ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

লোকমান চাঁদাবাজির প্রগতি ক্লাবের সহ-সভাপতি;###;হাইব্রিড এই চাঁদাবাজকে ধরতে পারছে না পুলিশ;###;বসছে পুলিশ ফাঁড়ি

কাওরান বাজারে লোকমান বাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

কাওরান বাজারে লোকমান বাহিনী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গোপন চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ ঢাকার কাওরানবাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ ক্রেতার ওপর। রাস্তায় ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয় পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকে। সর্বশেষ মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয় কাওরানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটকে। চাঁদা না দিলেই ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ঠিকমতো দোকান বসতে দেয়া হয় না। দোকানের মালামাল চুরিসহ নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করা হয়। এসব কারণে সবজিসহ অন্যান্য কাঁচামালের দামে সবসময়ই হেরফের হয়। কাওরানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদবাজদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশকারী। তারা সরকারী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করছে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বরাবর একানব্বই জন ব্যবসায়ীর নাম ঠিকানা ও কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসিক কত টাকা হারে চাঁদা নেয়া হয় তা উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। সেই অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। চাঁদাবাজির শিকার হওয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে অভিযোগটি দায়ের করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যকরী কমিটির সদস্য মোঃ জসিম পাটোওয়ারী। এই ব্যবসায়ীর স্বাক্ষরিত অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি কাওরানবাজার এরশাদ বিল্ডিংয়ের পশ্চিম দক্ষিণ পাশে সবজির আড়তের ব্যবসা করেন। চলতি বছরের ১৭ আগস্ট রাত সাড়ে বারোটার দিকে তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কিচেন মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। মার্কেটের ছাদে লোকমানের অফিস। সেখানে নেয়ার পর ছাদের গেট বন্ধ করে দেয়। এরপর তার কাছে দাবিকৃত এক লাখ টাকা দিতে বলে। আর প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে এলোপাথাড়ি কিল, ঘুষি লাথি মারতে থাকে। জীবন বাঁচাতে ৫০ হাজার টাকা আনিয়ে ছাড়া পান তিনি। তাকে এক মাসের মধ্যে টাকা দিতে হবে, অন্যথায় তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ ব্যাপারে জসীম পাটোওয়ারীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযোগের একটি কপি প্রধানমন্ত্রী বরাবরও পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার মত অনেককেই নির্যাতন করেছেন লোকমান ও তার লোকজন। লোকমান বাহিনীর চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে কাওরানবাজার ওয়াসা গলি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফারুক প্রধানিয়া বলেন, চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করা যাচ্ছে না। অনেকবার চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করেছি। কোন ফল হয়নি। দেখা যায়, আড়ৎ থেকে মালামাল চুরি হয়ে গেছে, অথবা দোকানের কর্মচারীকে ধরে মারধর করেছে। এমন বহু ঝামেলা হয়। চাঁদাবাজির বিষয়ে বহুবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কোন লাভ হয়নি। উল্টো বিপদে পড়তে হয়। অভিযোগকারীদের প্রায় সবাই এমন গোপন চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেছেন। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, চাঁদাবাজির কারণে ইচ্ছে থাকলেও সবজিসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম কমানো সম্ভব হয় না। এখন অনেক সবজি বাজারে আসছে। সরবরাহও বেশি। অথচ দাম কমছে। এরপর অনেক কারণের মধ্যে একটি রাস্তায় রাস্তায় এবং সর্বশেষ কাওরানবাজারে চাঁদাবাজি। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, কাওরানবাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ীই গোপন চাঁদাবাজির শিকার। কোন কোন ব্যবসায়ী প্রাণের ভয়ে গোপনে চাঁদা দেন। কিন্তু প্রকাশ করেন না। নানাভাবে চাঁদাবাজির শিকার হওয়াদের মধ্যে জসীমসহ মোট ৯২ জন ব্যবসায়ী অভিযোগটি করেছেন। পুরো এলাকায় সরকার দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে মোঃ লোকমান হোসেন নামের একজন। তার পিতার নাম মোঃ ইসমাইল হোসেন। বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন কড়িহাটি গ্রামে। তিনি কাওরানবাজার কিচেন মার্কেট চতুর্থ তলার ছাদে বসেন। তার বিশাল এক বাহিনী পুরো কাওরানবাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি প্রগতি ক্লাবের সহ-সভাপতি। অভিযোগে বলা হয়েছে, চাঁদাবাজির সূত্রধরেই ইতোপূর্বে ঢাকার ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক খালেক ও হানিফকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। খালেকের ভাতিজা মামুনকে মিরপুর শ্যাওড়াপাড়ার বাসায় গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি মোঃ শাহাদাৎ হোসেনের কাওরানবাজার কিচেন মার্কেটের দোকানের হামলা মামলা করে সর্বস্বান্ত করে দেয়। কাওরানবাজারে শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিকের নামেও চাঁদাবাজি চলে। অভিযোগে বলা হয়, সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে কাঁচামাল কাওরানবাজারে আসে। প্রতিদিন কাওরানবাজারে কমপক্ষে এক হাজার কাঁচামালের ট্রাক আসে। প্রতি ট্রাক থেকে পাঁচশ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। সে হিসেবে প্রতি রাতে কাওরানবাজারে শুধু কাঁচামালের ট্রাক থেকেই পাঁচ লাখ টাকা চাঁদায় করে চাঁদাবাজরা। আর প্রতিমাসে শুধু কাঁচামালের ট্রাক থেকেই দেড় কোটি টাকা চাঁদা তুলে চাঁদাবাজরা। পুরো কাওরানবাজার থেকে শুধু লোকমান বাহিনীই পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। যদিও বাস্তবচিত্র আরও বেশি। অভিযোগে যাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়েছে, তার একটি ফিরিস্তিও দেয়া হয়েছে। তাতে দোকান ভেদে ৫ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোঃ আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কাওরানবাজারে বহুদিন ধরেই চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। কাওরানবাজারে দুইটি গ্রুপ চাঁদাবাজি করত। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নোয়াখালী গ্রুপ। এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে লোকমান বাহিনী। লোকমান বাহিনী বহুদিন চাঁদাবাজি করেছে। বর্তমানে পুলিশী তৎপরতার কারণে তাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। কাওরানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করতে কাওরানবাজারে একটি পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হচ্ছে। আশা করছি আগামী সপ্তাহেই ফাঁড়ি চালু হবে। ইতোমধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য পুলিশ ফাঁড়ি বসানোর জন্য নামমাত্র মূল্যে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কাওরানবাজারের প্রগতি ক্লাবের দুইটি ফ্লোর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হচ্ছে। পুলিশ ফাঁড়ির উপরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অফিস থাকবে। কাওরানবাজার থেকে টুকরী বা ঝাঁকা নিয়ে মানুষের মালামাল বহনকারীদের পরিচয়পত্র প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব মানুষদের গায়ে নির্দিষ্ট কাপড় দিয়ে গাউন বানিয়ে তার উপর নম্বর দিয়ে দেয়া হবে। নতুন অনেক সময়ই দেখা যায়, জিনিসপত্র কিনে টুকরী দেয়ার পর ওইসব ব্যক্তি মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। কাওরানবাজারে টুকরীওয়ালাদের মধ্যে চোর সিন্ডিকেটের সদস্য আছে। তারা মালামাল নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। এজন্য কাওরানবাজারে যারা টুকরী নিয়ে ঘুরবেন, তাদের নামীয় তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাদের পরণে নির্ধারিত গাউন দেয়া হবে। তাদের গাউনের গায়ে নির্দিষ্ট নম্বর থাকবে। যে কেউ টুকরী নিয়ে আর মানুষের বাজার বহন করতে পারবে না। নাম তালিকাভুক্ত করার পরই টুকরী নিয়ে বাজার নিতে পারবে। এমন পদ্ধতি চালু করা হলে, দ্রুত কাওরানবাজার থেকে টুকরী চোর সিন্ডিকেট কমে যাবে। অভিযোগ মোতাবেক, চাঁদাবাজির শিকার হওয়া ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন, কাওরান বাজার ওয়াসা গলির হান্নান সাগর, বরিশাইল্লা সেলিম, শামীম, যুবলীগ নেতা ও ৩ নম্বর ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক জাফর, বল্লা সেলিম, লেয়াকত আলী, সুন্দর মোস্তফা, আজিজ, এরশাদ বিল্ডিংয়ের সামনের ব্যবসায়ী অলি, মোফাজ্জল মাঝি, তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাবেক ১ নম্বর ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি আব্দুর রশিদ কুট্টি, এরশাদ পার্কের সামনের রশিদ আড়ৎ, এরশাদ পার্কের সামনে মিষ্টি কুমড়ার আড়তের মিন্টু, দেলোয়ার মাস্টার, এরশাদ বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে আব্দুর রশিদ, পেঁপে পট্টির আড়তদার ইকবাল, এরশাদ বিল্ডিং হতে সিটি কর্পোরেশন অফিস পর্যন্ত দনিয়ার ও লেবুর বাজারের সব ব্যবসায়ী, নুরু জাহাঙ্গীরের আড়ত, যুবলীগ নেতা ছালামতের কাছ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিকের নামে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা, জাহাঙ্গীর, ওয়াসা বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পাশে নোয়াখালী বাস কাউন্টার থেকে প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা, ওয়াসা বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পাশে মিজানের ফুট থেকে মাসিক ২১ হাজার টাকা, রিপনের ফুট থেকে মাসিক ৩৩ হাজার টাকা, ওয়াসার সামনের চা দোকান থেকে মাসিক ১৫শ’ টাকা, আমের আড়ৎ, সিটি কর্পোরেশন অফিস ও পার্ক মার্কেটের মধ্যের গলির মাঝখান থেকে মাসিক ১৫ হাজার টাকা ছাড়াও কাওরানবাজারের এমন কোন দোকান নেই যেখান থেকে চাঁদা আদায় করা হয় না। চাঁদাবাজির বিষয়ে লোকমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
×