ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

শওকত ওসমানের সাহিত্য ॥ সমাজ-বাস্তবতা

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ১৫ মে ২০২০

শওকত ওসমানের সাহিত্য ॥ সমাজ-বাস্তবতা

ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, রম্য লেখক, কবি ও রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। সমাজ সচেতন পর্যবেক্ষণ, আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসা তার সাহিত্যের অন্তর্গত উপাদান। একজন কথাসাহিত্যক সমাজ ও রাষ্ট্রের অসম ব্যবস্থা যেমন চিত্রিত করেন তেমন মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণী, তাদের জীবন সংগ্রাম ও স্বপ্নকে গভীর মমতায় ধারণ করেন। তেজস্বী স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে শওকত ওসমান চারদশকে কথা সাহিত্যের জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার রচিত উপন্যাস : বনী আদম (১৯৪৬), জননী (১৯৬২), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) দুই সৈনিক (১৯৭৩) জলাংগী (পতংগ পিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), রাজ সাক্ষী, (১৯৮৫), পিতৃপুরুষের গল্প (১৯৮৬) শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস জননী। গ্রামীণ জনপদের শোষিত মানুষের আহাজারি এ-ই উপন্যাসে বিধৃত। এক সন্তানহারা মা প্রতিনিয়ত কিভাবে নিগৃহীত হয়েছে তার বিবরণী নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। দেশভাগের পর এদেশে মুসলমানদের ভারত থেকে আগমন, বসতি স্থাপন, ও নানা ধরনের টানাপোড়েন নিয়ে উপন্যাসের অগ্রযাত্রা প্রত্যক্ষ করা যায়। মোড়লী প্রথা, নিষ্পেষণ ও সুন্দর এক পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর্তি ঘিরে আছে চরিত্রের গভীরে। পশ্চিম বংগের মহেশডাংগা গ্রামের দরিয়া বিবি দরিদ্র কিন্তু তার আত্মসম্মান বোধ প্রখর। ছেড়া শাড়ি পরে থাকলেও সে যাকাত গ্রহণ করে না। মোনাদির লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য লম্পট ইয়াকুবের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে না। দরিয়া বিবি গ্রামবাংলার হাজারো নারীর একজন। আমাদের ছেলে সন্তান মানে টাকা আয়ে সক্ষম একজন মানুষ। দরিয়া বিবির সোয়ামী আজহার সমাজের কাছে নত জানু এক চরিত্র। উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। শওকত ওসমান জননী উপন্যাসে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, অবক্ষয়ী সমাজ ও মানবিক যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। দেশ বিভাগের আগে ও পরের বহু ঘটনা, মানুষের যাতনার বাস্তব দিক সংমিশ্রণ করে অগ্রসর হয়েছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থায় নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া মানুষ তার উপন্যাসে মুখর হয়ে উঠেছে। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাস প্রতীকী ব্যঞ্জনাময়। কোথাও কোথাও কাহিনীর ধারাবাহিকতা থমকে গেছে। শওকত ওসমানের রচনার প্রধান কৌশল তিনি অসংখ্য চরিত্র সৃষ্টি করেন, এদের জীবনের চড়াই উতরাই, সমাজের ক্ষত চিহ্নকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে বুঝিয়ে দেন অসংগতি। উপন্যাসের নায়কের উচ্চারণ: অর্থ দিয়ে ক্রীতদাস কেনা যায়, তার হাসি কেনা যায় না। বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের সহচর মশরুর বলেন : স্মৃতি সমস্ত কওমকে জেন্দা করে তুলতে পারে জনাব। কিন্তু আলাম্পনা সবার স্মৃতি শক্তি থাকে না। হাগোবারা যেমন অতীতের অনেক বলে। সে তো এগোতে না পেরে দুঃসহ বর্তমান থেকে পালানোর কুস্তি প্যাচ মাত্র। ও এক ধরনের ভেলকি, জীবনশক্তির লক্ষ্মণ নয়। বলিষ্ঠ মানুষেরই স্মৃতি শক্তির প্রয়োজন সামনে পা ফেলার জন্য। শওকত ওসমানের অন্য উপন্যাস চৌরসন্ধি। এ-ই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কালু রিকশা চালক থেকে ডাকাত দলের সর্দার হয়ে যায়। শহরের দুই চোরের ব্যবসা মন্দা থাকায় তাদের মানসিক অবস্থা, জীবনাচরণ বদলে যায়। পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ববৈষম্য প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার লড়াই পূর্বাঞ্চলে কতটা তীব্র ছিল তা এ উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পূর্বে মোনায়েম খান ও পশ্চিমে আইয়ুব খানের মধ্যকার অন্তঃসারশূন্য সন্ধি ১৯৭১-তে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে খান খান হয়ে ভেঙ্গে যায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায়। রাজনৈতিক দলের পেশী প্রদর্শন ও রাজনীতির ঘূর্ণি এ উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজে যে ক্ষতি করেছে তা তিনি উন্মোচন করেছেন। শওকত ওসমান সমাজ, মানুষ ও চারপাশের অন্ধকারকে উপন্যাসে কাহিনী, ভাষ্যে আবিষ্কার করেছেন। সে কারণে তার কপালে জুটেছে কালজয়ী কথা সাহিত্যের তিলক। পতঙ্গ পিঞ্জর উপন্যাস মানবিক দ্বন্দ্ব সমাজপীড়ন, সংকট কেন্দ্র অবহেলিত মানূষের জীবনের গল্পে ভরপুর। রাজা উপাখ্যান সম্রাট জাহুকের কাহিনীতে বন্দী। বন্দী রাজা দেববানের মতে তার দুই কাঁধে বিষধর গোখরো সাপ থাকে। তারা বলে প্রতিদিন যুবক বা বৃদ্ধের বিশ তিরিশটা মগজ তাদের সরবরাহ করতে হবে। যেদিন রাজা পারবে না সেদিন তাকে দংশন করা হবে। দারিয়স ও জার্জিস মগজ দিতে না পারায় গোখরো সাপ তাদের প্রাণ হরণ করে। এ-র মধ্যেব গ্রাম্য যুবক হরমুজের আগমন ঘটে রাজ প্রাসাদে। রাজকুমারী গুলশান হরমুজের প্রেমে দিওয়ানা। হরমুজ দুটি গোখরো সাপকে খাবার দেয়ার সময় ছলনার আশ্রয় নেয়। দুজনকে সমান খাবার না দিয়ে সে খাবারের পরিমাণে অসম বণ্টন করে। দুই গোখরো একে অন্যকে হত্যা করে। রাজা সাপ থেকে মুক্ত হয়। রাজা হরমুজকে রাজকন্যাসহ রাজ্যের দায়িত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। হরমুজ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান বন্দীনী রূপসহ অন্যদের মুক্ত করার অনুরোধ করে। হরমুজ মুক্ত বন্দীদের নিয়ে রাজ প্রাসাদ ত্যাগ করে। শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস বনি আদম। তিরিশ দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিভাবনা কেন্দ্র করে উপন্যাস আবর্তিত। নায়ক হারেস সহজ, সরল ও আত্মভোলা। বিত্তবানের বাড়িতে সে আশ্রিত সাহায্যকারী। খাওয়াপরাসহ বছরে লুঙ্গি গামছা বরাদ্দ থাকে। পনেরো বছর পর সে শহরে রওনা হয়। রাজমিস্ত্রির যোগালে হিসেবে নতুন জীবন সে শুরু করে। এ-র মধ্যে হারেস সংসারী হয়। ভারত ছাড় আন্দোলনের তোড়ে সে একসময় পালিয়ে বেড়ায়। তিন বছর পর হ হারেস স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলেকে খুঁজে পায়। সে গ্রামে ফিরে যায়। সময়ের ব্যবধানে শওকত ওসমান একজন সাধারণ মানুষকে জীবনবাদী ও অস্তিত্বচেতনায় বিশ্বাসী যোদ্ধাতে রূপান্তর করেছেন। জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরন্য, জলাংগী উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, প্রাপ্তি, আশা-নিরাশা প্রতিবিম্বিত। শওকত ওসমানের উপন্যাস জাহান্নাম হইতে বিদায় সাত পরিচ্ছেদে বিভক্ত। পটভূমি ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দ। শিক্ষক গাজী রহমান প্রধান চরিত্র। গাজী রহমান স্মৃতিচারণ করেছেন এ-ই উপ্পন্যাসে। তার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির নিখুঁত বর্ণনা আমরা খুঁজে পাই। স্বদেশ থেকে পালানোর দৃশ্যাবলীতে ধরা পড়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আশ্রয়হীন নারী শিশুর জীবনযাপন। দুঃসময়ে আক্ষেপ, ক্ষোভ ও স্বপ্নভংগের বেদনা প্রকট হয়ে ওঠে এক বৃদ্ধের কণ্ঠেঃজোয়ান কালে কতো খোওয়াব দ্যাখছি পাকিস্তান হইব, মানুষ হইতে পারব হগগলে। কতো খাডছি, ভোট দিচ্ছি। পাকিস্তান হইল। তাগোর জায়গা দিছি, খাওয়াইছি। হেরাও শুনি অহন মিলিটারীগো লগে। আল্লা বেইমান হইয়া এ-ই বয়সের মরনের লাই পাকিস্তান বানাইছিলাম। পাকিস্তানীদের আক্রমণে তিনি অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করেন। সওদাগরি অফিসের কেরানী ইউসুফের বাড়িতে তার ঠাঁই মেলে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আক্রমণের খবরে সেখান থেকে পালিয়ে বন্ধু রেজা আলীর বাড়িতে আসেন। বাম রাজনীবিদ কিরন রায়ের সাহচর্যে আসেন। একসময় গাজী পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রে আশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধের ভীতিকর অবস্থায় সংলগ্ন হওয়ার কাহিনী একজন প্রত্যক্ষদর্শী এ উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন। নেকড়ে অরণ্য উপন্যাসের চরিত্র তানিমা, জায়েদা, সখীনা, চাষীবউ আমেদিনীরা অরণ্যে বন্দী- এ বন্দীদশা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা তাদের নেই। দুই সন্তানের জননী নুর আ্হসানকে স্মরণ করে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াকু চরিত্র নুর একসময় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়। তানিমা আলী খানের ছুড়ে দেয়া বুলেটে মৃত্যুবরণ করে। জায়েদা ও আমোদিনী আত্মহত্যা করে। পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেলদের লোলুপ দৃষ্টি ও সম্ভোগে বাংলার অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ যেন এক বাস্তব বাঙালীদের জীবনের কাহিনী। এ উপন্যাসে ধারাবাহিক কাহিনীর বিস্তার, দৃশ্যপট স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হয়নি। ডায়রী লেখার আদলে স্মৃতিচিত্র উজ্জ্বল ও বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে বন্দী হয়েছে। শওকত ওসমান গল্পরচনায় সময় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার রচিত প্রথম গল্প আব্বাস। শ্রমজীবী আব্বাস স্কুলে যেতে পারে না। সে কারখানায় কাজ করে, সমাজ বদলের স্বপ্ন লালন করে। কুলীদের ধর্মঘটে আব্বাস অংশ নেয়। কুলী সর্দার তার হাতে লাল পতাকা তুলে দেয়। এ-ই লাল পতাকা মুক্তির আশ্রয়। কিশোর দ্বন্দ্বে ভোগে। গ্রামের কথা মনে পড়ে তার। চোখের সামনে মার মুখ ভেসে ওঠে। শওকত ওসমান রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন শওকত ওসমান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ছিলেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য কথিকাঃইয়াহিয়া জবাব দাও প্রথম সওয়াল, ইয়াহিয়া জবাব দাও দ্বিতীয় সওয়াল দেশবাসীর সমীপে নিবেদন। শওকত ওসমান তার সাহিত্যে রূপক অর্থে বর্ণনা করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ঘিরে তার উপন্যাস, গল্পের কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ জীবনের বহুমাত্রিক দিক যেন বিন্দুতে সিন্ধুর উপস্থিতি হয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শওকত ওসমান প্রতিশ্রুতি, সংগ্রাম ও আবেগ যথার্থভাবে তার সাহিত্যে ধারণ করেছেন। তার সাহিত্য জীবন সংলগ্ন।
×