ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

রেলওয়ের সংস্কার, এই মুহূর্তে দরকার

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ৪ জানুয়ারি ২০২০

রেলওয়ের সংস্কার, এই মুহূর্তে দরকার

পরিবেশবান্ধব রেলপথ আজ প্রায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রেলের ভয়াবহ চিত্র দেখলে গা শিউরে ওঠে। ঢাকাসহ সারাদেশে ২৮৩৫ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ২৪৯৫টি। এর মধ্যে বৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১৪১২টি এবং অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১০৮২টি। গেটম্যান আছে ২৫৯টি রেলক্রসিংয়ে আর গেটম্যান নেই ২২৩৬টি রেলক্রসিংয়ে। রেলের ৮০% ইঞ্জিন মেয়াদ উত্তীর্ণ। সারাদেশের রেলপথ চরম ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছেন দেশের নিরীহ মানুষ। ট্রেনের ছাদের ওপর বসে যাত্রী যাতায়াত করে এমন দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নেই বললেই চলে। এই অবস্থা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে সময় উপযোগী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। রেলওয়ে প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে সংগঠিতসহ মন্ত্রণালয়, রেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করে দিয়ে ব্রিটিশ আমলের নিয়ম, সংকেত পদ্ধতিসহ ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনকে নতুন করে টেকসই করার জন্য ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো নতুন করে তৈরি করে আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতি স্থাপন, রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন খুবই জরুরী। রেললাইনে কাঠের সিøপার পরিবর্তন, পর্যাপ্ত পাথরের সরবরাহ নিশ্চিত করা, রেললাইনের ভল্ট খোলে চুরি বন্ধ করাসহ অনিয়ম বন্ধ করার জন্য উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। রেলওয়ের সীমানার মধ্যে আবর্জনার স্তূপ অপসারণ, কমলাপুর রেললাইনের দুই ধারে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ, রেললাইনের ওপর দিয়ে জনসাধারণের অবাধ আনাগোনা, সকল অনিয়ম দূর এবং রেলওয়ের আওতাধীন জায়গার সীমানা চিহ্নিত করে সেখানে রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুরু করতে হবে শুদ্ধি অভিযান। দেশের কয়টি রেল স্টেশন কবে থেকে বন্ধ করা হয়েছে, কি কারণে বন্ধ করা হয়েছে, দেশের সকল রেল স্টেশনের তৈরিকৃত বাথরুম কেন বন্ধ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। রেলওয়েতে যে দুর্নীতি হয়েছে তা রেলওয়ের লাইন এবং স্টেশন ঘরগুলোর চিত্র ও পরিবেশ দেখলেই ধারণা করা যায়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থায় ত্রুটি, ডেথ স্টপের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫ মাইল বেগে ট্রেন চালানো, চালকের প্রশিক্ষণ কম, চালকগণ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় তাই তাদের জবাবদিহিতা নেই। এত দীর্ঘ সময় পরেও আমাদের ট্রেনের বগি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে কি বগি তৈরি করার ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করা যায় না ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঠিক উত্তর কারও জানা নেই। রেললাইনের পাথর চুরি হয়ে যায়, নাট-বোল্ট চুরি হয়ে যায়, রেললাইনের সিøপার চুরি হয়ে যায়, সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে দিনে-দুপুরে ট্রাক ভর্তি করে দুষ্কৃতকারীরা রেললাইন চুরি করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার খবর পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন বিচার হয়েছে কিনা তা দেশবাসী জানে না। প্রতিটি রেল স্টেশনের সীমানা চিহ্নিত করে রেলওয়ের জায়গা আলাদা করা প্রয়োজন। না হলে রেলওয়ের জায়গা আরও বেদখল হতে থাকবে। কোন কোন রেল স্টেশনের আশপাশে থাকা রেলওয়ের ভূমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। তাদের রেলের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা সহযোগিতা করে আসছে। রেলওয়ের ভূমিতে স্থানীয় জনসাধারণকে নিয়ে কোন যৌথ বা একক কার্যক্রম করা যাবে না। দেশে কতজন স্টেশন মাস্টার আছেন, কতজন কাজ করেন, কতজন ছুটিতে আছেন, কতজন নিয়মিত বেতন পান, কতজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত আছেন, রেলওয়ে, গার্ড, চালক, সহকারী চালক, লাইনম্যান, সহকারী প্রকৌশলী ইত্যাদি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কতজন এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া কতজন কর্মরত আছেন তার হিসাব নেয়া দরকার। ট্রেনে অনেক চালক আছেন যাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। যারা মানুষের জীবন নিয়ে প্রতিদিন ১৬-১৮টি বগিসহ ট্রেন চালাবেন, যারা রেলওয়ের মূল চালিকাশক্তি তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে, তার কারণ কি জানা দরকার। রেলওয়েকে সাবোট্যাজ করার জন্য কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। বর্তমানে ঢাকা-সিলেট, সিলেট-চট্টগ্রাম রেললাইনের ওপর দিয়ে পারাবত, উপবন, উদয়ন, কালনি, জয়ন্তিকা সুরমা মেইল দিনে-রাতে বারো বার হাজার হাজার যাত্রী বহন করে চলেছে। একেকটি ট্রেনে কমপক্ষে ১৬টি বগি থাকে। এত বগি ও যাত্রীর ভার দুর্বল রেললাইনের ধারণক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাছাড়া রেলওয়ের মাঝখানে যে কাঠের স্লিপার আছে তা অবিলম্বে লোহার করা দরকার এবং রেললাইন সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। রেলওয়েতে যত ডেথ স্টপ আছে সব ডেথ স্টপে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো কালবিলম্ব না করে নতুন করে তৈরি করতে হবে। প্রতিটি ডেথ স্টপে ট্রেন ৫ মাইল গতিতে চালানোর নির্দেশ দেয়া আ॥ে এই সকল নির্দেশ রেলওয়ের কোন্্ আইনে আছে তাও খুঁজে দেখা দরকার। ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫ মাইল গতিতে ট্রেন চালানোর এই অভিনব আইন কোন দেশে আছে কিনা তা আমাদের রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আবিষ্কার ও খতিয়ে দেখা দরকার। রেলওয়ের নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে আরও আধুনিকীকরণ করা দরকার। অনেক রেলওয়ে পুলিশ সদস্য সীমান্তে চোরাচালানে এবং মাদক পাচারে জড়িত বলে শোনা যায়। তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া খুবই জরুরী। তাছাড়া তাদের আরও জবাবদিহিতা বাড়ানো দরকার। রেলওয়ের ভূমি বেদখল হওয়ার নেপথ্যে থাকা কারিগরদের খুঁজে বের করার এখনই সময়। রেলওয়ের দখল হওয়া জায়গা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করা জরুরী। রেলওয়ের জায়গা বেদখলে যারা সহযোগিতা করেছে সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা দরকার। রেলওয়ের যত বড় বড় ব্রিজ রয়েছে যেমন ভৈরব, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু সেতুসহ সকল ব্রিজের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দরকার। রেল দুর্ঘটনার পর কিছুদিন বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর আবার থেমে যায়, কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া হয় না। রেলওয়ের প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে এবং সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে দিতে হবে। রেলওয়ের চলমান প্রকল্পে টেন্ডারবাণিজ্য করে যেন নতুন কোন জি, কে শামীম না জন্মায় সেদিকেও তীক্ষè দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×