ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী অর্থবছরে দ্বিগুণ টাকা নিতে চায় সরকার

ব্যাংকিং খাতই বাজেটের ভরসা

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১০ জুন ২০২০

ব্যাংকিং খাতই বাজেটের ভরসা

রহিম শেখ ॥ চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত করোনাভাইরাস। এই সঙ্কটে গত তিন মাসে আমদানি-রফতানি ও রেমিটেন্সসহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক উত্তোরণের লক্ষ্য নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। চলতি বাজেটে বড় অঙ্কের ঘাটতি থাকছে। তাই ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে ব্যাংক খাত থেকে ব্যাপকহারে ঋণ নিয়েছে সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক থেকে চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ঋণ নিতে চায়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বিদেশী ঋণ সহায়তার দিকে যেতে হবে সরকারকে। সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকাসহ রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় ঘাটতি থাকবে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতির লাখ কোটি টাকা পূরণ করা হবে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে। সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ধরে সরকার। অর্থবছরের শেষার্ধের শুরু থেকে করোনার সংক্রমণে সরকারের আয় অনেক কম যায়। বাধ্য হয়ে ব্যাংক নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। যদিও বাজেট সংশোধন করে চলতি অর্থবছরের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা করা হয়। চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সরকার ঋণ নিয়েছে ৬৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আরও ১৪ হাজার কোটি টাকার বিল ও বন্ডের নিলাম রয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ অর্থবছরে শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এত বেশি ঋণ নেয়নি সরকার। এদিকে ব্যয় নির্বাহে প্রতিনিয়তই ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। অন্যদিকে এই পরিস্থিতিকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করে বেসরকারী খাতে ঋণ না দিয়ে বরং সরকারকে ঋণ দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন ব্যাংকাররা। এ প্রসঙ্গে এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমান পেক্ষাপটে সরকারকে ঋণ দেয়াই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। এছাড়া এখন সরকারেরও ঋণ দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুধু মে মাসেই সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছর (২০১৮-১৯) শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণ ছিল এক লাখ ৮ হাজার ৯৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হলে বেসরকারী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে বেসরকারী খাতের। এখানে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারবাহিকভাবে কমে যাওয়ার মানে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানো জরুরী। বিশেষ করে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বিদেশী ঋণ সহায়তার দিকে যেতে হবে সরকারকে। করোনার আঘাতের পর থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে বেসরকারী খাতের ঋণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। বেসরকারী খাতের ঋণ বৃদ্ধির রেকর্ড পরিমাণ নিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে। গত মার্চে বেসরকারী খাতে ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তার আগে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে। এভাবে প্রতিমাসেই কমছে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে রাজস্ব আদায় কমায় সরকারের এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। কারণ রাজস্ব আদায় অনেক কম হচ্ছে। বিভিন্ন শর্তারোপ করে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমিয়ে আনা হয়েছে। বিশ^ দাতাদেশগুলোর সঙ্কটের কারণে অনুদান বা ঋণের পরিমাণও কম আসবে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। আবার করের হার বৃদ্ধি এবং আইনকানুন কঠোর করায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যও কমিয়ে এনেছে। ফলে সরকারের এখন একটাই পথ ব্যাংক ঋণ। আর সেটাই করছে। এদিকে ক্রয়সীমা কমানোসহ নানা কড়াকড়ির ফলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ব্যাপকভাবে। এর মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২৭ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে সেভাবে বিক্রি না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। তবে বিক্রি ব্যাপক বাড়তে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত বিক্রি গিয়ে ঠেকে ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকায়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ৭ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ৩০ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে ১১ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে বিপুল অঙ্কের এ দায়ের বিপরীতে চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে সরকারকে ৬৯ লাখ টাকার সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে। সুদ ব্যয় কমাতে গিয়ে সরকার সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের একক সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৬ থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে। আর সঞ্চয়পত্রে সুদ গুনতে হয় ১১ শতাংশের বেশি। এছাড়া আগে সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা বিনিয়োগ করলেও ধরার উপায় ছিল না। এ কারণে সঞ্চয়পত্রে নানা কড়াকড়ি করে সরকার। প্রতি ক্ষেত্রে গ্রাহক উর্ধসীমা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারতেন। তাতে একক নামে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫৫ লাখ এবং যৌথ নামে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্র মিলে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে এক কোটি টাকা সীমা ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
×