ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা ॥ জালিয়াত চক্রের ১৫ জন জড়িত

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা ॥ জালিয়াত চক্রের ১৫ জন জড়িত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির অপচেষ্টায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও শুদ্ধি অভিযান চলছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে এই জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে ১৫ জন জড়িত বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক বি. জে মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, দুটি তদন্ত কমিটির দেয়া প্রাথমিক তথ্যে সন্দেহভাজন ১৫ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যারা এনআইডির ডাটাবেজে ঢোকার অপচেষ্টায় চিহ্নিতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করেন। সোমবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য তুলে ধরেন। বলেন, এনআইডি জালিয়াতি বন্ধে যা যা দরকার, তার সবই করা হবে। যারা এখানে ঢোকার অপচেষ্টা করেছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের আইটি বিভাগ এই অপচেষ্টাকারীদের চিহ্নিত করেছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। তিনি বলেন, ফাঁদ পেতে একটি চক্রকে ধরতে সক্ষম হই। সামরিক বাহিনীতে যেটা এ্যামবুশ বলা হয়। ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নালকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়। এরপর অন্যদের চিহ্নত করা হয়েছে। এই সংখ্যাটা ১৫ জনের অধিক হবে না। যারা এই অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত, তাদের বেশিরভাগই ইসি থেকে আগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। তারা ইসির বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতেন। অতীতে এনআইডির কাজে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদেরও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধের কারণে ইসি থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছে যারা, তাদের তালিকা করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি, যাতে কোনভাবেই অস্থায়ী ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেয়া না হয়। ডেটা এন্টি অপারেটর হিসেবেও যাতে তারা নিয়োগ না পায় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চাকরিচ্যুতদের আমরা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। ইসির মূল সার্ভার সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। অনেকেই না জেনে বলছেন, ইসির সার্ভারে রোহিঙ্গা ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ইসির মূল সার্ভারে আগামী ২৪ জানুয়ারির আগে ঢোকার সুযোগ নেই। কেননা, আইন অনুযায়ী মূল সার্ভারে তথ্য সন্নিবেশ করার আগে ১ জানুয়ারি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর দাবি-আপত্তি নিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়। আর ২৪ জানুয়ারির পর আবারও যাচাই করে মূল সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই চলমান হালনাগাদে রোহিঙ্গারা টেম্পোরারি সার্ভারে ঢুকেছে। ৬১ জনের মতো চিহ্নিত করা হয়েছে উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অপচেষ্টা সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নাম পরিচয় বা এই চক্রের সঙ্গে কতজন জড়িত সে বিষয়ে এনআইডির মহাপরিচালক বিস্তারিত কিছু সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়নি। তবে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নাম বলতে চাই না। পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এর সঙ্গে কতজন জড়িত। তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে এই সংখ্যা ১৫ জনের বেশি না। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ৬১ জনের তালিকা পাওয়া গেছে যারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তারা কীভাবে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করল, কারা তাদের সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে উল্লেখ করেন। এনআইডির ডিজি সংবাদ সম্মেলনে আরও উল্লেখ করেন রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অপচেষ্টায় যিনি জড়িত হোন না কেন সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফৌজদারি মামলা কিংবা বিভাগীয় মামলাও করা হবে। ইসির কর্মকর্তাদের কারও বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে দুদকের সহযোগিতা নেয়া হবে। শুধু দুদক নয়, যে কোন সংস্থার কার্যক্রমকে স্বাগত জানাই। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়ে যাদেরই সম্পৃক্ততা পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি এবং তা অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে ইসি কর্মকর্তাদের বদলি করা হবে, যাতে তারা একই জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করতে না পারে। সেই সঙ্গে নিবন্ধন কর্মকর্তাদের পাসওয়ার্ড যাতে অন্যরা ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য কড়া নজরদারি করা হবে। যদি কেউ হস্তান্তর করে তাহলে সেই ব্যর্থতার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রবাসে যখন ভোটার করা হবে, তখনও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে আগে যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ রোহিঙ্গা আছেন কিনা, সেটাও দেখা হবে। সংবাদ সম্মেলনে ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে কেউ যাতে রোহিঙ্গাদের টেম্পোরারি সার্ভারেও যুক্ত করতে না পারেন, সেজন্য সব কর্মকর্তার পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সার্ভারে ঢোকার জন্য ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) মেসেজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসির এনআইডি উইংয়ের পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল বাতেন, ৫ সদস্যের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির প্রধান এনআইডি উইং পরিচালক খোরশেদ আলম, কারিগরি বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রধান এনআইডি পরিচালক ইকবাল হোসেন ও সদস্য এনআইডি উইংয়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাহাব উদ্দিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। অনুসন্ধান করবে দুদক ॥ চট্টগ্রাম অঞ্চল ও কক্সবাজার জেলায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ও বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদানের অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে দুদককে জানিয়েছে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। একই সঙ্গে বিষয়টি অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে দুদকের পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধানী টিম গঠন করবে সংস্থাটি। দুদক সূত্র জানায়, জালিয়াতি, প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের এনআইডি দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন ইসির কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পাবনায় কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ মুনীর হোসাইন খান ও চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ। লতিফ শেখ বর্তমানে পাবনার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় এনআইডি প্রজেক্টের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগর, একই শাখার সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে, চট্টগ্রামের পটিয়ার বড় উঠান ইউনিয়নের শাহানুর মিয়া, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী অপারেটর জনপ্রিয় বড়ুয়া ও চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন, মোঃ শাহিন, ফাহমিদা আকতার, পাভেল বড়ুয়া ও মোঃ জাহিদ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয়পত্রের বিষয়ে তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ও জেলা ইসি কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক টিম। ইসির সার্ভারে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সংরক্ষিত থাকার প্রমাণ এবং এ ঘটনায় জনপ্রতিনিধিসহ ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর অভিযান চালায় দুদক। দুদক জানায়, সম্প্রতি লাকী ওরফে বিবি নামে এক রোহিঙ্গা নারী জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে এসে পুলিশের হাতে আটক হয়। পরে তার স্মাটকার্ড পরীক্ষা করে ইসির সার্ভারে থাকা কোড নম্বরের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। দুদক আরও জানায়, ইসির দেয়া তথ্য অনুযায়ী কয়েক রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা ডাকাতও ছিল, সে কয়েকদিন আগে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এনআইডি পাওয়া রোহিঙ্গাদের তথ্য ঢাকা থেকে সার্ভারে সংযুক্ত করা হয়েছে। দুদকের অভিযানের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করে। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শিমুল শর্মা বাদী হয়ে জেলা সদর থানায় ভোটার তালিকায় ৬০০ রোহিঙ্গার নাম ওঠানোর অভিযোগে মামলা করেন। এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে জড়িত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, কর্মচারী বা অভিযুক্তদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এখনও কোন কমিটি গঠন না করলেও অতিদ্রুত একটি অনুসন্ধানী টিম গঠন করে অভিযোগটি তদন্ত করতে মাঠে নামবে দুদক টিম।
×