ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীরা অবাধে রাসায়নিক সংগ্রহ করে বানাচ্ছে বিস্ফোরক

প্রকাশিত: ১১:০৬, ৭ নভেম্বর ২০১৯

জঙ্গীরা অবাধে রাসায়নিক সংগ্রহ করে বানাচ্ছে বিস্ফোরক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে এসব রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে বিস্ফোরক তৈরি করছে জঙ্গী ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন। কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিস্ফোরক ভুয়া ভাউচারে সরিয়ে ফেলে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের কাছে। এছাড়া মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি করে দিচ্ছে লাইসেন্সধারী অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আদর্শগত কারণেও জঙ্গীদের কাছে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি ও সরবরাহ করার অভিযোগ আছে। এছাড়া কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের জোগান আসছে। তালিকাভুক্ত ৫৯ বিস্ফোরক ব্যবসায়ীর মধ্যে অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বেআইনীভাবে বিস্ফোরক বিক্রির অভিযোগ আছে। বিস্ফোরক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাসায়নিক পদার্থ ও কেমিক্যাল (তরল) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে না। ঢাকা থেকে সংগৃহীত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে শক্তিশালী হাতবোমা, ককটেল ও হ্যান্ডগ্রেনেড। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতীয় জঙ্গীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মারাত্মক সব বিস্ফোরক। বিস্ফোরক পরিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১ থেকে হালনাগাদ প্রায় পঁচিশ হাজার অস্ত্র গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় দশ হাজার। গ্রেফতার হয়েছে অন্তত আট হাজার। উদ্ধারকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার কেজি বিভিন্ন প্রকারের বিস্ফোরক ও ৩৩৪টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক রয়েছে। এসব ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে প্রায় দশ হাজার সন্ত্রাসী ও জঙ্গী। এর বাইরে বিজিবির অভিযানেও বহু অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, প্রায় প্রতিদিনই অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটলেও ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর মিরপুর থেকে বিপুল বোমা তৈরির সরঞ্জাম, গানপাউডার, শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থসহ রাজশাহী-১ আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি ও দলটির কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান ও বেসরকারী নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীফ কন্ট্রোলারসহ ২০ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী গ্রেফতারের ঘটনা রীতিমতো আলোচনায় এসেছিল। এছাড়া ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সোয়া ৫ কেজি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ পুলিশের হাতে একটি এডুকেয়ার কোচিং সেন্টারের মালিক ও শিক্ষক এইচ এম আতিকুর রহমান (২৪) ও তার সহকারী মাহবুবুর রহমান (১৮) নামের দু’জনের গ্রেফতারের ঘটনাও ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। দু’জনই বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তারা কোচিং সেন্টারের আড়ালে বিস্ফোরক মজুদের কাজ করত। ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলছিল। বিস্ফোরকের চালানটি শিবিরের এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল। পরীক্ষায় বিস্ফোরকগুলো উচ্চমাত্রার বলে ধরা পড়ে। উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা ও গ্রেনেড তৈরি সম্ভব ছিল বলেও জানায় বিস্ফোরক পরিদফতর। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গী বলে স্বীকার করে। এছাড়া ঢাকা মহানগর যুবদল নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটুর বাড়ি থেকে দুই দফায় ৯৭টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধারের ঘটনাও ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। পরবর্তীতে বাড়ির কেয়ারটেকার বেলায়েত হোসেন আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে জানায়, বোমাগুলো দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা তৈরি করে নাশকতা চালানোর জন্য ওই বাড়িতে মজুদ করেছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে ঢাকার বনানী ছাত্রশিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা, গান পাউডার, জিহাদী বই ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের তালিকা উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয় ছাত্রশিবিরের বনানী থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ পাঁচজন। এছাড়া ২০১৫ সালের ৭ জুন ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের হাতে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নয় জঙ্গী গ্রেফতার হয়। উদ্ধার হয় উচ্চমাত্রার প্রায় ৬ কেজি বিস্ফোরক, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, গ্রেফতারকৃতদের তৈরি ৮টি শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড ও ছয়টি চকোলেট বোমা, চাপাতি, উগ্র মতবাদ প্রচারের বইপত্র ও সংগঠনের প্রস্তাবিত পতাকা। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি এবং বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিস্ফোরক তৈরির উপাদান পাচ্ছিল। জঙ্গীদের দেয়া তথ্য মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারের সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুল, ঢাকার টিকাটুলীর এশিয়া সায়েন্টিফিক নামের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক রিপন মোল্যা, ওয়েস্টার্ন সায়েন্টিফিক কোম্পানির ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন ও এফএম কেমিক্যাল এ্যান্ড সন্স নামের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মোঃ নাসির উদ্দিন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গীদের এবং বেআইনীভাবে বিস্ফোরক ও বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রির করার কথা স্বীকার করে। এমন ঘটনার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার ও বিস্ফোরক বা রাসায়নিক পদার্থ বিক্রির প্রতিষ্ঠানের ওপর কড়া মনিটরিং করার নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ১২শ’ কেজি বিস্ফোরকসহ তিন জন গ্রেফতার ও ঢাকার শাহ আলীর উত্তর বিশিলের একটি বাড়ি থেকে ৪০ কেজি খুবই উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক, অত্যাধুনিক ম্যাগজিনসহ ১টি এসএমজি (স্মল মেশিন গান), ১টি বিদেশী অটোমেটিক পিস্তল, ১টি তাজা গ্রেনেড, বোমায় ব্যবহৃত ২৫টি টাইমার, তিন ব্যাগ বোমার স্পিøন্টার ও নাইন এমএম পিস্তলের ১৮ রাউন্ড তাজা বুলেট, ৩৬টি গ্রেনেডের খোলস, টাইম বোমায় ব্যবহৃত শতাধিক ঘড়ি, বোমা তৈরির ফর্মুলা, গ্রেনেড তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম ও প্রচুর জিহাদী বই উদ্ধারের ঘটনাও ছিল আলোচিত। বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকগুলো সাধারণত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যবহার করতে দেখা যায়। ওইসব বিস্ফোরক দিয়ে আর্জেস গ্রেনেডের সমশক্তি সম্পন্ন একহাজার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী টাইমার গ্রেনেড তৈরি সম্ভব ছিল। উদ্ধারকৃত তিন ধরনের বিস্ফোরকের তৈরি গ্রেনেড সাধারণত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কান জঙ্গী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া এমন শক্তিশালী বিস্ফোরক সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ব্যবহার করে। স্বল্প সময়ে একসঙ্গে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে, গাড়িসহ মানুষজন উড়িয়ে দিতে, বড় ধরনের ভবন গুঁড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলো এসব বিস্ফোরক ব্যবহার করে। বিশেষ কাউকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতেও সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যদেরও এ জাতীয় বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি বোমা ব্যবহার করার নজির আছে। বিস্ফোরক তৈরির উপাদান বিক্রির বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, স্কুল-কলেজ বা কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে হলে ওই প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত প্যাডে বা ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের সইসহ কাগজ জমা দেয়ার নিয়ম। জমা দেয়া কাগজপত্র যাচাই বাছাই শেষে রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি বা সরবরাহের নিয়ম। কিন্তু দোকান মালিকরা এসব যাচাই বাছাই না করেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী নিজেকে প্রাক্তন ছাত্র পরিচয় দিয়ে এসব দোকান থেকে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করত। গ্রেফতারকৃতরা সবাই আইএসের অনুসারী। তারা আইএসের আদলে ‘বাংলাদেশ জিহাদী গ্রুপ’ নামের একটি জঙ্গী সংগঠন তৈরি করেছে। সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা রাজধানী ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কেমিক্যাল বিক্রির দোকান ছাড়াও নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থের জোগান আসছে ঢাকার কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি থেকেও। এছাড়া বাংলাদেশ ভারত স্থল সীমান্তের অস্ত্র গোলাবারুদ চোরাকারবারিদের কাছ থেকেও বিস্ফোরক সংগ্রহ করে জঙ্গীরা। ঢাকা থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা, ককটেল আর হ্যান্ড গ্রেনেড। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতীয় জঙ্গীদের মাধ্যমে স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরি হয়। বিস্ফোরক পরিদফতরের তথ্য মোতাবেক, ঢাকায় আতশবাজি বা এ জাতীয় বিস্ফোরক বিক্রির দোকানের সংখ্যা ৫৯টি। দোকানগুলো কি পরিমাণ স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক আমদানি করে এবং বিক্রি করে তা মনিটরিং করার কথা। সরকারী হিসাব অনুযায়ী তারা কত বিস্ফোরক এনেছে এবং বিক্রি করেছে তার ফিরিস্তি দেয়ার কথা। বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।
×