজ উদ্দিন। প্রায়শই দেখা যেত সে টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মানিকের নাম। রেজা জানান, সেই সব টুর্নামেন্ট খেলেই পরবর্তীতে জায়গা করে নেন ঢাকা ফুটবলের বড় আসরে। তিনি জানান অত্যন্ত মেধাবী এবং কুশলী ফুটবলার ছিলেন মানিক। ২০১৭ সালে ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দল মহাপাগল আয়োজন করেছিল স্বর্ণালী দিনের সেরা খেলোয়াড়দের বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠান। যেখানে দেশের ৩৫ ফুটবলারকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সেখানে উপস্থিত থেকে নুরুল হক মানিক তার সম্মাননা গ্রহণ করেন মোহামেডানের গবর্নিংবডির সাবেক জাদ্রেল সেক্রেটারি মুনিরুল হক চৌধুরীর এর কাছ থেকে। মানিক ছিলেন অনেকটাই চুপচাপ স্বভাবের, তথাপি অনুষ্ঠানে আসার পর আগত অতিথিদের নিয়ে অতীত আলোচনায় মেতে উঠেন। এক ভক্ত সেরা মুহূর্তের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান আজই তো সেরা মুহূর্ত! একসঙ্গে এত সমর্থক আর সাবেক সব মোহামেডান, আবাহনী আর ব্রাদার্সের লিজেন্ড খেলোয়াড়দের পেয়েছি কত বছর পর। এর চাইতে সেরা মুহূর্ত আর কি হতে পারে? তারপর তিনি তার জীবনের এক মজার ঘটনা জানান ভক্তদের। তার এঙ্গেজমেন্টের দিন তিনি চলে যান খ্যাপ খেলতে এবং সেদিন করেন হ্যাটট্রিক। ফিরতে দেরি হলে শ্বশুরবাড়ির সবাই তার এই আচরণে বিস্মিত হয়ে যান। বিয়ের পর বাসরঘরে বউ তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বউকে জানান পুরো ঘটনা। শুনে দুজনেই হাসিতে গড়িয়ে পড়েন। মাঝ মাঠে খেলা মানিক ঢাকা ফুটবল লীগে আরামবাগ থেকেই শুরু করেন। সেখানে ছিলেন ৮৫-৮৭ পর্যন্ত। ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলে ৮৮ সালে, ব্রাদার্সে খেলেন ৮৯-৯৩ পর্যন্ত তারপর চলে আসেন তার স্বপ্নের দল মোহামেডানে। মোহামেডানে ৯৪-৯৮ সাল পর্যন্ত খেলে ফুটবলকে বিদায় জানান। মানিক জাতীয় দলে খেলেছেন ৮৭ থেকে ৯৭ পর্যন্ত। আবাহনীতে কোন মৌসুমে না খেললেও আবাহনীর হয়ে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গলের বিরুদ্ধে ঢাকায় এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপে একটি ম্যাচে খেলেছিলেন। মানিকের ফুটবল আইডল ছিলেন ঢাকা আবাহনীর মাঝ মাঠের কুশলী ফুটবলার আশিস ভদ্র। তার খেলা দেখতেন খুব মনোযোগ দিয়ে। তাছাড়া ফুটবলার মনির হোসেন মনু তাকে খুব উৎসাহ যোগাতেন। যা উল্লেখ রয়েছে ক্রীড়া লেখক মাসুদ আলম ভাইয়ের লিখা বইতে। কথা হয় জাতীয় দলের এবং ব্রাদার্সের সাবেক খেলোয়াড় মাহমুদুল হক লিটনের সঙ্গে। তিনি তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তিনি জানান মানিক ছিল আমার ৫/৬ বছরের ছোট কিন্তু আমাদের মধ্যে তুই তোকারি সম্পর্ক। আমি চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় সোনালি অতীত ক্লাবে গেলে আমাকে চুয়াডাঙ্গার ভাষায় বলত। লিটু তুই কবে এসেছিস? কিছুক্ষণ থেমে লিটন কাপাকাপা কণ্ঠে জানান এই কথা আর কেউ আমাকে কোনদিন জিজ্ঞেস করবে না। সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার দস্তগীর নীরা জানান মানিক তার চমৎকার ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করত। বড়দের শ্রদ্ধা আর ছোটদের ¯েœহ করতে কার্পণ্য ছিল না মানিকের। যখন যে দলে খেলেছে সে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। অফুরন্ত দমের এই খেলোয়াড় এই অল্প বয়সে চলে গিয়ে আমাদের সজাগ করে দিয়েছে। মানিক দেশের বাইরে কলকাতা লীগেও কলকাতা মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন। কলকাতা লীগে ১৯৯১ সালে মোহামেডানের অষ্টম খেলা ছিল ইস্টার্ন রেলের বিপক্ষে। মোহামেডান তখন ০-১ গোলে পিছিয়ে। ওইদিন মানিক কলকাতা মোহামেডানের হয়ে প্রথম নামেন। দ্বিতীয়ার্ধের ২৫ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে ছিল মোহামেডান। মানিকের দুইটা সেন্টারে দুটি গোল। একটি করেন ক্রিস্টোফার আরেকটি করেন তৌসিফ জামাল। মোহামেডানের অনেক সমর্থকদের সেদিনের গগনবিদারী চিৎকারের শব্দ মনে আছে আজো। একটা হারা ম্যাচ মানিকের এর বদৌলতে কিভাবে জিতেছিল মোহামেডান তারা আজো স্মরণ করেন। নুরুল হক মানিকের মৃত্যু ক্রীড়াঙ্গনের সবাইকে কাঁদিয়েছে। ফুটবল থেকে ইস্তফা দিলেও ফুটবলের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকতেন সবসময়। তাই তো সোনালি অতীত ক্লাবে বিকেল হলেই জার্সি আর বুট পরে নেমে যেতেন মাঠে। নিয়মিত খেলেছেন কক্সবাজার বিচ ফুটবলেও। আজ মানিক নেই, প্রিয় ভক্তরা মাঠে গিয়ে মানিককে খুঁজবে না ঠিকই কিন্তু সোনালি অতীত ক্লাব মাঠের দুর্বা ঘাস আর কক্সবাজারের সমুদ্র পাড়ের বালি ঠিকই খুঁজে বেড়াবে নুরুল হক মানিককে।
×