ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

অনৈতিহাসিক ॥ ডাকসু ভবনে জিনের আছর পড়েনি তো!

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৪ জানুয়ারি ২০২০

অনৈতিহাসিক ॥ ডাকসু ভবনে জিনের আছর পড়েনি তো!

একটি গল্প দিয়ে আজকের লেখা শুরু করলাম। অবশ্য গল্প নয়, ঘটনা। ছেলেবেলায় আমরা তখন গ্রামের স্কুল-মাদ্রাসায় মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করছি। ছেলেবেলা না বলে তারুণ্য বলাই সঠিক হবে। প্রতিদিন নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শেষে আমাদের বালিথুবা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঠে (বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় যোগ হওয়ায় মাঠ বড় হয়েছে) এসে জড়ো হতাম। বর্ষায় হাডুডু, বর্ষা শেষে ভলিবল, দাঁড়িয়াবান্ধা এবং ধানকাটা হয়ে গেলে নাড়া খেতে ফুটবল খেলা হতো। খালি মাঠ পেলে কখনও কখনও ডাংগুলিও খেলা হতো। এমনই এক বিকেলে খেলা শেষে মাঠে আড্ডায় বসেছি। এক বন্ধু বলল, গ্রামের শেষপ্রান্তে এক বাড়িতে সপ্তাহে দুই দিন জিন আসে, দর্শনার্থীর অভাব-অভিযোগ শোনে এবং সঙ্কট মুক্তির পথ বলে দেয়। এই সুবাদে ওই বাড়িঅলার খোলা সিন্দুক ফুলে-ফেঁপে মোটা হচ্ছে। জিন নাকি মিষ্টি খায়। তাই ক্লায়েন্টরা মিষ্টি নিয়েও যায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জিন দেখব। কোনদিন তো দেখিনি। এবার যখন সুযোগ এসেছে তখন হাতছাড়া করা যায় না। জিন বলে কথা? আমাদের খেলাধুলা এবং বইপড়া, নাটক করার ক্লাবও আছে। তখন সদস্য সংখ্যা (মনে পড়ছে) ৩২। জিন নাকি জিলাপি খেতে পছন্দ করে। আমরা সবাই একমত যে, জিন আমরা দেখবই এবং সেজন্য চাঁদা তুলে নিজেদের মধ্যে দুই সের জিলাপি কেনা হলো। একটা প্ল্যানিংও করা হলো। আমাদের মধ্যে দুজন জিলাপি নিয়ে জিনের মালিকের ঘরে ঢুকব, বাকিরাসব বাড়ি ঘেরাও দিয়ে থাকবে। ভেতরের দুজন সংকেত দিলে আমরা সবাই ভেতরে ঢুকব। কেউ কেউ দরজায় পাহারা দেব। জিন যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে। যথারীতি একরাতে জিনের মালিকের বাড়ি উপস্থিত হলাম। আগে থেকে কিছুই জানালাম না। জানলে জিন নাও আসতে পারে। কিন্তু কিভাবে যেন জিন জেনে যায় এবং ঐদিন আসেনি। তবে শরৎবাবুর শ্রীনাথ বহুরূপী একজনকে পাওয়া গেল। মূলত সে জিন এবং এই জিন এমনভাবে ভয়েস বিকৃত করে কথা বলত যে গ্রামের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সরলপ্রাণ নারীকে ধোঁকা দেয়া সহজ হতো। তখন বিদ্যুত ছিল না। তাই হারিকেন দিয়ে সব কাজ হতো। আমরা হারিকেন জ্বালিয়ে শ্রীনাথ বহুরূপীকে ধরলাম। সেও শরৎবাবুর শ্রীনাথ বহুরূপীর মতোই হাত জোর করে রইল। বাড়িঅলা মাফ চাইতে লাগল। তারপর শ্রীনাথ বহুরূপীকে কান ধরে উঠবস করিয়ে ছেড়ে দিলাম। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল। পরদিন থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে বাড়িঅলার কাছে তাদের দেয়া টাকাপয়সা ফেরত চাইতে লাগল। যা ঘরে তুলেছিল তার চেয়ে বেশি ফেরত দিতে হলো। জিনবাবা এবং তার মালিক বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। শুনলাম আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ডাকসু ভবনেও নাকি কদিন আগে এমনি জিনের আছর পড়েছিল। আর যায় কোথা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্ডারমাইন করা মোটেই ঠিক নয়। ছাত্রছাত্রীরা অনত্র থেকে আসা সেই জিন বাহিনীকে উত্তমমধ্যম দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। এ যুগের লেজবিহীন শ্রীনাথ বহুরূপী ক্যাম্পাসকে বড় বেশি সাদামাটা ভেবেছিল। স্বর্গে বাস করেন তো? তারা বুঝতে পারছেন না-এ যুগের ইন্দ্রও শরৎবাবুর ইন্দ্রের মতোই সাহসী এবং যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সহজে। এ যুগের ইন্দ্র নদী সাঁতরায় না মোটরবাইক, মোটরকারে চলে। ক্যাম্পাসের ইন্দ্ররা অতীতে মিলিটারি আইয়ুব, মোনেম, ইয়াহিয়া তাড়াতে যে আন্দোলন করেছে তা ছিল দুনিয়া কাঁপানো। যার রাজনৈতিক নাম ছিল ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। সকাল নেই, বিকেল নেই, রাত-ভোর নেই ক্যাম্পাস থাকত মিছিলের দখলে। সেদিন ডাকসুর ভিপি ছিল তোফায়েল আহমেদ। যার পরিচয় ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক। জাতির পিতার ৬ দফা এবং তখনকার প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা। অর্থাৎ ৬+১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং এই ধারায় স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং শেষ পর্যায়ে জাতির পিতার নির্দেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও সেদিনের ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, হায়দার আকবর খান রনো, মাহবুব উল্লাহ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, শাহজাহান সিরাজ, শামসুজ্জোহা, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মালেকা বেগম, রাফিয়া আক্তার ডলি, দীপা দত্ত, মমতাজ বেগম, শেখ হাসিনা, আয়েশা খানমÑ এঁরা সেদিন ক্যাম্পাসে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এঁরা সাহসে, বিশ্বাসে, লক্ষ্যে ছিলেন একেবারেই আলাদা, একেকজন ইন্দ্র। শরৎবাবু এখন বেঁচে থাকলে দেখতে পারতেন ক্যাম্পাসের ইন্দ্ররা কতখানি দুর্ধর্ষ, কতখানি সাহসী। বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সকল বহুরূপীকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর আবার নতুন বহুরূপীদের জন্ম হয় মিলিটারিদের ছত্রছায়ায়। তবে এবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে মিলিটারি জিয়া এবং মিলিটারি এরশাদদেরও তাড়িয়ে দেয়। কেবল তখনই শেষ নয় -১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৭৫’র মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬’র ৬ দফা আন্দোলনও এই ক্যাম্পাস থেকেই সূচনা হয় এবং সফলও হয়। আর আমরা কর্মীরা অর্থাৎ সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের পেছনে সেøাগান ফুঁকতাম। আমাদের মধ্যে আবার হলে হলে, ডিপার্টমেন্টে সব দলের শাখা কমিটি ছিল এবং সেসব কমিটির নেতারা ছাত্রদের সংগঠিত করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের ডেমোনস্ট্রেশনে সমাবেশে নিয়ে যেত। সে একদিন ছিল। আমাদের আন্দোলনের ইস্যু ছিল জাতীয়Ñ কখনও শিক্ষার প্রশ্ন, কখনও সামরিক শাসন মানি না, মানব না, কখনও স্বৈরাচার নিপাত যাক ইত্যাদি। আমাদের সময় (ষাটের দশক) ‘সাধারণ ছাত্র’ সংগঠন বলে কিছু ছিল না। ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, (তাও আবার দুই ভাগ মেনন-মতিয়া) এবং সব ছাত্রছাত্রী ছিল একেকটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী। খুব কম ছাত্রছাত্রী ছিল যারা কোন না কোন সংগঠনের সদস্য ছিল না। দুই/চারজন যা ছিল, তারা ছিল তথাকথিত ‘ভাল ছাত্র’Ñ হল, ক্লাস এবং লাইব্রেরি এই বৃত্তের মধ্যে তাদের জীবন আবর্তিত হতো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তাদের কে যে কোথায় হারিয়ে যেত, সমাজে-রাষ্ট্রে তাদের কোন ছাপ থাকত না। আমার এত কিছু বলার উদ্দেশ্য হলো ‘সাধারণ ছাত্র’। এই সাধারণ ছাত্রছাত্রী কারা? ‘সাধারণ ছাত্র’ এই ব্যানারে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোটামুটি একটা ঢেউ তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিগত ডাকসু নির্বাচনে তারা একজনকে ভিপি পর্যন্ত বানিয়েছে অর্থাৎ নির্বাচনে জয়ী করতে পেরেছে। কে এই ভিপি নূর? হঠাৎ কোথা থেকে এসে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করল। এটি অনেক বড় একটা ব্যাপার। এর আগেও আমরা দেখলাম শাহবাগ চত্বরে ডাক্তার ইমরান এইচ সরকার রাতারাতি জননেতা হয়ে উঠেছিল। তবে বেশিদিন টিকতে পারেনি। ফানুসের মতো ফুটে গিয়েছিল। ভিপি নূরের ব্যাপারটাও অনেকটাই সে রকম। দেখা যাবে একদিন ফুঁস করে ফুটো হয়ে গেছে। সংগঠন ছাড়া কোন নেতা স্থায়ী নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পায় না, পেতে পারে না। এর প্রমাণ হচ্ছে, আমাদের দেশে বামপন্থী দলগুলোর মেধাবী-চৌকস নেতা রয়েছে, অত নেতা আর কোন দলে নেই। কিন্তু তারা বছরের পর বছর দল, দলের আদর্শ মূল্যায়ন করতে করতেই চুল সাদা করে ফেলল। একদল ৪/৫ দল হলো, একনেতা একাধিক দলের নেতৃত্ব দিতে দিতে একদিন কর্মীহারা হয়ে লাঠি ধরলেন। তারপর হলেন ইতিহাস। তাও ক্ষণস্থায়ী। ভিপি নূরকে দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে। বলা যায়, আরও করুণ অবস্থা। ইমরান এইচ সরকার তবুও জনপ্রিয় কতক বিষয় বাজারজাত করতে চেয়েছিল। কিছুটা সফল হয়েছিল। যেমন: * জয় বাংলা * তুই রাজাকার * ক- তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার * গ- তে গোলাম আযম, তুই রাজাকার * ন- তে নিজামী, তুই রাজাকার * ম- তে মুজাহিদ, তুই রাজাকার * স- তে সাকা, তুই রাজাকার স্লোগানগুলো স্বীকার করি বা না করি তরুণদের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছিল। * জয় বাংলা সেøাগানের মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজে পেয়েছিল। ক্স তুই রাজাকার সেøাগানের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের (যে শয়তানদের দীর্ঘদিন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে) চিহ্নিত করে ঘৃণা করার সংস্কৃতি চালু করতে পেরেছিল। একজন স্লোগানকন্যাকে নাগরিকগণ আবিষ্কার করতে পেরেছিল। কিন্তু ভিপি নূর কি দিয়ে তথাকথিত সাধারণ ছাত্রছাত্রীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। না-কি তারা ‘ভেরন বৃক্ষে’ চরতে চেয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে তথাকথিত ‘সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের’ পরিচয় জানা দরকার। পত্রপত্রিকা এই ব্যাপারে রীতিমতো উদাসীন। একটা ব্যাপার কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বা ছাত্রী কিভাবে সাধারণ হতে পারে? যেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়াটাই সোনার হরিণ ধরার মতো। ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন কয়েক শ’। যে তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল ভর্তির দিন থেকেই সে ‘অসাধারণ এবং ভিআইপি’। এই ছাত্র বা ছাত্রী কোন দল বা ছাত্র সংগঠনের সদস্য নাও হতে পারেন কিন্তু বিশ্বাসহীন হতে পারেন না। একটা না একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস তার মধ্যে থাকতেই হবে। সে বিশ্বাস : * স্বাধীনতার পক্ষে * মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে * ধনবাদের পক্ষে * সাম্যবাদের পক্ষে * সমাজবাদের পক্ষে * ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে * ধর্ম চর্চার পক্ষে * ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে * জাতীয়তাবাদের পক্ষে * আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে অর্থাৎ যেকোন একটি আদর্শ বা বিশ্বাসের পক্ষে তার অবস্থান রয়েছে। সে নির্দলীয় হতে পারেÑকিন্তু নিঃআদর্শ বা আদর্শহীন নয়, নিরপেক্ষও নয়। মানুষ তো সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। অসুস্থ মানুষই কেবল হিমালয়ে নির্বাসনে যায় আত্মহত্যা করার জন্য এবং আত্মহত্যা করে বিখ্যাত হবার জন্য বা সাধু-সন্ন্যাসী হবার জন্য। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে কেউ ‘নিরপেক্ষ’ বা ‘আদর্শহীন’ নয়। কেননা ‘পক্ষ’ মানে ভাল পক্ষ, মানে দেশপ্রেমিক পক্ষ। আর তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ হচ্ছে (ক্যাম্পাস প্রেক্ষাপটে) সবচেয়ে খারাপ পক্ষ-‘রাজাকার’। ঢাকা- ৩ জানুঃ ২০২০ লেখক : এমপি, সাবেক সভাপতি ও সাঃ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×