ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ আহসান হাবীব

দিল্লী দাঙ্গার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ১২:১৯, ৪ মার্চ ২০২০

দিল্লী দাঙ্গার নেপথ্যে

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরই কতগুলো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়া, নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ পাস ইত্যাদি। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর উপত্যকার জনগণ ফুঁসে উঠলেও ওই এলাকায় ইন্টারনেট ও গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ায় বিশ্ববাসী এর আঁচ ততটা টের পায়নি। তবে সিএএ পাসের পর থেকেই যেন তেঁতে ওঠে ভারত। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাজপথে নামে জনতা। বিজেপি সরকার গত বছরের শেষদিকে সিএএ পাস করলেও রাজপথ ছাড়েনি সাধারণ মানুষ। আইনটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে রাস্তায় অবস্থান করছে আবালবৃদ্ধবিনতা। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী এই আন্দোলন গত সপ্তাহে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এতে প্রায় ৪২ নিরপরাধ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে বহু মানুষ। মসজিদে আগুন দেয়া হয়েছে। দিল্লীর এই দাঙ্গাকে অনেকে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্বাধীন ভারতে দুইটি দাঙ্গার কথা মানুষ ভুলতে পারবে না। ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গা অপরটি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা। ১৯৮৪ সালের দাঙ্গায় প্রায় ৩ হাজার শিখ ও গুজরাট দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। গুজরাট দাঙ্গায় নিহতদের বেশিরভাগই মুসলিম। গুজরাট দাঙ্গার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দিল্লী দাঙ্গার সময় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাই অনেক বিশ্লেষক দিল্লীর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০০২ সালের দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন। গুজরাট দাঙ্গার সময় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আবার দিল্লী দাঙ্গার সময়ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। শত শত বার ফোন করলেও পুলিশ নিরুত্তর ছিল। সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিও ফুটেজ এর প্রমাণ। মার্কিন মুলুকের প্রখ্যাত ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশুতোষ বারানসি দীর্ঘদিন ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, দিল্লীর এই দাঙ্গা সূচনামাত্র। কারণ ১৯৮৪ ও ২০০২ সাল ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায়। ওইদিনের কথা আজও মনে হলে মানুষ শিউরে ওঠে। তার মতে মোদির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা একটি ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ ছোঁয়ার চেষ্টা বরাবরই করেছে। দিল্লী দাঙ্গাও ওই প্রেসক্রিপশনের অংশ হতে পারে। প্রশ্ন হলো কেন এই দাঙ্গা? ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভানু যোশি গতবারের লোকসভা নির্বাচনের সময় কয়েকটি সংসদীয় আসন পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতারা ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আশা সঞ্চার করেছিলেন। তারা (বিজেপি নেতৃত্ব) বলেছিল, পদ্ম শিবির ফের দিল্লীর মসনদে বসতে পারলে ভারতকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসাবেন। কর্মসংস্থান হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। নির্বাচনের এতদিন পর কার্যত সে সবের ছিটেফোঁটাও দেখেনি ভারতবাসী। বরং অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে। প্রবৃদ্ধি কমেছে। যুবকরা কাজ হারিয়েছে। যেসব মানুষ পদ্ম শিবিরকে তাদের তাদের আশার বাতিঘর মনে করেছিল তারাই এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। তার প্রমাণ লোকসভা নির্বাচনের পর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে মোদি শিবিরের মুখ থুবড়ে পড়া। ওই সব রাজ্যে বিজেপির পরাজয় হয়েছে। জনপ্রিয়তা চাঙ্গা করতে এই দাঙ্গা টনিকের মতো কাজ করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। দিল্লী দাঙ্গা নিয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ওআইসি ও জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মুসলিমদের ওপর আঘাতের আবহে ভারত সরকারের উচিত ধর্মের উর্ধে উঠে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে দেশটি জানায়, নৃশংস এবং লাগামছাড়া সহিংসতা ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে মোদি সরকার ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা থেকে ওয়াশিংটনকে বিরত থাকতে বলেছে। বিবিসি ও আলজাজিরা অবলম্বনে।
×