ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর পাঁচ জয়িতা

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৪ মার্চ ২০২০

নওগাঁর পাঁচ জয়িতা

জয়িতা অন্বেষণে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত পাঁচ নারী সব বাধা অতিক্রম করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলেছেন। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু, নিজে অশিক্ষিত হয়েও এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসহ সব রকমের বাধা অতিক্রম করে তাঁর সন্তানদের সফলভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, সমাজে বিভিন্ন মানবতার কাজ করে সমাজে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে যে নারী, অতি দরিদ্র হয়েও নিজের উদ্যোগে কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়ে সফলতা অর্জন করে যে নারী, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে নিয়ামতপুর উপজেলার জয়িতা অšে¦ষণে বাংলাদেশ জয়িতা নির্বাচন কমিটির বিশ্লেষণে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা হলেন, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ভালাইনঘাঁটি গ্রামের আবুল কাশেম ও রেহেনা বিবির কন্যা সাথী খাতুন, সফল জননী নারী উপজেলার শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের ভাদরন্ড গ্রামের রাজেন্দ্র সরদার ও আরতী রানীর কন্যা সীতলী রানী, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, সদর ইউনিয়নের বালাহৈর গ্রামের মোঃ খোরশেদ আলম ও সফিরুন নেছার কন্যা মোসাঃ সাহেরা খাতুন, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের ভাদরন্ড গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাদিরা বেগম এবং শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের ঝাঁজিরা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী মোসাঃ বিলকিস পারভীন। এরা পাঁচ জয়িতা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের সাফল্যের ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। সাথী খাতুন : এসএসসি পাস করার পর তার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। কিছুদিন পর তার স্বামীর আচরণ পাল্টাতে থাকে। তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন করতে থাকে। তাকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার গর্ভে ৪ মাসের সন্তান থাকার কারণে তাকে তালাক দিতে পারেনি। সাথী বাবার বাড়িতে চলে আসে। বাবার উৎসাহে সে আবাব লেখাপড়া শুরু করে। এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। স্বামী তার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার জন্য তার পেটে লাথি মারে। কিন্তু তাতেও সন্তান নষ্ট করতে না পারায় সন্তান জন্মের ৪ মাসের মাথায় তাকে তালাক দেয়। ৪ মাসের সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়ে সাথী। স্বামী তার ও সন্তানের কোন খরচ দেয় না। এমনকি কোন খোঁজখবর পর্যন্ত নেয় না। বাবার উৎসাহে সে রাজশাহী নিউ ডিগ্রী গভঃ কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। পাশাপাশি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে বর্তমানে ভাল আছে। সীতলী রানী : শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে ৪০ দিনের কর্মসূচীতে মাটি কেটে চার সন্তানের লেখাপড়া চালিয়েছে। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে কর্মরত আছে। দ্বিতীয় ছেলে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। বড় মেয়ে কলেজ পড়া অবস্থায় বিয়ে দেয় এবং ছোট মেয়ে বর্তমানে নিয়ামতপুর সরকারী কলেজে বিএ পড়ছে। ৪ সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছে। ৪ সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালিয়েও শুধু নিজের পরিশ্রমে সংসারের অবস্থাও আগের চেয়ে অনেক ভাল। সব কু-সংস্কার ভেঙ্গে কন্যাসন্তাদের পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। তিনি অশিক্ষিত হয়েও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করেছেন। মোসাঃ সাহেরা খাতুন : অল্প বয়সে বিধবা হয়ে অর্থনৈতিকভাবে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন। স্বামী বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিয়ামতপুর উপজেলা সদরে গ্রামীণ ডিজিটাল সেন্টার করে বর্তমানে নিজস্ব ডিজিটাল সেন্টার, স্টেশনারী, স্ট্যাম্প ভেন্ডারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক সামাজিক প্রতিন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও জীবন সংগ্রাম করে তিনি আর্থিকভাবে সফল হয়েছেন। বিলকিস পারভীন : অদম্য মেধাবী ও কেরাত হামদ-নাত এ বার বার উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। বিলকিস পারভীনের পিতা একজন আদর্শ শিক্ষক। এইচএসসিতে লেখাপড়াকালীন তার বাবা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাখিল মাদ্রাসায় কর্মরত বিএসসি শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন পর তার বাবা মারা যান। তার স্বপ্ন ছিল বাবার মতো লেখাপড়া শেষ করে আদর্শ শিক্ষক হবে। বিয়ের পর তার চেষ্টা ও স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। বয়স যখন ১৮ বছর ১৪ দিন তখন তিনি পিইডিপি-২ এর আওতায় প্রকল্পে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান। এর কিছুদিন পর রাজস্ব খাতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে সেখানেও আবেদন করে চূড়ান্তভাবে টিকে যান। নওগাঁ সরকারী কলেজ থেকে বিএ এবং এমএ পাস করেন। এছাড়া নওগাঁ পিটিআই হতে সি-ইন-এড, রাজশাহী টিটি কলেজ থেকে বিএড এবং এমএড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নাদিরা বেগম : তিনি দরিদ্র কৃষক আজিজুর রহমানের চার কন্যার একজন। ১৯৯০ সালে দারিদ্র্য কারণে বাল্যবিয়ের শিকার হন। ১৯৯১ সালে এসএসসি পাশ করেন। কিন্তু সংসারের অভাব ও সন্তান জন্মানোর কারণে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। পরবর্তীতে স্বামীর অনুপ্রেরণায় ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পাস করে একই বছরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসেবে জয় লাভ করেন। ২০০৩-২০০৪ সালে একটি বেসরকারী সংস্থা তিলোত্তমার হয়ে ভাবিচা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে নিরাপদ মাতৃত্ব, স্বাস্থ্য সেবা ও স্যানিটেশন সম্পর্কে সমাজের অবহেলিত ও অজ্ঞ মহিলাদের সচেতন করে তোলেন। ২০০৮ সালে সিডিএস হতে শতভাগ পায়খানা, নিরাপদ পানি ও হতদরিদ্রদের মাঝে সাহায্যার্থে কাজ করেন। ২০১০ সাল হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক ও বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে ও নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ২০১৩ সালে স্নাতক পাস করে বর্তমানে মাস্টার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। ২০১৭ সালে নিয়ামতপুর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। বর্তমানে তার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মাস্টার্স শেষ করেছে, মেজ ছেলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এবং ছোট ছেলে এইচএসসিতে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×