ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যর্থ খেলাগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে!

প্রকাশিত: ১২:১৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

ব্যর্থ খেলাগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে!

রুমেল খান, কাঠমান্ডু, নেপাল থেকে ফিরে ॥ দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক খ্যাত এসএ গেমসের যাত্রা শুরু আজ থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর আগে। ১৯৮৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে বসেছিল গেমসের প্রথম আসর। অথচ অনেকেই জানেন না এর শুরুটা হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। সাতটি দেশ নিয়ে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া অলিম্পিক কাউন্সিল (এসএওসি)। সে বছরই ঢাকায় আসরটি আয়োজনের জন্য সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে গেমস গড়ানোর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই তা স্থগিত করা হয়। এরপর প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আয়োজক হতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা ব্যস্ততা দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করে দেশটি। এভাবে একটি বছর কেটে যাবার পর আবারও নতুন করে গেমস আয়োজনের উদ্যোগ নেয় এসএওসি। আয়োজক হিসেবে বেছে নেয়া হয় নেপালকে। শুরুতে পাহাড়ী দেশটির কিছুটা অনাগ্রহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয় তারা। তখন থেকে ‘সাফ গেমস’ (সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস) নামে আসরটি শুরু হয়। তবে ২০০৪ সাল থেকে দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ৩২তম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ‘ফেডারেশন’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। নতুন নাম হয় ‘এসএ গেমস’। গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর গেমসটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়নি। ফলে বাস্তবতার নিরিখেই এটি হয়ে পড়েছে একটি অনিয়মিত আসর। নিয়মিত আসরটি অনুষ্ঠিত হলে যেখানে এটি ১৮তম বার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ১৩ বার। ১৯৮৪-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ ... এই সাত দেশ এসএ গেমসে অংশ নিত। তবে সার্কভুক্ত নতুন দেশ হিসেবে সঙ্গে নবম আসরে (২০০৪) যোগ দেয় আফগানিস্তানও। তবে একটানা ৪টি আসরে অংশ নেয়ার পর এই আসর থেকে সরে দাঁড়ায় যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটি। তারাসহ মালদ্বীপ ও ভুটানই এখন পর্যন্ত আসরটি আয়োজন করতে পারেনি। এ পর্যন্ত এসএ গেমসে বাংলাদেশ জিতেছে ৭৯১ পদক। এই পদকগুলোর মধ্যে ৮৬ স্বর্ণ, ২১০ রৌপ্য এবং ৪৯৫ তাম্রপদক। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত গেমসের বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মধ্যে ১৩টি ডিসিপ্লিন থেকে দেশসেরা ক্রীড়াবিদরা স্বর্ণজয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এগুলো হলো : শূটিংয়ে ২২, সাঁতারে ১৭, আরচারিতে ১০, এ্যাথলেটিক্সে ৮, কারাতেতে ৭, বক্সিং, তায়কোয়ান্দো ও ভারোত্তোলনে ৪টি করে, ক্রিকেটে ৩, ফুটবল, উশু ও গলফে ২টি করে, ফেন্সিংয়ে ১টি। নেপালে অনুষ্ঠিত সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসের আসরে আগের সব অর্জনকেই ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ৬ খেলা থেকে তারা পেয়েছে রেকর্ড ১৯ সোনা। এর মাধ্যমে ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আসরে ১৮ স্বর্ণপ্রাপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এবার বাংলাদেশ রৌপ্য জিতেছে ৩৩টি। আর ব্রোঞ্জ ৯০টি। সবমিলিয়ে ১৪২টি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। রৌপ্য, ব্রোঞ্জ ও মোট পদকপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নিজেদের অতীতের সর্বোচ্চ অর্জনকে এবার ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১০ আসরে ২৩ রূপা ও ২০১০ এবং ২০১৬ আসরে ৫৬টি করে ব্রোঞ্জ জিতেছিল লাল-সবুজরা। ২০১০ আসরেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ৯৭ পদক জিতেছিল। এবার তারচেয়ে আরও ৪৫টি বেশি পদক জিতেছে তারা। ত্রয়োদশ আসরে যেসব খেলা থেকে বাংলাদেশ এবার সোনা জিতেছে তা হলো ১০টি আরচরি থেকে, ৩টি কারাতে, ২টি ক্রিকেট (পুরুষ ও নারী), ২টি ভারোত্তোলন, ১টি করে ফেন্সিং এবং তায়কোয়ান্দো থেকে। তবে এতকিছু অর্জনের পরও কিছু হতাশাও আছে। এসএ গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি স্বর্ণজয় করেছিল যে দুটি খেলায় সেই শূটিং এবং সাঁতারে এবার একটিও সোনা আসেনি। শূটিংয়ে এসেছে ৬ রূপা ও ৪ তামা। আর সাঁতারে এসেছে ৩ রূপা ও ৮ তামা। ২০০৬ আসরে শূটিংয়ে এবং ২০১০ আসরে সাঁতারে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছিল। এবারের আসরে বাংলাদেশের ২৫টি ফেডারেশন অংশ নিলেও তার মধ্যে পাঁচটি ফেডারেশন কোন পদকই জিততে পারেনি। এগুলো হচ্ছে : ভলিবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, টেনিস এবং স্কোয়াশ ফেডারেশন। তাদের কাছে যেন পদক জেতা বড় কথা নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা। সচতেন ক্রীড়ামোদীরা সোচ্চার দাবি জানিয়েছেন অবিলম্বে এসব ফেডারেশন্সের এফিলিয়েশন বাতিল করা হোক। বাস্কেটবলে এবার বাংলাদেশের নারী ও পুরুষ বিভাগের কোচ, ম্যানেজার, কর্মকর্তা ও খেলোয়াড় মিলিয়ে ৩৩ জন অংশ নেয়। ২০১৬ সালের মতো এবারও কোন পদক জেতেনি বাস্কেটবল দল। ভলিবলে এবার বাংলাদেশ দল নারী, পুরুষ ও বিচ ভলিবল (পুরুষ) তিনটি ইভেন্টে অংশ নেয়। সবমিলিয়ে মোট ৩৮ জনের বহর। কিন্তু তারাও থেকেছে পদকশূন্য হয়ে। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৫টি ব্রোঞ্জ জিতেছিল। এরপর ২০ বছর হয়ে গেল কোন পদকই জিততে পারেনি। সাইক্লিং দল তো এবার প্যাডেলই মারতে পারেনি ঠিকমতো। দুই ম্যানেজার, তিন কোচ, ১৪ সাইক্লিস্ট ও ৫ কর্মকর্তাসহ মোট ১৯ জনের বহরের প্রয়াস এবার অশ্বডিম্ব। ২০০৬ সাল থেকে সাইক্লিং দল অংশ নিচ্ছে। ২০১০ সালে জিতেছিল ১টি তামার পদক। এবারের আসর নিয়ে ১০ বছর ধরে কোন পদকই জিততে পারছে না তারা। সাইক্লিং ফেডারেশনের বিরুদ্ধে বহু পুরনো একটি অভিযোগ আছে। তারা কার্যক্রমে নিস্ক্রিয়, কিন্তু অনিয়মে সক্রিয়। ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমসে অবৈধভাবে স্বর্ণপদক অর্জন করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সাইক্লিং ফেডারেশন। মহিলা সাইক্লিস্টকে গলায় স্বর্ণপদক পরানো এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর সেটা প্রকাশ পেয়ে যায় এবং স্বর্ণপদক বাতিল হয়ে যায়। ওই সময় সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পারভেজ হাসান। কেলেঙ্কারির তদন্তের পর তাকে আট বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে দেশের সুনাম নষ্টকারী সেই পারভেজ হাসানকেই চতুর্থবারের মতো সাধারণ সম্পাদক করা হয় এ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে ২ তামা, ১৯৯৫ সালে ১ তামা ... এই ছিল এসএ গেমসে বাংলাদেশ টেনিস দলের কীর্তিগাথা। ২০১৬ আসরের মতো এবারের আসরেও তারা বেশ ‘দাপট’-এর সঙ্গেই পদকশূন্য থাকার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এবার ম্যানেজার, কোচ, খেলোয়াড়সহ মোট ১১ জনের বহর ছিল তাদের। আসর শুরুর আগে টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোরশেদ ‘বড় বড়’ কথা বললেও আসর শুরুর ঠিক আগে নিজ ফেডারেশনের এক নারী টেনিস খেলোয়াড়কে যৌন হয়রানির অপরাধে পদ হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। স্কোয়াশের অবস্থাও তথৈবচ। এক ম্যানেজার, এক কোচ কাম ম্যানেজার ও চার খেলোয়াড়সহ মোট ৬ জনের বহর তাদের। ফলাফল শূন্য। অথচ শুনলে অবাক হবেন, ১৯৮৯ সাল থেকেই তারা অংশ নিয়ে আসছে এসএ গেমসে। ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৬ সালে তামা জেতার পর এবার তাদের অর্জন শূন্য। এবারের এসএ গেমস চলাকালে তিন এ্যাথলেট কোচের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপ হয়েছিল। তারা হলেন : পাকিস্তানের ফাইয়াজ হোসেন, শ্রীলঙ্কার প্রদীপ নিশান্থ এবং ভারতের কোচ ওয়ে হন। তারা সবাই বলেছেন, তাদের দেশ ২০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করে তাদের দীর্ঘমেয়াদে উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া, চাকরি দেয়া, সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া, অলিম্পিক-কমনওয়েলথ-এশিয়ান গেমসের জন্য এ্যাথলেটদের গড়ে তোলা... এগুলোই হচ্ছে পরিকল্পনার অংশ। এসএ গেমস নিয়ে এখন আর তারা মাথা ঘামায় না। বরং এই আসরে তারা পাঠায় তৃতীয় সারির নতুন-অনভিজ্ঞ ক্রীড়াবিদদের। মোট কথা এসএ গেমস খেলেই তারা অলিম্পিক গেমসের প্রস্তুতি নেয়। তারা প্রত্যেকেই বলেন, বাংলাদেশের এ্যাথলেটরা যথেষ্ট সম্ভাবনাময় কিন্তু দুর্বল টেকনিক, স্বল্প প্রস্তুতি, খাদ্যাভ্যাস, উন্নত কোচের অধীনে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের অভাবেই তারা বেশিদূর এগোতে পারছে না।
×