ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার ছোবল ॥ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ধস

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১২ এপ্রিল ২০২০

করোনার ছোবল ॥ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ধস

করোনার প্রাণঘাতী ছোবলে সারাবিশ্ব কার্যত স্তব্ধ। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। অফিস আদালত বন্ধ। ঘরবন্দী মানুষ। রাস্তায় লোক চলাচল নেই। যানবাহন একেবারেই হাতেগোনা। হোটেল-রেস্তরাঁ কোথাও কোথাও খোলা থাকলেও তাতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে বাড়িতে খাবার নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য স্তব্ধ। বৈশ্বিক বাণিজ্যের অধিকাংশই বন্ধ হয়ে আছে। কিছু কিছু কোম্পানি আর কখনই নতুন করে চালু হতে পারবে না। কোভিড-১৯ মহামারী সারা বিশ্বের অর্থনীতির যে কি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসছে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দা স্বল্পস্থায়ী হবে না কি টানা চলতে থাকবে এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। কিন্তু ইতোমধ্যে এই ভাইরাস মধ্য ফেব্রুয়ারির পর থেকে বৈশ্বিক বাজার মূল্যের ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার ধ্বংস করে দিয়েছে। জীবন রক্ষার প্রয়োজনে বেশিরভাগ সরকার অধিকাংশ ব্যবসায়িক কর্মকা-সহ নাগরিক জীবনের কর্মপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় ক্ষতির অঙ্ক ক্রমাগত স্ফীতই হয়ে চলেছে। বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স চলছে না। লোকে হোটেলে থাকছে না, বাইরে খাচ্ছে না, সিনেমায় যাচ্ছে না। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার প্রায় সব ক্রীড়া টুর্নামেন্ট বন্ধ। মোটর রেসিং থেমে আছে। এ্যাপল ও নাইক চীনের বাইরে তাদের অধিকাংশ দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। ফোর্ড, টয়োটা ও ফোক্সবাগেনসহ গাড়ি নির্মাতারা ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে নিউইয়র্ক নগরীর হোটেলগুলো জুন মাসের শেষ ভাগ পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ খালি থাকবে। নগরীর রেস্তরাঁ ও পানশালাগুলোর বেচা-বিক্রি ৮০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। আমেরিকান হোটেল ও লজিং এ্যাসোসিয়েশনের আশঙ্কা এই আঘাতের পরিণতি ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর ও ২০০৮-এর মহামন্দার মিলিত ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিছু কিছু কোম্পানি অবশ্য সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে। বিভিন্ন দেশের সরকার এক্ষেত্রে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। ব্রিটেন ৩৩ হাজার কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচী ও অন্যান্য সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ নগদ অর্থ সহায়তার জন্য নতুন তহবিল গঠন করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তার পরও কিছু কিছু কোম্পানি এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পেরে পথে বসবে। কোন কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ ঘটবে তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে ভয়াবহ ক্ষতির সম্ভাব্য খাতগুলোর মধ্যে আছে নির্মাণ খাত, মিডিয়া ও বিনোদন, জ্বালানি ও ইউটিলিটি। বিশেষ করে তেল কোম্পানিগুলো তেলের দরপতনে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেলের দাম ১৮ মার্চ ব্যারেলপ্রতি ২৫ ডলারে নেমে আসে। মর্গান স্ট্যানলির হিসাবে না লাভ না ক্ষতি এই অবস্থায় থাকার জন্য মাঝারি পর্যায়ের তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন কোম্পানিগুলোর জন্য তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৫১ ডলার থাকা প্রয়োজন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর তেল কোম্পানি সৌদি আরামকো বলেছে যে, তাদের এ বছর মূলধন ব্যয় এক-চতুর্থাংশ হ্রাস করতে হতে পারে। আমেরিকার এক্সন মোবিলও একই প্রতিধ্বনি তুলে বলেছে তারা মূলধন ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাবে। শুধু তেল কোম্পানিগুলোই যে নগদ অর্থ ধরে রাখার চেষ্টা করছে তা নয়। অন্য অনেক কোম্পানিও তাদের কর্মচারীদের ছুটিতে পাঠাচ্ছে কিংবা লে অফ করছে। নরওয়ের এয়ারলাইন্স ‘নরওয়েজিয়ান এয়ার শাটল’ তার ১০ হাজার কর্মচারীর ৯০ শতাংশকেই সামরিকভাবে লে অফ করেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ হোটেল চেইন ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল গত ১৭ মার্চ ঘোষণা করে যে তাদের হাজার হাজার কর্মচারীকে বিদায় করে দিতে হবে। এই মহামারীতে বিমান পরিবহন শিল্প যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি আর কোন শিল্পের হয়নি। একের পর এক দেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যাত্রীর সংখ্যা একেবারে কমে গেছে এবং সেই সঙ্গে কমেছে এয়ারলাইন্সের রাজস্ব। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন (আইইটিএ) সেই ৫ মার্চ হিসাব দিয়েছিল যে বিক্রি বাবদ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩শ’ কোটি ডলার। ইতোমধ্যে সেই অঙ্ক তো আরও বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএটিএ বলেছে যে বিশ্বের এয়ারলাইনগুলোকে টিকে থাকার জন্য ২০ হাজার কোটি ডলার যাহায্যের দরকার হতে পারে। এমনিতে বিমান পরিবহন কোম্পানিগুলোর অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। আইএটিএর র‌্যাঙ্কিংভুক্ত ১২০টি এয়ারলাইন্স কোম্পানির মধ্যে প্রায় ৩০টি কোম্পানি ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ভাল মুনাফা করেছে। গত বছর ইউরোপে যে ৭শ’ কোটি ডলারের মুনাফা হয়েছে তার সিংহভাগ মুনাফা করেছে সর্ববৃহৎ অর্ধডজন কোম্পানি। অনেক কোম্পানি বিমান কেনার জন্য বিপুল অঙ্কের ঋণ করেছে। অথচ ভাইরাসের কারণে সে সব নির্মাণের ডানা মেলা বন্ধ। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল ও উত্তর আমেরিকার ৯০টি এয়ারলাইন্সের নিট ঋণের পরিমাণ গড় ঋণের ৬ গুণ বেশি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কোন কোন দেশ সমস্ত ধরনের ফ্লাইট ও কোন কোন দেশ আংশিক ফ্লাইট বাতিল রেখেছে। এতে বিশ্বব্যাপী এয়ারলাইন্স শিল্পে ধস নামছে। লকডাউন আরও কয়েক সপ্তাহ চললেও এক পর্যায়ে সেই ধস হয়ত অনেক মাসুলের বিনিময়ে কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু মাসের মাস চলতে থাকলে সেই সঙ্কট উত্তরণেও অসাধ্য হয়ে উঠবে। তখন হয়ত বৈশ্বিক এ্যাভিয়েশন শিল্পকে ঢেলে সাজাতে হবে। জেপি মর্গান নামক একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, মহামারী রোধে দেশে দেশে লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্তব্ধ হয়ে পড়ায় এক বছরের প্রথম অর্ধাংশে বিশ্ব অর্থনীতির নজিরবিহীন সঙ্কোচন ঘটবে। মার্কিন অর্থনীতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৪ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে। করোনার ছোবলে আপাতত এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কোচন ঘটবে বিধায় ভয়াবহ বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেবে। উন্নত দেশগুলোতে বেকারত্বের হার আগামী দুই প্রান্তিকে সামগ্রিকভাবে ১.৬ শতাংশ বাড়বে। ইউরো এলাকার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব দেখা দেবে অনেক বেশি। আগামী সপ্তাহগুলোতে সেখানে প্রাথমিকভাবে ৪ লাখেরও বেশি লোক চাকরি হারাতে পারে। করোনার আশঙ্কায় বিশ্বব্যাপী হোটেল, রেস্তরাঁ ও বার ব্যবসায় মার খাবে। তেমনি মার খাবে সিনেমা থিয়েটারের মতো বিনোদন শিল্প। এ্যাপলের বেচা-বিক্রি আপাতত বন্ধ বা কমে গেলেও পরে তা বাড়তে পারে। তবে কিছু কিছু কোম্পানি এই মহামারীর মধ্যে শুধু যে টিকেই থাকবে তা নয়, উপরন্তু সেগুলোর প্রসার ঘটবে। সুপার মার্কেটগুলো আতঙ্ক থেকে পাগলের মতো কেনাকাটার কারণে সৃষ্ট বাড়তি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে টয়লেট পেপার ও স্যানিটাইজার মানুষ ব্যাপকহারে মজুদ করছে। কেনাকাটার এই ধূম বেশি দিন টিকবে না। এক পর্যায়ে তা স্তিমিত হবে। অন্যান্য শিল্পের আরও বেশি দিন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলতে পারে। করোনা মহামারী অনেক মানুষকে ঘরে বসে কাজ করতে, কেনাকাটা করতে ও নিজেদের মধ্যে বিনোদন করতে বাধ্য করছে। তার ফলে অনলাইন কোম্পানিগুলোর প্রসার ঘটবে। জুম, মাইক্রোসফট টিমস স্ক্যাকস, উইচ্যাট ওয়ার্ক ও অন্যান্য কর্পোরেট ম্যাসেজিং সার্ভিসের চাহিদায় জোয়ার এসেছে। এসব এ্যাপসের প্রতি সপ্তাহের নতুন গ্রাহকের সংখ্যা জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ১৪ লাখ থেকে লাফ মেরে মার্চের প্রথমদিকে ৬৭ লাখে পৌঁছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে খাবার নিয়ে যাওয়া ও ডেলিভারি দেয়ার ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটেছে এই সঙ্কটের কারণে। ইন্টারনেট শপিংয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য আমেরিকায় নতুন ১ লাখ বিতরণ কর্মী নিয়োগ করছে। ১৩ মার্চ আমেরিকার এক পরিসংখ্যান তথ্য অনুযায়ী প্রতি তিনজনের একজন অনলাইনে খাবার কিনছে। এদের ৪১ শতাংশই জীবনে প্রথমবারের মতো এ কাজ করছে। এর মধ্যে কোন ফার্ম যদি করোনা চিকিৎসার ভ্যাকসিন নিয়ে আসে তবে তো তার পোয়াবারো। তাই দেখা যায় সর্বত্র যেখানে শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে তার মধ্যে কারোনা ভাইরাসের ওষুধ তৈরির কাজে নিয়োজিত বায়োটেকনোলজি ‘ফার্ম ‘গাইলিড’-এর শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। করোনা মহামারী যে স্থায়ী পরিণতি রেখে যাবে তা হলো কর্পোরেট শক্তি আরও বেশি করে গুটিকয়েক সুপারস্টার ফার্মের হাতে প্রায় নিশ্চিতভাবে কেন্দ্রীভূত হবে। এয়ারলাইন্স ব্যবসায় বর্তমানে যে ধস চলছে তার পরিণতিতে এক পর্যায়ে উত্তর আমেরিকার আকাশ বহুলাংশেই অপ্রতিযোগিতামূলক থেকে যাবে। গুটিকয়েক এয়ারলাইন্স দৌর্দ- প্রতাপে রাজত্ব করবে। মন্দা অর্থনীতিতে ভয়াবহ আঘাত হানছে। তবে একই সঙ্গে তা গাড়ি নির্মাণ ও বিনোদন থেকে শুরু রূপচর্চার সামগ্রী পর্যন্ত ব্যবসার প্রচলিত ধারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন মডেল তৈরি করবে। ফলে প্রচুর নতুন কোম্পানি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানেরও পুনরুত্থান ঘটবে। তবে তার আগে দেখতে হবে বর্তমান সঙ্কট আমাদের বিপর্যয়ের কোন্ অতলে নিয়ে যাচ্ছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×