ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এবারের আগস্টের দাবি তদন্ত কমিশন

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 এবারের আগস্টের দাবি তদন্ত কমিশন

অতঃপর, বাঙালী জাতি আরেকটি আগস্ট মাস পার করতে চলেছে এবং লেখাটিও ছাপা হবে মাসের শেষদিন ৩১ আগস্ট। এ মাসে আমরা অনেক শোকসভা করেছি, জাতির পিতাসহ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে পরওয়ার দেগারে আলমের কাছে দোয়া করেছি। বনানী এবং টুঙ্গিপাড়ায় শায়িতদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছি- আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, অ-ইন্না ইনশাল্লাহু বিকুম লাহেকুন [হে কবরবাসী আপনাদের ওপর আল্লাহপাকের শান্তি বর্ষিত হোক,(আপনারা ঘাবড়াবেন না) নিশ্চয়ই আল্লাহ চাহে তো আমরাও অচিরেই আপনাদের সঙ্গে মিলিত হব...] এবং এই আগস্টের পর হয়ত আবার শোক পালন করব এক বছর পর। কতজন এই সুযোগ পাব জানি না। আমরা সুযোগ পাই বা না পাই আগত এবং অনাগত ভবিষ্যতের- আমাদের জন্যে আমাদের অনাগত সন্তানদের জন্যে একটি অসিয়ত অন্তত রেখে যেতে চাই, হে আগত সন্তানেরা হে অনাগত সন্তানেরা হে পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্ররা হে পুত্রী-পৌত্রী-প্রপৌত্রীরা তোমরা আমাদের পাপ মোচন করে দিও ॥ জাতির পিতাকে রক্ষার দায় ছিল বঙ্গমাতাকে রক্ষার দায় ছিল তখন ঘুম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না নৈশপ্রহরি ঘুমোতে পারে না এটা তার চাকরির শর্ত তবু কেনো ঘুমোলো এ প্রশ্নের জবাব কেউ দেয়নি কেউ কি আছো জবাব দেবার? প্রিয় সন্তানেরা শোনো, প্রিয় প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের তরুণ যুবারা শোনো, বাংলার মুক্ত স্বাধীন নারীরা শোনো, আজি হতে শতবর্ষ পরে আজি হতে হাজার বর্ষ পরে যখন দেখা হবে আবার টুঙ্গিপাড়ায় আমরা জবাব চাইব, আমরা তোমাদের শেকলবন্দী থেকে মুক্ত করেছি আমরা তোমাদের অবরোধবাসিনী থেকে মুক্ত করেছি মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়তে শিখিয়েছি, আমাদের যারা হত্যা করেছিল আমাদের পিতাকে যারা হত্যা করেছিল আমাদের মাকে যারা হত্যা করেছিল আমাদের ছোট্ট ভাইটিকে যারা হত্যা করেছিল সেই হত্যাকারী শাপদের দল কি এখনো মুজিবের বাংলায় ঘুরে বেড়ায়? শেখ রাসেলের বাংলায় ঘুরে বেড়ায়? ঘুরে বেড়ায় কি নজরুল-রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলাদেশে তিতুমীর-সিরাজের বাংলায় নেতাজী-শেরে বাংলা- ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর বাংলায় মানিক-সালাম-জহুর-আক্রাম খাঁর বাংলায় এখনো কি ঘুরে বেড়ায় ৩০ লাখ শহীদ ৫ লক্ষাধিক নির্যাতিত মা-বোনের বাংলায় এখনো কি ঘুরে বেড়ায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত সুফিয়া কামাল-শেখ হাসিনা-প্রীতিলতার বাংলায় ঘুরে বেড়ায় কী? মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার বাংলায় এখনো কী শাপদেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে? পড়ে কি প্রজন্মের সাথীরা? এমনি হাজারও প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আমাদের। পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্রনেতাকে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে কেবল তাদেরই হত্যা করা হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়নি। Father of Democracy আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম লিংকন, জনএফ কেনেডি, কালো আফ্রিকার মানুষের প্রিয় নেতা মার্টিন লুথার কিং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, মিসেস ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বা ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চিলির ড. আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নো, মিয়ানমারের জেনারেল অং সান (বর্তমান আউন সান সুচির বাবা), শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক, মিসরের আনোয়ার সাদাত, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, এমনি বিশ্বমানের নেতাদের হত্যা করা হয়েছে- যা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। কিন্তু ঐসব হত্যাকান্ডে তাদের পরিবার-পরিজন তথা স্ত্রী-পুত্র-কন্যার গায়ে হাত দেয়নি। কিন্তু কেনো খুনীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোটা পরিবারকে হত্যা করল। এমনকি ছোট্ট রাসেলকেও হত্যা করল ? কেনো, কেনো? এসব কেনোর উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে এসেছে তা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মানবপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা এবং একই সঙ্গে গরিব-দুঃখী মানুষের বন্ধু বিশ্বে আগে কখনও জন্মায়নি- এ কথাটি হত্যাকারীরা জানত বলেই পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। তারা বুঝতে পেরেছিল এই নেতার এক ফোঁটা রক্তও যদি বেঁচে থাকে তাহলে প্রতিশোধ তো নেবেই এবং সে প্রতিশোধ কেবল হত্যার বদলে হত্যা নয় বরং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর খুনীদের এবং তাদের পেছনের কুশীলবদের তামাম অপচেষ্টা চিরতরে নিঃশেষ করে দেবে। তাই তো খুনীরা একে একে সবাইকে হত্যা করল। সে রাতের কল্পকাহিনী, খুনীরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আক্রমণ করলে জাতির পিতা বেরিয়ে এলেন... স্টপ ফায়ারিং তার চিরাচরিত দরাজ গলা বজ্রকণ্ঠ কি চাও তোমরা? খুনী হুদা স্টেনগান উঁচিয়ে ফায়ার করতে এগিয়ে গেল সিঁড়ির গোড়ায় মহানায়কের সামনে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে স্টেনগান পড়ে গিয়েছিল পেছন থেকে হাবিলদার মুসলেম উদ্দিন স্টেনগান তুলে নিল চোখ বন্ধ করে ফায়ার করল সেই বিশাল বক্ষ ৫৬ হাজার বর্গমাইল গোটা পাকিস্তানী মিলিটারিও গুলি চালাতে সাহস পায়নি সামান্য এক সিপাই গুলি চালাল হয়ত সেও পাকি-মিলিটারির অবৈধ বঙ্গসন্তান বলেই রাজাকার গোলাম আযম-নিজামীদের সন্তান বলেই বিশ্বমোড়ল আমেরিকার His masters Servant বলেই হয়তো পাকি– প্রেতাত্মা বলেই॥ ছোট্ট শেখ রাসেল বলেছিল আমি মায়ের কাছে যাব আমি এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাব আর কখনো ফিরে আসবো না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো আমি মায়ের কাছে যাব ব্রুটাসের দল তাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেল মায়ের কোলে দিয়ে একসঙ্গে বঙ্গমাতা বাংলার স্নেহময়ী মা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একসঙ্গে গুলি চালালো তখন কী বাংলার গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার মসজিদ কেঁপে উঠেছিল কী মন্দির-প্যাগোডা-গীর্জা কেঁপে উঠেছিল কী অলি-আওলিয়ার দরবার গুলি চালালো শেখ কামাল-সুলতানা কামাল শেখ জামাল-রোজি জামাল শেখ নাসেরের বুকে সেই রক্তধারা দোতালার সিঁড়ি বেয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে মিশে গড়াতে গড়াতে বাংলার-খাল-বিল-নদী-জল ফসলের মাঠ গৃহিণীর আঙিনা উর্বর করে তুলেছিল ॥ বাংলায় তখনো মানুষ ঘুমে। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো শান্তির বাণী ‘হাইও আলাস সালাহ হাইও আলাস সালাহ’ নামাজের জন্যে জাগো মুক্তির জন্যে জাগো, ওরা খুনী ওরা রাজাকার সন্তান ওরা আলবদর সন্তান ওরা আলশামস সন্তান ওরা আযান বুঝে না ওরা শান্তি বুঝে না তাই তো মসজিদে যায় না ওরা যায় নামাজের বদলে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় বিনাশী ট্রিগার দাবায় ॥ দুই কন্যা শেখ হাসিনা শেখ রেহানা বেঁচে যান বিদেশে ছিলেন বেঁচে আছেন বলেই আজ ক্ষেতে ধান হয় সোনালী ধান জাতির পিতার সোনার বাংলা ॥ খুনীরা জানতো বঙ্গবন্ধুর এক ফোঁটা রক্ত বিশ্ব কাঁপিয়ে তুলবে মানবতার জয়গান গাইবে জাতির পিতার গরীব দুঃখী মানুষের কথা বলবে বাংলা অ-বাংলা যে যেখানে ॥ শত ঝুঁকির মধ্যেও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ালেন কেবল সেই এক ফোঁটা রক্তই উচ্চারণ করতে পারলো They are also humanbeing Starving Children are crying Elderly women are dieing we cant keep eyes closed. যে কারণে শেখ হাসিনার ওপর অন্তত ২১ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে এবং আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে আছেন এবং জাতির সেবা করে চলেছেন। বেঁচে আছেন বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলো, জেলহত্যার বিচার হলো, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো, বিচার হলো ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর গ্রেনেড হামলার... সব হত্যা একইসূত্রে গাঁথা... কিন্তু নেপথ্যের কুশীলবরা আজো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। নেপথ্যের চক্রান্তকারীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক এবং মিলিটারি জিয়াকে আমরা চিনি। আর কাউকে চিনি না। তাই তো প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক কি একাই ছিল? না-কি তার সাথে আরও আরও নেতা ছিল? তারা কারা? চক্রান্তকারী মিলিটারিদের মধ্যে জিয়া কি একাই ছিল? না-কি তার সাথে আরও আরও মিলিটারি জড়িত ছিল? তারা কারা? ক্যান্টনমেন্টে বসে জিয়া চক্রান্ত করেছেন, খালেদা জিয়া তখন কোথায় ছিলেন? তিনি কি কিছুই জানতেন না? জানলে কি কি জানতেন? কিংবা কারা কারা তখন তার বাড়ি আসা-যাওয়া করতেন? তারাই বা কারা? কি তাদের পরিচয়? খালেদা জিয়া কেনো এসব বঙ্গবন্ধুকে জানালেন না? স্বাধীনতার পর জিয়া যখন তাকে ঘরে তুলছিলেন না, জনশ্রুতি হলো যুদ্ধের ৯ মাস ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানের কারণে, তখন তিনি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে বঙ্গমাতার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে জিয়াকে ৩২ নম্বরে ডেকে পাঠান এবং খালেদাকে কন্যা বলে জিয়ার গাড়িতে তুলে দেন। এর থেকে এটা আশা করা কি অন্যায় হবে যে, খালেদা জিয়া যা যা জানতেন বঙ্গবন্ধুকে অথবা বঙ্গমাতাকে জানানো কি তার উচিত ছিল না? জানাবেন কি তিনি তো ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে কেক কাটতেন ১৫ আগস্ট। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পুরো চক্রান্ত হয় তার ছেলে তারেকসহ অনেকেই তখন হাওয়া ভবনে ছিলেন কি-না? থাকলে কারা কারা ছিলেন? কিংবা কার নির্দেশে পুলিশ হামলাকারীদের না ধরে হতাহতদের উদ্ধারে নিয়োজিত দলীয় কর্মীদের ওপর কেনো পুলিশ ব্যাপক টিয়ার শেলিং করল? কেনোই বা খালেদা জিয়ারা পার্লামেন্টে বললেন- শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তা বিস্ফোরিত হয়েছিল? আনন্দে টেবিল চাপড়ালেন, কেনোইবা খালেদা জিয়া এক বিচারপতিকে দিয়ে ওয়ানম্যান তদন্ত কমিশন করে তাকে দিয়ে বলালেন, এটি বিদেশের কাজ- ইঙ্গিতটা ভারতের দিকে। কেনোইবা জজ মিয়া নাটক সাজালেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। বিদেশের কারা কারা এই বর্বর হত্যাকা-ের সাথে জড়িত ছিল? কেনোইবা ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাস ঐ রাতে খোলা ছিল এবং তখন কারা কারা ছিল এবং কি করেছিল তারা? কেনোইবা হেনরি কিসিঞ্জার (তৎকালীন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বললেন, ঞযব বসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয রং সু ঢ়বৎংড়হধষ ফবভবধঃ এ কথা বলে তিনি কি চুপ ছিলেন? তাছাড়া কারা বা কোন্ সাংবাদিক সে রাতে ঘটনা ঘটার প্রায় ১৫ মিনিট আগে একটি বিদেশী নিউজ এজেন্সিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর প্রচার করেছিল। তবে কি তারা আগেই জানত বা খবরটি আগেই তৈরি করে রেখেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। হয় পার্লামেন্টের স্পীকার নয়তো রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এই কমিশন গঠনের প্রস্তাব উঠেছে। ধন্যবাদ মাননীয় আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হককে তিনি সম্প্রতি প্রেসক্লাবের এক সেমিনারে প্রস্তাবিত তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এবং কে কমিশনের প্রধান হবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে ঠিক করবেন। ঢাকা-৩০ আগস্ট, ২০১৯ লেখক : সংসদ সদস্য ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম [email protected]
×