ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ভূতের রানী ভূতের রাজা ভূতের বাড়িঘর

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভূতের রানী ভূতের রাজা ভূতের বাড়িঘর

কৈশোরে গ্রামে ভূত দেখেছিলাম। বেশ কয়েকবার। যদিও বন্ধুরা কখনও বিশ্বাস করেনি। আজও না। বিশ্বাস করুন- আমি আজও বলছি,সত্যি সত্যি ভূত আমি দেখেছি। গভীর রাতে এবং ভরদুপুরে কখনও বটগাছে, কখনও অকূল পাথারে। বটগাছে চুল ছেড়ে বসে থাকতে অথবা একজন আরেকজনের চুলের উকুন বাছতে। পাথারে সাদা শিফন পরে উড়ে বেড়াতে। সেই ছেলেবেলায় এক অমাবস্যার রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। একা, সঙ্গে কেউ ছিল না। বাজার এবং বাড়ির মাঝামাঝিতে কালীবাড়ি। তাতে শিবমন্দির ও কালীমন্দির ছিল। দুটিতে মাঝেমধ্যেই পূজা হতো। পূজা হলে আমাদের আনন্দ। দলবেঁধে হিন্দু বন্ধুদের বাড়িতে মুড়ি-মুড়কি, সন্দেশ খেতে পেতাম। এমনকি কালীমন্দিরের পূজার থালা থেকে সন্দেশ চুরি করে খাবার মজাই ছিল আলাদা। পুরোহিত ঠাকুর সবই দেখতেন কিন্তু ছেলে-ছোকরাদের দুষ্টুমি ভেবে মুচকি হেসে জোরে জোরে পূজার ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন। কোন কমপ্লেন করেননি কোনদিন। কালীমন্দিরটি জড়িয়ে একটি বিশাল বটগাছ-তিন পায়ে দাঁড়িয়ে, তার নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যার রাত। এর মধ্যে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছি একাকী। অন্যদিন অর্থাৎ অন্য হাটবার যত রাত হোক, যত অন্ধকার হোক; কেউ না কেউ সহযাত্রী হতো কিন্তু সেই অমাবস্যার রাতে আমাকে একাই বাড়ির পথে পা চালাতে হলো। বন্ধুরা বলেছিল তাদের কারো বাড়িতে থেকে যেতে, থাকিনি। তাতে যে নিজের পৌরুষে ছায়া পড়বে। আর যাই হোক-পথ অন্ধকার হোক, পথের ওপর ভূতেরা যত বিষাক্ত সাপের রূপ ধরুক বা বটগাছের ডালে বসে ভূত-প্রেতের অট্টহাসি শোনা যাক যেতে আমাকে হবেই। কিন্তু বটগাছটা যত কাছাকাছি আসছিল পা দুটো ততই থেমে যাচ্ছিল। একবার মনে হলো, পেছনে দৌড় মারি। তখনও বাজারে বন্ধুদের কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। ততক্ষণে বটগাছের কাছাকাছি চলে এসেছি আর অমনি কানে এলো খুব জোরে নারীকণ্ঠের অট্টহাসি। ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হঠাৎ কোথা থেকে একটা আলোকরশ্মি গাছে এসে পড়ল। দেখলাম, দুই নারীমূর্তি বসে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। সারা পিঠ জড়িয়ে এলোমেলো চুল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ কালোর মাঝে সাদাদাঁত স্পষ্ট। মনে হলো দুজনের হাত দুটো লম্বা হতে হতে আমার গলার কাছাকাছি চলে আসছে। আর দেরি নয়, দিলাম দৌড়। কয়েক মিনিট পর মনে হলো পেছনের দিকে দৌড়াচ্ছি। শুনেছি ভূতের পা পেছনের দিকে চলে। তবে কি আমাকে ভূতে ধরল? না, দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এবার সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। ছেলেবেলায় এক গল্পদাদুর মুখে শুনেছি ভূতেরও বাড়িঘর আছে, সমাজ আছে, রাজা-রানী আছে। রানী এবং নারী ভূতেরই প্রতিপত্তি ওদের সমাজে। পুরুষরা নারীদের দাসের মতো। সাধারণত বড় বড় বটগাছ কিংবা পোড়োবাড়িতে ওদের বসবাস। ওরা ফলমূল, মাছ, মাংস, শাকসবজি কিছুই খায় না। ওদের খাবার হলো মানুষের রক্ত। এমনি অমাবস্যার রাতে মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত খায়। দৌড়াতে দৌড়াতে অজান্তে আমার হাত ঘাড়ে উঠে এলো এবং স্পর্শ করে দেখলাম তখনও ঠিক আছে। সামনে পাগলার খালের পুল। দ্রুত পুলের ওপর উঠে থেমে হাঁপাতে লাগলাম। পাগলার বিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাদা কাপড় পরা একদল নারী এদিক থেকে ওদিক উড়ে উড়ে খেলা করছে। তাদের মধ্যে এক ভূতের পরনে হালকা রঙের শিফন শাড়ি, কোমর পর্যন্ত ছড়ানো পিঠভর্তি চুল বাতাসে উড়ছে। চুলগুলো কিছুটা সোনালি, ভূতদেরও পার্লার আছে। বটগাছের সেই বড় বড় নখ, হাত এতক্ষণে গুটিয়ে নিয়েছে মনে হলো। একটা বনবিড়াল পাশ দিয়ে চলে গেল। বড় ধরনের ভয় পেয়ে বসল আবার। গল্পদাদুর মুখে শুনেছি, ভূতেরা যে কোন প্রাণী গাছগাছড়ার রূপ ধারণ করতে পারে যখনতখন। বনবিড়ালটি সেরকম কিছু নয় তো। পাগলার বিলে তখন আর নারীরা নেই কিন্তু একদল ষাঁড় যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আমি কোথায় যাব, কোন্দিকে দৌড়াব। চোখ বন্ধ করলাম। এবার আর রক্ষা নেই। দিলাম পুল থেকে নেমে এক দৌড় বাড়ি চলে যাব। যেই চোখ খুললাম দেখি বেশ কয়েকটি কালো বিড়াল লাল ড্যাব ড্যাব চোখে তাকাতে তাকাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আর দেরি করলাম না। চোখ বন্ধ করে দে দৌড় এবং এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছলাম। বুকে ফুঁ দিতে দিতে ঘরে ঢুকে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। যাক বাবা, বাঁচা গেল। কিন্তু এখন আর গ্রামে ভূত দেখা যায় না। ভূতেরা নাকি সব শহরে চলে এসেছে। এ ভূতরাও মানুষের রক্ত চুষে খায়, সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় হোটেলের বিরিয়ানি খায়। বটগাছ, পোড়োবাড়ি এদের ঘরবাড়ি না। দালান কোঠায় থাকে। যত পোড়োবাড়ি ছিল সব দখল করে ভূমিদস্যুরা মানুষের থাকবার বাড়ি যেমন বানিয়েছে তেমনি ফাইভ স্টার হোটেল বানিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাচ্ছে। আমাদের কালীবাড়ির বটগাছটিও এখন আর নেই। ভূতেরা চলে যাবার পর মানুষ নির্ভয়ে কেটে নিয়ে গেছে। আরেকদিনের কথা। গ্রামে আমাদের দুটো বাড়ি- একটি আদি,একটি সাম্প্রতিক। অর্থাৎ নতুন বাড়ি। পুরনো বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান ছিল। বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন। আমার শোবার ঘরটিও দখল হয়ে গেছে। রাত তখন দুটার বেশি বাজে। ঘুমোতে হলে নতুন বাড়িতে যেতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত নিলাম। আবার সেই বিলের পাশ দিয়ে পুল পার হয়ে যেতে হবে। আবার সেই অন্ধকার রাত। ক্ষেতের পাটগাছ মোটামুটি মানুষসমান হয়ে গেছে। এমনই একটা রাস্তা। দু’পাশে পাটক্ষেত। আপছা আলো-আঁধারিতে ছায়ার মতো রাস্তা দেখা গেলেও পাটক্ষেতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমি খুব দ্রুত হাঁটছিলাম। পথ এক কিলোমিটারের কম হবে না। হঠাৎ করে ভূতের কথা মনে পড়ে গেল। আর অমনি পাটক্ষেতে ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ কানে এলো। কানটা একটু খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছি। কে যেন বলছেÑ তুই ফিরে যা, নইলে ঘাড় মটকাইয়া রক্ত খাইব। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। তারপরও সাহস হারালাম না। পাটক্ষেতের আলের বেড়া থেকে একটা মাদারগাছের লাঠি তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পাটক্ষেতের এলাকা ছেড়ে সামনে রয়েছে ছাড়া বাড়ি। অর্থাৎ এতে কেবল গাছগাছরা ছাড়া আর কিছু থাকে না। মানুষ তো নয়ই, গোয়ালঘরও নয়। যেই ছাড়াবাড়ির কাছাকাছি গেলাম, দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে এক নারীমূর্তি, আমার চেয়েও দশগুণ লম্বা হবে। গায়ের রং দেখা যাচ্ছিল না, চেহারা কালো কয়লার রং, রাস্তার দুই পাশে দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেতে হলে দুই পায়ের নিচ দিয়ে যেতে হবে। আমি বোকা নই তার দু’পায়ের নিচ দিয়ে যাই আর ও আমাকে চেপে ধরুক এবং ঘাড় মটকে রক্ত খাক। যা হয় হোক, এখান থেকে নড়ব না। আরেকটা মাদার ডাল তুলে নিলাম। মাদার ডালে কাঁটা থাকে এবং কাঁটাতে ভূত ভয় পায়। এভাবে প্রায় দেড়ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুব আকাশে তখন প্রভাতের ছায়া, ধরিত্রী আস্তে আস্তে ফর্সা হতে শুরু করছে। মনে সাহস পেলাম। শালা, এবার যাবে কোথায়। আমি ব্যারিকেড দিলাম- দেখি, কে তোকে বাঁচায়। দেখলাম পাটক্ষেত থেকে একটা কালো বিড়াল লাল চোখ করে একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে গেল। সেই নারীমূর্তিও নেই। কোথায় চলে গেছে। বহুদিন পর অর্থাৎ যৌবনে পা রাখার পর রাজধানী ঢাকায় এলে আবার ভূত চোখে পড়ল। তাই তো বলি, ভূতরা গেল কোথায়? শুনলাম- মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের গুলি খেয়ে অনেক ভূত মরে গেছে, অনেক আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভূততাড়ুয়া ওঝারা শত শত বছর আগে থেকে ভূত তাড়াত ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে। এখন দিন পাল্টাচ্ছে। এখন মন্ত্র পড়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে ভূত তাড়ায়। কোন পুরুষকে ভূতে ধরতে কেউ দেখেনি। মেয়েদের ওপরই ভূতের আছর পড়ত। ১৯৭১ সালে ওঝারা মোক্ষম একটা মন্ত্র পেল ‘জয় বাংলা’। এই মন্ত্র পড়ার পর ভূত যে কোথায় চলে গিয়েছিল কেউ বলতে পারছিল না। হঠাৎ কোথা থেকে বেরিয়ে এলো। তবে এবারের ভূত কিন্তু আমাদের ছেলেবেলার কালো শরীর, কালো চেহারার, কালো চামড়ার ভূত নয়। এখনকার ভূত ফর্সা, পার্লারে কোঁকড়ানো চুল, চেহারায় মেকআপ করা। দেখতে সুন্দর, সাদা ওয়েল ড্রেসড। আরব নারীদের মতো। বড় ভূতদের ওঝারা মন্ত্র দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তারা নগরীতে এখন বের হতে পারে না। যে কারণে ভূত সমাজের কালীভূত, মামদোভূতের দল রীতিমত আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। ওঝারাও কম যান না। মন্ত্র পড়লে, ঘণ্টা বাজাতে শুরু করলে ভূতরা ঘরে ঢুকে যেতে বাধ্য হয়। একাত্তরের ভূত মুক্তিযোদ্ধাদের বোল্ড এ্যাকশন, এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, একে ফরটিসেভেনের সামনে দাঁড়াতে পারেনি, পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। শহরে, পাহাড়ে পালিয়েছে। কিন্তু পাহাড় এখন আর পাহাড় নেই- কেটেছেঁটে ছোট করে ফেলেছে, ভূতদেরও থাকা-খাওয়ার সুযোগ নেই। শহরের যেসব পোড়োবাড়ি ছিল সেগুলো দখল হয়ে গেছে। তদুপরি হোম মিনিস্টার আসাদুজ্জামান খানের জাবেদ বাহিনী, বেনজীর বাহিনী এমন জাল বিস্তার করে রেখেছে যে, কোনদিকে নড়াচড়া করার উপায় নেই। জীবন বাঁচানো এখন দুর্বিসহ। এখন আর কারও ঘাড় মটকে রক্ত খাবার সুযোগ নেই। এখন ডাস্টবিন, ডাম্পিং ডিপো খোঁজে। যদি উচ্ছিষ্ট কিছু পাওয়া যায়। কালীসন্ধ্যা বা কালীভোরেও এখন আর ডাস্টবিন, ডাম্পিংয়ে যেতে পারে না। তাতেও ব্যারিকেড তাপস, আতিকের বাহিনী ওই সময়টাতে ওসব জায়গায় পাহারায় থাকে। এখন মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই এখন দেশ থেকে পালাতে শুরু করেছে। লন্ডন-নিউইয়র্ক চলে গেছে অনেকেই। সেখানে বসে ইউটিউব চালাচ্ছে। দেশের বাইরে তো- তাই যা খুশি তাই বলছে, যা খুশি বকবক করছে। ঢাকায় ভূতদের যেসব ভবন, বাড়িঘর ছিল সেগুলো পরিত্যক্ত। এখানে ওদের আর জায়গা নেই। এখানেই শেষ নয়। ওঝারা সব জোট বেঁধেছে আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি তারা সব একজোট হয়ে ‘অপারেশন জয় বাংলায়’ নামবে। এই স্লোগান তাদের গায় আগুন ধরায়। ফেব্রুয়ারিও ভূতদের জন্য আতঙ্কের। তখন আর ভূতদের জন্য কোন স্পেস থাকবে না। ঢাকা- ৩১ জানুঃ ২০২০ লেখক : সংসদ সদস্য, সদস্য মুজিববর্ষ উদ্যাপন জাতীয় কমিটি, সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×