ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষাতকারে অমর্ত্য সেন

ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটছে

প্রকাশিত: ১১:৫২, ৮ অক্টোবর ২০১৯

 ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটছে

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রত্যাশা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে, গণতন্ত্র আলোচনার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় এবং আলোচনাকে আশঙ্কাগ্রস্ত করা হলে কোন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না, ভোটের সংখ্যার উল্লেখ কোন বিষয় নয়। -নিউইয়র্কার। অমর্ত্য সেন নিউইয়র্কারে সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন। সাক্ষাতকারে তার ছেলেবেলা, শিক্ষাজীবন, নোবেল পুরস্কার অর্জন, ভারতে ব্রিটিশ শাসন, স্বাধীনতাত্তোর ও বর্তমান ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও সর্বজনীন বুদ্ধিজীবী অমর্ত্য সেন বাস করছেন ক্যামব্রিজ হার্ভার্ড স্কয়ারের এক নির্জন প্রান্তে। সঙ্গে রয়েছেন তার স্ত্রী ঐতিহাসিক এমা রথসচাইল্ড। বাড়িটি সুপররিসরের হলেও টেবিলে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় সংবাদপত্র, সাময়িকী, অমর্ত্য সেনের লেখা বই। লিভিংরুমে দেখা যায় দেয়ালে টাঙ্গানো টেড টার্নার ও কফি আনানের ছবি ও দার্শনিক জন রাওলসের ও স্ত্রীর আঁকা বাওলস ও ডব্লিউভিও কুইনির চিত্রকর্ম। এবং প্রবেশ পথে টাঙ্গানো রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি। সাংবাদিক বলেন, দুপুরের খাবারের আগ পর্যন্ত তার সবজি বাগানে তার সঙ্গে কথা বলেছি কয়েক ঘণ্টা। তার বয়স এখন ৮৫ বছর এবং হাঁটেন তিনি ছড়ি হাতে সতর্কতার সঙ্গে নিঃশব্দচরণে। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে উদ্দাম হাসি এবং মানুষ ও আদর্শের জন্য এক বিস্ময়কর স্মরণশক্তি। ভারত ও এর শাসনতন্ত্র গত ৫ বছরে যে মোড় নিয়েছে সে বিষয়ে আপনি পৃথকভাবে কিছু ভাবছেন কি? উত্তরে সেন বলেন, আমার মনে হয়, এটা অত্যন্ত পশ্চাদৃষ্টির বিষয়। ভারতীয় সংবিধানিক পরিষদে বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে রচিত অত্যন্ত চমৎকার একটি শাসনতন্ত্র। আমি মনে করি, একটি প্রতিশ্রুতিশীল গণতন্ত্র হিসেবে এটি এমনই যে যদি কোন রাজনৈতিক গ্রুপ বা দল বা আন্দোলন বিশাল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে তা হলে তারা পরিস্থিতিকে খুব শীঘ্র নিজ উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারে যা ভারতে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনে ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে আমি মনে করি, ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট এ বিষয়ে খুবই শ্লথ ও বিভক্ত যদিও এ আদালত ভাল অবদানও রেখেছে তারপরও বলতে হয়, আদালত জনগণের অভিভাবক হিসেবে যতটা অবদান রাখতে পারত ততটা সমর্থ হয়নি। আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব দেখা যায় চরম হিন্দুত্ববাদের এবং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা সবাই হিন্দু। কিন্তু ১২ বছর আগে ২০০৭ সালের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন মুসলিম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শিখ এবং আইন পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন হিন্দু। কিন্তু তারা তাদের জীবনবোধ কারও ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু এখন হঠাৎ করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে গোমাংস খাওয়ার জন্য মুসলিমকে তাড়া করা হয় যা অত্যন্ত অসুন্দর। ভারতের স্বাধীনতা উত্তরকালে সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্র থেকে কোন বিচ্যুতিই ঘটেনি, ঘটেছে এমনকি হিন্দু ভারতে ঐতিহ্য উপলব্ধিতেও। অমর্ত্য সেন বলেন, এ প্রসেঙ্গ বলতে হয়, বাংলাদেশ এখন অনেক দিক থেকেই ভারতের চেয়ে বেশি সফল। ভারতীয়দের গড় আয়ুর চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল কম। কিন্তু তা এখন ৫ বছর বেড়েছে। ভারতের চেয়ে নারী শিক্ষার হার দেশটিতে বেশি। মোদির বহুধর্মীয়, বহুজাতিক ভারতের বিষয়ে কোন ব্যাপক দূরদৃষ্টি রাখেন না। তিনি ছেলেবেলা থেকে আরএসএস ও প্রচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি প্রাণবন্ত ও ব্যাপকভাবে সফল। তাই মোদি ফ্যাক্টর থেকেই যাচ্ছে। তাদের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। আমি অত্যন্ত বিস্মিত যে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কিভাবে তাদের প্রতি বিশাল দাতা বনে যায়, তারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়। নির্বাচনের সময় যে কোন দলের চেয়ে তাদের কাছে চাঁদা এসেছে প্রচুর। তারা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবারও ক্ষমতায় এসেছেন। হ্যাঁ, মোদির জনপ্রিয়তা রয়েছে ব্যাপক। দেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুমোদন রয়েছে তার ওপর। কিন্তু, তারপরও বিষয়টা স্পষ্ট নয়। ১শ’ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারত। এদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ২০ কোটি। ২০ কোটি দলিত জনসংখ্যা। এখানে ১০ কোটি মানুষ রয়েছে নৃগোষ্ঠীর। অমর্ত্য সেন অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হ্যাঁ, অবশ্য আমি বামপন্থী। আমার অবস্থান এখানে ভাল নয়। আমি কখনও মার্ক্সবাদী না হয়েও মাক্সীয় চিন্তা চেতনায় প্রভাবিত। আমি তার ১৮৪৪ সালের পা-ুলিপিগুলো পছন্দ করি। আমি জার্মান আদর্শ পছন্দ করি। আমি পছন্দ করি ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম। এবং একই সময়ে দরিদ্রদের জন্য আমার রয়েছে সহানুভূতি। আমি মনে করি, কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেয়ার রয়েছে সত্যিকারভাবে। অন্যদিকে আমি সবসময় রাজনৈতিক তত্ত্বের অনুপস্থিতিতে সবসময় মর্মাহত।
×