ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শফিউল বশর ভাণ্ডারী একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিরবিদায়

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ৪ আগস্ট ২০১৯

শফিউল বশর ভাণ্ডারী একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিরবিদায়

চলে গেলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক শফিউল বশর ভান্ডারী। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে হার মানলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভায় এই সৈনিক। গত সোমবার বিকেলে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রাজনীতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ১৯৬৭ সালের চট্টগ্রামের সরকারী মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বের হাতেখড়ি তার। এক সময় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭০-এ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের এক অনন্য অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রামে আইন পেশায়, পরে কর্মক্ষেত্র ঢাকায় স্থানান্তর করেন। পাশাপাশি কুমিল্লা জেলার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন দাউদকান্দির এই কৃতী সন্তান। মৃত্যুর আগে কুমিল্লা জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল। আমি রাজনৈতিক কর্মী নই। কিন্তু এলাকার সন্তান এবং একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তাকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। কাকা বলে ডাকতাম। ঢাকায় আসার পর লোকাল অভিভাবক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন আমার অনেকটা তাই। ১৯৯৬ সালের দিকে আমি আর তফাজ্জল প্রায়ই উনার আরামবাগের বাসায় যেতাম। আমাদের তিনি ‘আব্বা’ বলে ডাকতেন। পরে তার কাঁটাবনের বাসা এবং চেম্বারে প্রায়ই আমাদের যাতায়াত ছিল। মিডিয়া সংক্রান্ত কোন বিষয় হলেই তিনি আমাকে জানাতেন। ভান্ডারী কাকাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি, যা এক লেখায় শেষ করা যাবে না। কিছু স্মৃতি আজ তুলে ধরছি- ২০০৩ সালের কথা। ক্ষমতায় তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। রাজনৈতিক এক অস্থিরতায় দেশ। তেমনি এক সময়ে ভান্ডারী কাকার মা মারা যান। দুই দিন পর কাকার বাসায় যাই আমি। শোকার্ত পরিবেশেই কাকাকে বললাম মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কি শোকবাণী দিয়েছেন? বললেন না, হয়তো জানেন না। আমি তখন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রার সহ-সম্পাদক। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আমার অফিস। আমাদের অফিসের পাশেই একটি রুমে বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রেস সেক্রেটারি বসতেন। একদিন পরই বেবী আপার মাধ্যমে নেত্রীর প্যাডে একটা শোকবাণী এনে দিলাম। হাতে পেয়ে ভান্ডরী কাকা কেঁদে ফেললেন, বললেন আমার নেত্রী আমার মায়ের জন্য শোকবাণী দিয়েছেন। ঐদিনের তার আকুতি আর শ্রদ্ধার স্মৃতিটুকু আজও চোখে ভাসে। আমার বাবা মারা যান ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দুদিন পর ভান্ডারী কাকাকে জানাই। তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, বাবা নেই তো কি হয়েছে, আজ থেকে তুই আমাকে বাবা বলে ডাকবি। ভালোবাসার রকমফের হয় কিন্তু এই ভালোবাসার তুলনা হয় না। এটা শোকের মাস। আর ক’দিন পরই জাতীয় শোক দিবস। সেই ছোটকাল থেকে দেখেছি জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকীর দিনটি তার নিজ গ্রামে কুলখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতেন- যার ব্যত্যয় কখনো দেখিনি। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি ভান্ডারী কাকার শ্রদ্ধার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কয়েক বছর আগে কেরানীগঞ্জের অদূরে পদ্মা পাড়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিমানবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে যে আন্দোলন হয়েছিল, ভান্ডারী কাকা ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। এ নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনও হয়। একজন সাংবাদিক হিসেবে হল ভাড়া, প্রেস রিলিজ তৈরি এবং সাংবাকিদের উপস্থিতির সমন্বয়ের দায়িত্ব আমাকে তিনি দিয়েছিলেন। যদিও সরকার বিমান বন্দরের স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। ভান্ডারী কাকা ছিলেন পরোপকারী। একজন আইনজীবী হিসেবে দাউদকান্দি, তিতাস এবং মেঘনার বহু নেতা-কর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জাতীয় পর্যায়েও বহু নেতাকর্মীর মামলা তিনি পরিচালনা করতেন। রাজনীতি ও আইন পেশা তিনি সমানভাবে সামাল দিতেন। মাঝে মাঝে ভাবতাম তার কোনটা মূল রাজনীতি না আইন পেশা! তার সঙ্গে কোন আলোচনায়ই রাজনীতিটা বাদ যেত না। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার স্মৃতিগুলো আমার কাছে রয়ে যাবে আমৃত্যু। ॥ দুই ॥ চট্টগ্রামের মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালেই রাজনীতির সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ছাত্রলীগের একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ঐতিহাসিক ৬ দফার পক্ষে। আন্দোলন আর বিপ্লবের সূতিকাগার চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদ জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএ আজিজ, মৌলভী সৈয়দ আহমদ এবং সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন খুব অল্প সময়েই। সহযোগী কর্মী হিসেবে পান এনামুল হক চৌধুরী, ইউনুস, অমল, হারুন, ফজলু, জাফর এবং দানুর মতো ত্যাগী কর্মীদের। যারা প্রত্যেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শফিউল বশর ভা-ারীর এক অনন্য অধ্যায়। ১৯৭১ সালে যে প্রতিরোধ বাঙালী গড়ে তুলেছিলেন সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। ১৯৭১ সালে ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে উপেক্ষা করে অধিবেশন মুলতবি করেন- সে দিনই এম.আর সিদ্দিকীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে লাখো মানুষের সামনে তিনি এবং তার সহকর্মীরা পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। একই দিন তারা কয়েকজন মিলে আন্দারকিল্লার অস্ত্রের দোকানে অস্ত্র লুট করে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পুঁজি গড়ে তোলেন। ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে প্রতিরোধের পর শফিউল বশর ভা-ারী রামগড় হয়ে পরে হরিণাকু- ক্যাম্পে যান। মুজিব বাহিনী গঠিত হলে, সেই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের সদস্য হিসেবে ভারতের সামরিক একাডেমি দেরাদুনের তামুন্ডায় ট্রেনিং গ্রহণ করেন। পরে শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও মৌলভী সৈয়দ আহম্মদের নেতৃত্বে বিএলএফের দুর্ধর্ষ কমান্ডো হিসেবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিলÑ অপারেশন হালি শহরের পাওয়ার পাইলন। দিনটি ছিল ৩ আগস্ট ১৯৭১। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক অঞ্চল ঢাকা ট্যাঙ্ক রোডে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় স্টিল মিলের বিদ্যুত সরবরাহ হতো হালিশহর থেকে। হাই কমান্ডের নির্দেশে তারা কয়েকজন এই পাওয়ার লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন, যা পাকবাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এরপর পাঁচলাইশ থানার পাশে তেল ও গ্যাস অফিস থেকে ওয়্যারলেস সেট লুট। অত্যন্ত ঝুঁকির এই অপারেশনটি ছিল পাকবাহিনীকে চমক দেখানোর মতো, যা চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক ডাকাতি করে ৫০ হাজার টাকা লুট করেছিলেন। তার যুদ্ধ জীবনের শেষ অধ্যায় ছিল ১ নবেম্বর ১৯৭১। অস্ত্র হাতে তার শেষ দিন। আর্থিক সঙ্কট মুক্তিযোদ্ধাদের কাটছিল না। তাদের কাছে সংবাদ এলো এদিন চট্টগ্রামে কাস্টম হাউস স্টাফদের বেতনের অনেক টাকা একটি মাইক্রোতে নিয়ে আসা হবে। হাই কমান্ডের নির্দেশ সিদ্ধান্ত ওই টাকা লুট করতে হবে। অপারেশনে শফিউল বশর, রফিক আহম্মদ (শহীদ), অমল মিত্র, ফজলুল হক ভুঁইয়া, ড্রাইভার ভোলানাথ নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের কাছে তথ্যটি সঠিক ছিল না। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল এই অপারেশন যখন হলো না তখন অন্য কিছু একটা করে ক্যাম্পে ফিরবে। জুবলী রোড ঘুরে নিউমার্কেট মোড়ে এসে তারা দেখতে পায় একজন পাক আর্মি অফিসার সিটি কলেজ মোড়ে আইডিয়াল বুক স্টলে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। অফিসারটির কোমরে একটি রিভলবার ঝুলছে। তারা সিদ্ধান্ত নিল- অফিসারটিকে ঘায়েল করে রিভলবারটি সংগ্রহ করার। এদিক সেদিক ঘুরে গাড়িটা টার্গেটের ৫০ গজ দূরে রেখে গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে রফিক পরে শফিউল বশর অফিসারটির কাছে যায় এবং তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ি। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে রিভলবারটি নিয়ে নেয় বশর। এমন সময় রাস্তার পূর্ব পাশে দাঁড়ানো পাক আর্মির জীপ থেকে ফায়ারিং ওপেন করে, সঙ্গে সঙ্গে বশর লুটিয়ে পড়ে। বশরের ডান পায়ে বুলেট ঢুকেছে তবুও রফিক আর সে গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে কোনমতে গাড়িতে উঠতে সক্ষম হয়। সিটি কলেজের দিকে গাড়ি চলছে। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছে ভোলানাথ। রক্ত ঝরছে। আর্মির জীপটি তাদের অনুসরণ করে আসছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে নেভীর একটি জীপও। ওই গাড়িগুলো থেকে গুলি ছুড়ছে। একটি গুলি এসে লাগে ভোলানাথের গায়ে। ভোলানাথ আর গাড়ি চালাতে পারছিল না। গাড়ি আইস ফ্যাক্টরির একটি চুনের দোকানের সামনে এসে থেমে যায়। ভোলানাথ কৌশলে লাফিয়ে সামনের গলিতে পালিয়ে যায়। ফজলুল হক পাক আর্মির জীপ লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। গুলিবিদ্ধ পা নিয়েই বশর, রফিক, অমল ও ফজলু নেমে পড়ে। অমল পার্শ্ববর্তী ড্রেনে লাফিয়ে পড়ে সরে যেতে সক্ষম হয়। ফজলু ও বশর গুলি ছুড়তে থাকে। ফজলুও এক সময় নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে। রফিক বুলেটবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। বশর তখনও জ্ঞান হারাননি, কিন্তু গুলিবিদ্ধ পা নিয়ে এগুতে পারছিলেন না। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে দেখে বশর রিভলবার ড্রেনে ফেলে রক্তাক্ত শার্ট খুলে ১০০ গজ দূরে একটি খালি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্যান্টের পকেটে একটি চিঠি ছিলÑ চিঠিটা বশরের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় বহন করে তাই সেটা কোথাও না ফেলে সে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন। পাক আর্মিরা বাড়িতে ঢুকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বশরকে আঘাত করতে করতে সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। তখনও গুলিবিদ্ধ পা থেকে রক্ত ঝরছে। এক কর্নেল বেশ কয়েকবার বুটের লাথি মেরে জানতে চায় সঙ্গী যোদ্ধাদের নাম। এক সময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে সার্বক্ষণিক পাক সেনারা তাকে নজরে রাখত। একটু সুস্থ দেখলেই তারা কাছে এসে বলত সঙ্গীর কথা, তাদের ঠিকানা বলার জন্য। তারা মানসিক নির্যাতনও করত। তাদের বহু অত্যাচারের পরও বশর মুখ খুলেননি। হাসপাতালে তাকে যে মহত্ত্ব দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে দ্রুত সারিয়ে তোলেন তিনি হলেন মেডিক্যালের সেবিকা পান্না দাস। ১৮ দিন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে থাকার পর পাক আর্মিরা তাকে মিলিটারি কমবাইন্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেও তার উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও বেশি অত্যাচার শুরু হয়। এক সময় ইলেক্ট্রটিক শকও দেয়। পরে তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠায়। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে আবার চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠায়। হাসপাতালে থাকাকালেই প্রিয় মাতৃভূমি মুক্ত হয়। পান্না দাসই তাকে বিজয়ের প্রতীক্ষিত কথা শোনায়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশের মাটিতে পা রাখলেন। এর আগেই সরকারী একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে বশরসহ কয়েকজনকে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সেও একজন। বশরের স্মৃতিচারণ- ‘একদিন বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে আসলেন আমাদের দেখতে। আমার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। মাথায় হাত রেখে বললেন এখন কেমন আছ। আমি কিছুই বলতে পারিনি শুধু কেঁদেছিলাম, তারপর বঙ্গবন্ধু আমাদের বেশ কয়েকজনকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য পোল্যান্ড পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পোল্যান্ড থেকে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে দেশে আসি। আবার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করি।’ চট্টগ্রাম মেডিক্যালে যে পান্না দাসের সেবা তার জীবন বাঁচিয়েছে, ভালবাসায় সিক্ত করেছে সে পান্না দাসকেই পরে সহধর্মিণী করেন তিনি। মৃত্যুকালে স্ত্রী এক ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে যান। সন্তান সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং দেশে বিদেশে উচ্চ পদে কর্মরত। আমরা যখন যেতাম প্রায়শই নিজের পরিবার নিয়ে কথা বলতেন। বলতেন, ‘আমার সন্তান, স্ত্রী আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। আমার সন্তানদের গর্ব তারা একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার স্ত্রীর গর্ব এবং অহঙ্কার একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে সে বিয়ে করেছে।’ বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে তার পরামর্শ ছিল- ‘তোমরা দেশের ইতিহাস জান- কে দেশপ্রেমিক, কে দেশ বিরোধী, তাদের চিনতে চেষ্টা কর। তোমরা সঠিক ইতিহাসকেই জানতে চেষ্টা কর। নিজেকে গড়, দেশকে স্বাধীনতার আলোকে গড়তে চেষ্টা কর। তা হলেই ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তার ছিল অশেষ শ্রদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের বিধানকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্ব্বোচ্চ সম্মান বলে মনে করতেন। এই বিধানটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা করেছেন বলেই সম্ভব হয়েছে বলে মনে করতেন তিনি। তিনি আজ রাষ্ট্রীয় সন্মানে সমাহিত হলেন দাউদকান্দির নিজ গ্রাম ভাগলপুরের পারিবারিক কবর স্থানে। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। -প্রায় দেড় দশক আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে শফিউল বশর ভান্ডারীর একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। সেই আলোকেই একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার মূল্যায়নে তথ্যগুলো এই লেখায় উপস্থাপন। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×