ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন আহম্মেদ হীরা

রামু থেকে নাসিরনগর, অতঃপর ভোলা

প্রকাশিত: ১১:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

রামু থেকে নাসিরনগর, অতঃপর ভোলা

কক্সবাজারের রামু থেকে শুরু, পরবর্তীতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সর্বশেষ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক গুজব রটিয়ে সৃষ্ট হামলার ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে সরকারের উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞ থমকে দেয়া। প্রতিবারই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুজব রটনাকারী কিংবা হামলাকারী ও তাদের নেপথ্যের ইন্ধনদাতারা কঠোর কোন শাস্তি না পাওয়ায় গুজবসন্ত্রাস থামানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রত্যেক সচেতন মানুষের উচিত গুজবে কান না দিয়ে এবং কারো উস্কানিতে না পড়ে যাচাই করে প্রকৃত ঘটনা জেনে নেয়া। পাশাপাশি ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে যারা মসজিদ ও মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করেছে। তারা ইসলামের নামে কেমন প্রতিবাদ করেছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সূত্রমতে, ২০০১ সালে আত্মপ্রকাশ করা হিজবুত তাওহীদ নামের একটি সংগঠন। প্রথমে নিজেদের প্রকৃত মুসলমান দাবি করে প্রচার চালাতে থাকে। ওই সময় তারা দাবি করেছিল, জুমার নামাজ পরা যাবে না, নারী ও পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে পারবে। এছাড়া ওই সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সব সময় নিজেদের আত্মরক্ষায় কোমরে হাতুড়ি রাখতেন। সে সময় হিজবুত তাওহীদের দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলার আমিরের বাড়ি ছিল বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সাকোকাঠী গ্রামে। তাদের এসব উগ্রবাদী প্রচারে এলাকার মুসল্লিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে গৌরনদীর শাহজিরা গ্রামের খলিফাবাড়ি জামে মসজিদের মুসল্লিরা সর্বপ্রথম হিজবুত তাওহীদের উগ্রপন্থী প্রচারের প্রতিবাদ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সংগঠনের নেতাকর্মী ও সদস্যরা ওই জামে মসজিদে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। সে সময় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দাবি করেছিলেন, কোন প্রকৃত ইসলামী সংগঠন হলে তারা মসজিদে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে পারে না। দীর্ঘদিন পর ভোলার ঘটনার পর ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মধ্যে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, ইসলাম ও মহানবীকে নিয়ে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে যারা মসজিদ ও মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করেছে, তারা ইসলামের কেমন প্রতিবাদ করেছে! কি ঘটেছিল সেদিন বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক যুবক গত ১৮ অক্টোবর (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ভোলার বোরহানউদ্দিন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। একটি অসাধু ও কুচক্রী মহল তার আইডি থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বার্তা ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চেষ্টা চালাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ঘটনার তদন্তে বিপ্লব চন্দ্র শুভকে হেফাজতে নেয়ার পরে দেখতে পায়, ওই হ্যাক হওয়া ফেসবুক আইডি থেকে তখনও সক্রিয়ভাবে কুচক্রী মহল অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এতে পুলিশ নিশ্চিত হন ওই ফেসবুক আইডি বিপ্লব চন্দ্র শুভর নিয়ন্ত্রণে নেই। পরেরদিন (শনিবার) সকালে এ ঘটনায় বিপ্লব চন্দ্রের বিচারের দাবি করে বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জেরহাট বাজারে ‘মুসলিম তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে মানববন্ধন এবং বোরহানউদ্দিন থানার সামনে বিক্ষোভ করে। রবিবার সকালে পূর্ব অনুমতি ছাড়া আবারও একদল লোক উপজেলা সদরে সমাবেশ করে। এ সময় আয়োজকদের পুলিশের পক্ষ থেকে প্রকৃত ঘটনা অবহিত করা হয় এবং সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করতে বলা হয়। অতিসস্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ভিড়ে কিছু অতিউৎসাহী ছেলেকে। আয়োজকরা সকাল ১০টার দিকে সমাবেশ শেষ করার পর পরই স্থানীয় উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতির নির্দেশে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। ওই সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ প্রথম পার্শ¦বর্তী মসজিদ ও মাদ্রাসায় অবস্থান করেন। একপর্যায়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অশুভ মহলের নির্দেশে লাঠিসোঁটা ও ধারালো দেশী অস্ত্র নিয়ে অতিউৎসাহী ছেলেরা মারমুখী হয়ে মসজিদ ও মাদ্রাসার দরজায় আঘাত করতে থাকে। এ সময় বেশকিছু মাদরাসার শিক্ষার্থী ওই ছেলেদের আটকানোর চেষ্টা করে। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে শুরু থেকে তৎপর থাকা সত্ত্বেও এবং আলেমসমাজ পুলিশ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে কর্মসূচী স্থগিত করলেও, কোন একটি স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মকে পুঁজি করে একটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হতাহতের ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি, ওই সংঘর্ষে নিহত চারজনের মধ্যে দুজনের মাথা থেঁতলানো ছিল। এই কাজ কারা করেছে, এটাও বড় প্রশ্নের বিষয়। পাশাপাশি প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, ওই অতিউৎসাহীদের নেপথ্যে কাদের মদদ রয়েছে? সূত্রমতে, যখন এ হামলা ও সংঘর্ষ চলছে, ঠিক একই সময় বোরহানউদ্দিন উপজেলার রবীন্দ্র পল্লীর হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল বাড়িতে হামলা চালায় একদল যুবক। ওই বাড়ির নারী ও পুরুষরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় নারকীয় তা-ব। লাঠিসোঁটা নিয়ে ওই বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমে মন্দির ভাংচুর করা হয়। এরপর ওই বাড়ির নয়টি ঘরে চলে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। এ ঘটনার পর থেকে ওই গ্রামসহ ভোলার অন্যান্য উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। হিন্দু নিধনের কালো ইতিহাস দ্বীপ জেলা ভোলায় বরাবরেই নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অশ্রু শুকিয়ে যায় নীরবে। বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি হিন্দু পরিবার ছিল। বর্তমানে সেখানে রয়েছে মাত্র ৪৪টি পরিবার। লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চারটি গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওই ইউনিয়নে চার হাজার ৬০০ হিন্দু ভোট ছিল। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনা ও ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রামগুলোর অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ওই ইউনিয়নে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা মাত্র ছয় শ’। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংস ঘটনা ঘটলেও সকল মাত্রা ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করে ভোলা জেলার লালমোহন থানার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের ভে-ারবাড়ির ঘটনা। নির্বাচনের পর পরই শুরু হয় দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ এবং ভে-ারবাড়ি থেকে থানা প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদকর্মীরাও বিএনপি ও জামায়াত ক্যাডারদের নির্যাতনের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। বাড়িঘর লুটপাট, চাঁদাবাজি, এমনকি নারী ধর্ষণের অজ¯্র ঘটনা ঘটেছে ওই গ্রামে। এর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পুরো ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য গঠন করা হয় মানবতাবিরোধী তদন্ত কমিশন। ওই কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও দোষীদের কোন বিচার হয়নি। ফলে কমিশনের কাছে বিচার দেয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হয় হামলাকারীরা। পরবর্তীতে তারা কৌশলে কেউ কেউ খোলস পাল্টিয়ে পুনরায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কখনও প্রকাশ্যে, আবার কখনও রাতের আঁধারে হামলা ও নির্যাতন অব্যাহত রাখে। বরাবরই অসহায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মুখ বুঝে সব সহ্য করে আসছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি ও জামায়াত সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা বলেন, মানবতাবিরোধী তদন্ত কমিশনের কাছে দায়ের করা অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে কারণে-অকারণে এদেশে আর কোনদিন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা হতো না। সেদিনকার মানবতাবিরোধী তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১ অক্টোবর রাতে হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় ভোলার লালমোহনের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনের পরেরদিন (২ অক্টোবর) অন্নদাপ্রসাদ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল গ্রামের চারপাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভে-ারবাড়ি। সেদিন অর্ধশতাধিক নারী তাদের ইজ্জত রক্ষার জন্য সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সে বাড়িটিও বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধে সেদিন শত শত বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসী ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। একের পর একদল হামলা চালিয়ে অসহায় হিন্দু পরিবারের নারীদের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও নারীরা তাদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারেননি। অনেকে ইজ্জত হারানোর ভয়ে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আশপাশের জলাশয়ে। নারীরা পানিতে ঝাঁপিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা চালালে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা তাদের সন্তানদের পানিতে ফেলে হত্যার হুমকি দেয়। পরবর্তীতে সন্তানদের জীবন রক্ষায় তারা (নারীরা) পানি থেকে উঠে আসতে বাধ্য হয়। আর জলাশয়ের পানি থেকে উঠে আসতেই তারা গণধর্ষণের শিকার হয়। এভাবে ধর্ষিত হয়েছে আট বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা। মা-মেয়ে, শাশুড়ি ও পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে একসঙ্গে। ওই সময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সের বিএনপির সন্ত্রাসীরা ধর্ষণ করেছে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা সেদিন ছাড়েনি পঙ্গু নারী শেফালী রানী দাসকেও। পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের মতো বিএনপির সন্ত্রাসীদের কবল থেকে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে শেফালী রানীও পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পঙ্গু শেফালী পালানোর চেষ্টাকালে পুকুর পাড়ের হলুদক্ষেতে পড়ে যায়। তখন দুই সন্ত্রাসী তাকে ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সেদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ওই গ্রামে আশ্রয় নেয়া কমপক্ষে ৬০/৭০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। পরবর্তীতে সম্ভ্রম হারিয়ে লোকলজ্জায় অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ভে-ারবাড়িতে নারকীয় এ পাশবিক ঘটনার বিএনপি সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম ছিল অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের বিএনপি ক্যাডার আবু মিয়া, সেলিম, দুলাল, জাকির হোসেন, সোহাগ মিয়া, নজরুল ইসলাম, আক্তার হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, শাহাবুদ্দিন, মোতাহার, ভুট্টো, নান্নু, মিজান, ইদ্রিস, মোশারফ মিয়া, বাবলু ও কামরুল ইসলাম। অন্তঃসত্ত্বা জয়ন্তী রানীর সংগ্রাম অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেরদিন (২ অক্টোবর) গৃহবধূ জয়ন্তী রানী যখন প্রথম সন্তানের জন্মমুহূর্তে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় দিনদুপুরেই বেলা আনুমানিক তিনটার দিকে ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার সাত নন্বর পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামে হামলা চালায় বিএনপির সন্ত্রাসীরা। তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় বিএনপি নেতা ইলিশাকান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর মাতুব্বরের নেতৃত্বে বিএনপির অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওই গ্রামে হামলা চালিয়েছিল। হামলায় গ্রামবাসী ভয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হামলা চালাতে থাকে। জয়ন্তী রানীর শাশুড়ি মুক্তি রানী একজন গ্রাম্য ধাত্রীকে দিয়ে জয়ন্তীর শিশু প্রসব করাচ্ছিল। শিশু প্রসবের মুহূর্তে সন্ত্রাসীরা তাদের কুঁড়েঘরে হামলা চালায়। ধাত্রী সন্ত্রাসীদের ভয়ে ও আতঙ্কে পালিয়ে যায়। এ সময় ঘরে শুধু অসহায় জয়ন্তী রানী ও তার শাশুড়ি। সন্ত্রাসীদের হামলার মধ্যেই জয়ন্তী রানী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। মুক্তি রানী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে কোন উপায় না পেয়ে জয়ন্তী রানীকে জড়িয়ে ধরে নবজাতককে তার পরনের শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ঘরের অপরপাশের বেড়া ভেঙে প্রসূতি জয়ন্তীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। পরবর্তীতে ওই অবস্থায় তারা হামাগুঁড়ি দিয়ে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় পাশের ধানক্ষেতে অবস্থান করে। সদ্যপ্রসূতি জয়ন্তী রানী তখন দৌড়ে পালানোর মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে ভীত মুক্তি রানী তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়। তখন পর্যন্ত সদ্যোজাত শিশুটিকে মায়ের নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করার সময় পায়নি মুক্তি রানী। তাদের মতো অনেকেই সেই ধানক্ষেতের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটি জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এসে জড়ো হয়েছিল। সেখানে একজনের কাছ থেকে একটি ব্লেড নিয়ে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটির নাড়ি কাটে মুক্তি রানী। রাত নয়টা পর্যন্ত সেখানে থেকে সন্ত্রাসীদের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করে তারা পুনরায় ঘরে ফিরে যায়। এ ঘটনার কারণে সে সময়কার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয়েছে সংগ্রাম। গণধর্ষণ ২০০১ সালের নির্বাচনের পরেরদিন বিভিন্নস্থানে চলে গণধর্ষণ। ঝালকাঠির নলছিটিতে একই পরিবারের চম্পা রানী, পুতুল রানী, মিনতী রানী, মালতী রানীকে একসঙ্গে ধর্ষণ করে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। শুধু নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে বিএনপির সন্ত্রাসীরা রাতে বাড়িতে এসে লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে দলবেঁধে একই পরিবারের মা-মেয়েসহ চারজনকে গণধর্ষণ করে। ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরেরদিন ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চর অন্নদাপ্রসাদ, পিয়ারীমোহন ও ফাতেমাবাদ গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় বিএনপির সন্ত্রাসীরা। সেদিন হামলা থেকে বাঁচতে ভে-ারবাড়ি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু নারীরা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা সেখানে হানা দিয়ে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিপীড়ন ও লুটপাট চালায়। চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি সেদিন ধর্ষিত হয়েছিল, সে এখন আর বাড়িতে থাকে না। যারা সেই বাড়িতে এখনও বসবাস করছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ওই কালিমার কথা তারা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। ভোলার সব নির্যাতিত হিন্দু পরিবারের মনোভাব একই রকম। তারা একটি নিরাপদ, আশঙ্কামুক্ত জীবন দাবি করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ভাওয়াল বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে গত ২০ অক্টোবর বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরে যখন হামলার ঘটনা ঘটছে, ঠিক একই সময় বোরহানউদ্দিন উপজেলার রবীন্দ্রপল্লীর হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাওয়াল বাড়িতে হামলা চালায় একদল যুবক। ওই বাড়ির নারী ও পুরুষরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় নারকীয় তা-ব। লাঠিসোঁটা নিয়ে ওই বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমে মন্দির ভাংচুর করা হয়। এরপর ওই বাড়ির নয়টি ঘরে চলে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। এ ঘটনার পর থেকে ওই গ্রামসহ ভোলার অন্যান্য উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আগুনে পোড়া বিধ্বস্ত ঘরের দুয়ারে চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে বসবাস করছেন ওই পল্লীর বাসিন্দারা। অপরিচিত মানুষ দেখলেই তাদের আতঙ্ক যেন আরও বেড়ে যায়। বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মোঃ এনামুল হক জানান, ঘটনার দুদিন পর গত মঙ্গলবার রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় ৪/৫শ’ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই মামলায় কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। দুষ্কৃতকারীদের ছাড় দেয়া হবে না ভোলায় যে একটা থমথমে অবস্থা ছিল, সেটা কাটতে শুরু করেছে জানিয়ে বরিশাল রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এখন সবকিছু স্বাভাবিক বলেই দেখা যাচ্ছে। যেসব জায়গায় সমস্যা ছিল, সেসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা সতর্কাবস্থানে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। মিডিয়া ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আমরা বেশ কিছু ছবি ও ফুটেজ পেয়েছি, যেগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বোরহানউদ্দিনের পুরো ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। ডিআইজি আরও বলেন, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তাদের খুব দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। দুষ্কৃতকারীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। পাশাপাশি পুরো ঘটনা কেন, কীভাবে হয়েছিল, তা অবশ্যই বেরিয়ে আসবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। লেখক : বরিশাল প্রতিনিধি, জনকণ্ঠ
×