ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তা জোরদারের সুপারিশ গোয়েন্দা সংস্থার

জঙ্গীদের প্রিজন ভ্যানে আদালতে আনা-নেয়ার সময় হামলার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ১০:০০, ৩১ আগস্ট ২০১৯

জঙ্গীদের প্রিজন ভ্যানে আদালতে আনা-নেয়ার সময় হামলার আশঙ্কা

শংকর কুমার দে ॥ দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে আটক জঙ্গীদের প্রিজনভ্যানে আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে জঙ্গী হামলা ও নাশকতা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কারাগার থেকে আদালতে প্রিজনভ্যানে জঙ্গী আনা-নেয়ার বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। নিরাপত্তা জোরদার ও সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গী সংগঠনগুলোর গা ঢাকা দেয়া জঙ্গীরা গোপনে সংগঠিত হয়ে নাশকতা ও জঙ্গী হামলার ছক কষছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সারাদেশের কারাগারগুলোতে আটক আছে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সহস্রাধিক জঙ্গী। কারাগারে আটক আছে জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আল্লাহর দলসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা। এসব জঙ্গীদের মধ্যে আছে ভয়ঙ্কর, দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ও সুইসাইড স্কোয়াডের জঙ্গী সদস্য। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের অনেকেই বছরের পর বছর ধরে কারাগারে আটক আছে। কারাগারে বসেই জঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে শলাপরামর্শ এবং বাইরে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এতে যে কোন সময়ে জঙ্গী ছিনিয়ে নেয়ার মতো নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘আল্লাহর দল’ নামের জঙ্গী সংগঠনের চার সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। আটক জঙ্গীরা হলেন সিরাজুল ইসলাম (৩৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪০), এসএম হাফিজুর রহমান সাগর (৪৫) ও মোঃ শফিউল মোযনাবীন তুরিন (২৭)। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পেনড্রাইভ, ১২টি মোবাইল ফোন, আল্লাহর দল সংগঠনের লিফলেট, দাওয়াতপত্র ও আয়-ব্যয়ের হিসাবের একটি টালি খাতা উদ্ধার করা হয়। আটক জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের পর র‌্যাব জানায়, জঙ্গীরা সংগঠনটির যাবতীয় আর্থিক মূলধনের একটি বড় অংশ নামে-বেনামে দেশের কয়েকটি ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে। আটক জঙ্গীদের ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা অর্থ দিয়ে দেশে নাশকতা সৃষ্টি ও সরকার উৎখাতের কাজে এগুলো ব্যয় করার পরিকল্পনা ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশকে টার্গেট করে বোমা হামলা এবং পল্টন ও খামারবাড়ি পুলিশ বক্সের সামনে থেকে দুটি বোমা উদ্ধার করার ঘটনা জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরাই সংগঠিত করেছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। অথচ এই চারটি জঙ্গী হামলা ও হামলার চেষ্টার ঘটনায় কোন জঙ্গী সদস্যই গ্রেফতার হয়নি। পলাতক এসব জঙ্গীরা যে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাবে না এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। রাজধানীর গুলিস্তান, মালিবাগ, পল্টন, খামারবাড়ি- এই চারটি বোমা হামলা ও পুঁতে রাখার ঘটনারই টার্গেট করা হয়েছিল পুলিশকে। পুলিশকে টার্গেট করা ঘটনাগুলো কে বা কারা কি উদ্দেশ্যে ঘটিয়েছে তা উদ্ঘাটন করতে না পারার কারণ জঙ্গী হামলার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার আসামি মামুনুর রশিদ রিপন। তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায়, ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে যেভাবে জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানো হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় আরও জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করছে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীরা। এমনকি গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটিয়ে দেশ-বিদেশে যেভাবে আলোড়ন তুলে আলোচনায় এসেছিল, ঠিক তেমনিভাবে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আটক জঙ্গীদের কারাগারে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনিয়ে নিয়ে আবারও দেশ-বিদেশে আলোচনায় এসে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে জঙ্গীগোষ্ঠী। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামিদের কারাগার থেকে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনাও করেছিল জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। জঙ্গী হামলা ও নাশকতার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিপন নামের যেই জঙ্গী আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে আটক জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করার জবানবন্দী দিয়েছে সে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাই আওয়ালের ভাগ্নে। এ জন্য রিপন নামের জঙ্গী সদস্যটির গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে জঙ্গী সংগঠনটিতে। জেএমবির এই অংশের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রিপন। গুলশান হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের জন্য ভারতে আত্মগোপনে চলে যায় রিপন। সে জেএমবিকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ফের বাংলাদেশে আসে। সম্প্রতি তারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রিপনের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এই দুর্ধর্ষ জঙ্গী সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানায়, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী ও পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ত্রিশাল জঙ্গী ছিনতাইয়ের মতোই জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সে নিজেও পরিকল্পনাকারী জঙ্গীরা ধরা পড়ে যায়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে তিন জঙ্গীকে ময়মনসিংহ আদালতে অন্য মামলায় হাজিরা দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় গুলি ও বোমা ফাটিয়ে তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয় হামলাকারী জঙ্গীরা। তিন জঙ্গীর মধ্যে ছিলেন মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন সালেহীন ও যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ পাওয়া বোমারু মিজান। ঘটনার দিন বিকেলে টাঙ্গাইলের সখীপুরে পুলিশের চৌকিতে ধরা পড়ে রাকিব হাসান। রাতে তাকে নিয়ে পুলিশ অভিযানে বের হলে বন্দুকযুদ্ধে রাকিব নিহত হয়। ওই জঙ্গী ছিনতাই করার জন্য জঙ্গীরা যে হামলা করে তাতে প্রিজনভ্যানে কর্তব্যরত পুলিশ নিহত ও আহত হয়। এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনতাই করে নেয়া জঙ্গী সালাউদ্দিন সালেহীন। যাবজ্জীবন কারাদ- মাথায় নিয়ে সালাউদ্দিন সালেহীন আত্মগোপনে থেকে জঙ্গী সংগঠনকে সংগঠিত করার তৎপরতা চালাচ্ছে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। দীর্ঘ পাঁচ বছরেও ধরা পড়েনি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে প্রিজনভ্যান থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আকুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) দুর্ধর্ষ তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার এক জঙ্গী সালেহীন। এ ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও ঘটনার মূল হোতা বর্তমানে নব্য জেএমবির আমির সালেহীন এখনও ধরা পড়েনি। সালেহীন এখন ভারতে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। পলাতক সালেহীন শুধু বাংলাদেশেই নয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে থেকেও নাশকতাসহ জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন নব্য জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (নিউ জেএমবি) চার সদস্যকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে ভারতের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইসলামী স্টেট (আইএস) অনুপ্রাণিত ভারতের শিয়ালদহ স্টেশনের পার্কিং এলাকায় মহসিন ও মামুনুরকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া হাওড়া স্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আলামিন ও রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের কাছ থেকে ভিডিওসহ আইএস মতাদর্শের বেশ কিছু আলামত জব্দ করেছে। গ্রেফতারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে জেএমবির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে থাকলে গ্রেফতারের সম্ভাবনা থাকায় তারা ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে থেকেই বাংলাদেশে জঙ্গী কর্মকা- চালানোর ছক কষছিল বলে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষের দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার মতো একই কায়দায় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী আটক জঙ্গীদের আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছে আটক জঙ্গীরা।
×