গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকায় সক্রিয় তিনটি চক্র। এই তিন চক্রের প্রধানসহ সব সদস্যকেই শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ছবিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। চক্রের সবাইকে গ্রেফতার করতে কম্বিং অপারেশন শুরু করতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। চক্রের প্রধানসহ অধিকাংশ সদস্যই ইতোপূর্বে গ্রেফতার হয়েছিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোচিং সেন্টারগুলো ফেরও চালু হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা জামিন পেয়েই ওসব কোচিং সেন্টার চালু করেছে। সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাত সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। পেঁয়াজ ও লবণের মতো আসন্ন ২০২০ সালের প্রথম দিকেই এসএসসি ও এইচএসসিসহ সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে সরকার ও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূূর্তি মারাত্মক ক্ষুণœ করার চক্রান্ত করছে চক্র।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকেই কাজ করছে। সে মোতাবেক তথ্য সংগ্রহ, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ছবিসহ ডেটাবেজ তৈরিসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানও অব্যাহত আছে।
ডিএমপির মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের উপকিমশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আগের অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক গত ৩০ নবেম্বর শনিবার গভীররাতে কাফরুল ও লালবাগের দুটি পৃথক জায়গায় অভিযান চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গ্রেফতার হয় মাহমুদুল হাসান আজাদ, মোহাম্মদ নাহিদ, রাসেল আলী, রুহুল আমীন, খালেকুর রহমান টিটু, আহমেদ জুবায়ের সাইমন ও ইব্রাহিম নামে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাত সদস্য। তাদের কাছ থেকে বারোটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, ১৬ মাইক্রো হেডফোন, ১৫ মোবাইল সেট, ২৫ মোবাইল সিমকার্ড, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সমাধানে ব্যবহৃত চারটি বই।
এই কর্মকর্তা বলছেন, গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও প্রক্সি হিসেবে পরীক্ষার্থীদের হয়ে পরীক্ষা দিত। কয়েকটি ধাপে তারা কাজ করে। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করবে, প্রথমেই তাদের খুঁজে বের করতে তাদের একটি গ্রুপ কাজ করে, বিশেষ করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে টার্গেট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা।
পরে কীভাবে প্রশ্নপত্র দেবে, কীভাবে পাস করবে এসব নিয়ে আলোচনা শেষে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকায় চুক্তি করে। বিসিএস পরীক্ষা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষারও চুক্তি করত চক্রের আটক সদস্যরা। পরীক্ষার আগে চক্রটি জামানত হিসেবে পরীক্ষার্থীর মূল সার্টিফিকেট, মার্কশীট ও সনদপত্র নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিত।
চুক্তি অনুযায়ী ভর্তি বা চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষার্থী হলে প্রবেশের সময় কানের ভেতরে একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস দিয়ে দিত, যেটি তল্লাশি বা স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ে না। ডিভাইসের সঙ্গে পরীক্ষার্থীর শরীরে সিমযুক্ত একটি যন্ত্র লাগিয়ে দেয়া হতো। পরীক্ষা শুরুর পর মোবাইলে প্রশ্নের ছবি তুলে বাইরে পাঠিয়ে দিত একজন। বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে সেই উত্তর পাঠানো হতো পরীক্ষার্থীর কাছে। পরীক্ষার্থীর কানে লাগানো সেই যন্ত্রে উত্তর শুনে তা উত্তর লিখে দিত পরীক্ষার্থী। চক্রটি প্রায় পাঁচ বছর ধরে এভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গত প্রায় দশ বছর ধরে সারাদেশে রীতিমত হৈ চৈ চলছিল। শেষ পর্যন্ত ’১৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে গত বছরের প্রায় শেষ দিকে সারাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে চলে সাঁড়াশি অভিযান। অভিযানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত দুটি চক্রকেই পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া হয়। গ্রেফতার হয় ৪৬ ব্যক্তি। ওই অভিযানের কারণে গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষাসহ সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন ঘটনা ঘটেনি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল শিক্ষক, ছাত্র, সরকারী কর্মকর্তা, প্রেস মালিক ও কর্মচারীসহ নানা শ্রেণীপেশার মানুষ। আলোচিত এসব অভিযান ও ঘটনার মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ৯৮ জন ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিলের ঘটনা।
প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। নির্দেশনায় বলা হয়, নির্দেশ অমান্য করে কোচিং সেন্টার চালু রাখা হলে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তা বন্ধ করে দেয়া হবে। পাশাপাশি জেল জরিমানাও করা হবে।
পরীক্ষা শুরুর আগে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়ানো এবং কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে, তাদেরই গ্রেফতার করা হবে। এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীকেও মানবিক কারণে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ থাকছে না। এরপর থেকেই কোচিং সেন্টারগুলোতে অভিযান চলতে থাকে। ধারাবাহিক অভিযানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই সারাদেশের অন্তত ৩৫টি কোচিং সেন্টার সিলগালা করে দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্দেশনা অমান্য করে কোচিং সেন্টার চালু রাখার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ৩৭ জনকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
এমন অভিযানের মধ্যেই উচ্চ আদালত কোচিং সেন্টারে কে বা কারা শিক্ষকতা করতে পারবেন সে সংক্রান্ত নির্দেশনা দেন। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্দেশ দেয়। নির্দেশনায় বলা হয়, ’১২ সালের নীতিমালা অনুসারে দেশের সরকারী কিংবা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না। তবে, যেসব ব্যক্তি কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত নন, শুধুমাত্র তারাই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কোচিং করাতে পারবেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাভাবিক কারণেই প্রতিবছরের শুরুতেই নানা ধরনের পরীক্ষা হয়ে থাকে। নিয়োগ পরীক্ষার পাশাপাশি বিশেষ করে এসএসসি, এইচএসসিসহ সমমানের পরীক্ষাগুলো সারাদেশে রীতিমত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আগামী বছরের নানা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার জন্য এখন থেকেই কাজ করছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো। ইতোমধ্যেই তিনটি চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই চক্র তিনটি শুধু ঢাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। চক্রের তিন প্রধানকেই শনাক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের সহযোগীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ছবিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি তাদের গ্রেফতার করতে অভিযানও অব্যাহত আছে।