ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ইরাক

প্রকাশিত: ১২:৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ইরাক

গত অক্টোবর থেকেই ইরাক প্রায়ই বিক্ষোভে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাজার হাজার লোক বাগদাদ এবং শিয়াপ্রধান দক্ষিণাঞ্চলের রাজপথে নেমে এসেছে। তারা দুর্নীতি, বেকারত্ব, অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। তাদের বিক্ষোভের রুদ্ররোষ থেকে প্রয়াত শিয়া ধর্মীয় নেতা মোহাম্মদ বকর আল হাকিমের মাজারও বাদ যায়নি। ক’দিন আগে নাজাফে তাঁর মাজার ও সেখানে প্রহরারত মিলিশিয়াদের ওপর তারা পেট্রোলবোমা ছুড়ে মেরেছে। নিকটবর্তী ইরানী কনস্যুলেটে তারা আগুনও দিয়েছে। ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করার পর থেকে উত্তেজনা চলছে মধ্যপ্রাচ্যে। ওই হামলার জবাবে গত বুধবার ইরান-ইরাকে মার্কিন সেনা অবস্থান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। তবে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর কেউ হতাহত হয়নি। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে তৈরি হওয়া যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি কিছুটা স্তিমিত হওয়ার মধ্যে ইরাকে মার্কিন সেনা অবস্থানের ওপর রকেট হামলা হয়েছে। বাগদাদের কাছে বালাদ বিমান ঘাঁটিতে রবিবারের ওই হামলায় অন্তত চারজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের এই বিমান ঘাঁটিতে ইরাকী সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, আটটি কাতিউসা রকেট ছোড়া হয়েছিল ঘাঁটি লক্ষ্য করে, চারটির আঘাত হেনেছে। এতে দুই কর্মকর্তাসহ চারজন আহত হয়েছেন। সেনা সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, আহতরা সবাই ইরাকী সৈন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি ইরাকী সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে। এই হামলা কারা চালিয়েছে, সে বিষয়েও বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি। এরই মধ্যে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনীয় একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৬ জন যাত্রী নিহত হলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। তেহরানে এখন নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে ইরানীরা। অন্যদিকে সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন সেনাদের ইরাক ছাড়ার চাপ বেড়েছে। বিদেশী সৈন্যদের বের করে দিতে ইরাকে পার্লামেন্টে পাস হয়েছে একটি প্রস্তাব। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনী। বিভিন্ন সময় ও স্থানে তাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে চার শতাধিক বিক্ষোভকারী। বিক্ষোভ প্রশমিত করতে সরকারের তরফ থেকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি কিংবা দমননীতি কোনটাতে কোন কাজ হচ্ছে না। বিক্ষোভকারীদের দাবি রাজনৈতিক পরিবর্তন। গত ২৯ নবেম্বর সিনিয়র শিয়া ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিসতানি সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানান। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদী জানান, তিনি পদত্যাগ করবেন। এখন পার্লামেন্টকে তার জায়গায় নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে করতে হবে। এর চূড়ান্ত সময়সীমাও ঘনিয়ে এসেছে। তবে বিক্ষোভকারীরা ও শাসক এলিট শ্রেণী উভয়েই জানে যে মাহদীর পদত্যাগই সমস্যার সমাধান নয়। সরকারের দায়িত্ব নিতে এরপর কে আসছেন তা নিয়ে এক নতুন ও সম্ভবত আরও হিংসাত্মক লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটতে পারে। সম্ভবত সেই লড়াইয়ে ইরানও আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে। আপাতত মাহদী ক্ষমতায় রয়েছেন যদিও সত্যিকারের ক্ষমতার ধারক-বাহক হচ্ছেনÑ শিয়া যুদ্ধবাজ রাজনীতিকরা। তারাই মাহদীর উত্তরসূরি বেছে নেবেন। এ ব্যাপারে তাদের প্রেরণা যোগাবে ইরান। ওই রাজনীতিকদের অনেকেই চান যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী যেন আরও নির্মম হন। হাজী আল আমারী ও কায়েস খাজালী পার্লামেন্টে সর্ববৃহৎ ব্লকের প্রধান বলে নিজেদের দাবি করেন এবং শক্তিশালী মিলিশিয়াদেরও তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ইরানের ইসলামিক রিভলিউশনারি গার্ড কোরের বৈদেশিক শাখা কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানির সঙ্গে একত্রে কাজ করে থাকেন। এরা সবাই অঞ্চলজুড়ে শিয়া প্রভাব ছড়িয়ে দিতে চান এবং বর্তমান বিক্ষোভকে একটা হুমকি হিসেবে দেখেন। তাদের কোন কোন মিত্র শক্তি প্রয়োগ করে রাজপথের বিক্ষোভ দমাতে চান। শিয়াদের মতো সুন্নি ও কুর্দি দলগুলোও রাষ্ট্রীয় লুটপাটের অংশীদার এবং সেই কারণে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে কথা বলতে এবং স্ট্যাটাসকে নষ্ট করতে চায় না। সুন্নি-কুর্দি প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ বিক্ষোভকারীদের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলার পর থেকে আর কিছু বলেননি। তিনি নিজেও হুমকির মুখে আছেন। পার্লামেন্টে এক বিশাল ব্লকের প্রধান শিয়া ধর্মীয় নেতা মুক্তাদা আল-সদরও মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। কেউ কেউ বলেন ইরানে তিনি দীর্ঘ সময় গৃহবন্দীর আকারে কাটিয়েছেন। ইরাকের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও তথৈবচ। বিচারকরা বিক্ষোভকারীদের সন্ত্রাস দমন আইনে সাজা দিচ্ছেন। বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হতে দেয়া কঠিন করে তোলার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিক্ষোভ দমনে ইরাক সরকারের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমেরিকা ইরাক সরকারকে বিক্ষোভকারীদের কথা শোনার ও সংস্কার করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি জড়িত হতে তারাও অনিচ্ছুক। বিক্ষোভকারীরা সম্পূর্ণ এক নতুন সরকার, সুষ্ঠু নির্বাচনী আইন ও আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তারা দুর্নীতি ও সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য রাজনীতিকদের বিচার চায়। তারা চায় ইরান ও তার সমর্থিত মিলিশিয়ারাও সরে যাক। জনসাধারণের সিংহভাগ তাদের পেছনে। তবে সিসতানির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থন তাদের প্রয়োজন। ৮৯ বছর বয়স্ক সিসতানি সম্প্রতি বলেছেন, কোন্টা সবচেয়ে উপযুক্ত তা নির্ধারণের দায়িত্ব ধর্মীয় নেতাদের নয়Ñ জনগণের। তার এই বক্তব্য বিক্ষোভকারীদের মনোবল বাড়িয়েছে। এটা ইরান ও সেখানকার ধর্মীয় নেতাদের শাসনের প্রতি কটাক্ষ এবং সম্ভবত এই সঙ্কেত বহন করে যে তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে চান। ওদিকে হত্যা, জখম ও গ্রেফতার সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীদের মনোবল বেশ উঁচুতে আছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তরুণ বেকারদেরই প্রাধান্য। তাদের কেউ কেউ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলের পরিবর্তে পোট্রোল বোমা ছুড়ে মারার মতো হিংসাত্মক কর্মকা-েই বেশি উৎসাহী। ইরাক পরিস্থিতি আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ আকার ধারণ করবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×