ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা ঋণে সতর্কতা ॥ ফাঁদে পড়ার শঙ্কা নেই

প্রকাশিত: ১০:১৮, ৮ জুলাই ২০১৯

চীনা ঋণে সতর্কতা ॥ ফাঁদে পড়ার শঙ্কা  নেই

কাওসার রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে কেন্দ্র করে আবারও বহুল আলোচিত চীনের ‘ঋণের ফাঁদের’ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে বাংলাদেশ যে দেখেশুনে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফরের ঋণ চুক্তি থেকেই প্রতীয়মান হয়েছে। ২৭০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার কথা থাকলেও ৪ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নিয়েছে ১৬৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এছাড়া আরও একটি প্রকল্পে ৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার পেয়েছে অনুদান, যা শোধ করতে হবে না। আবার যে সকল ঋণ নেয়া হয়েছে তার সুদের হারও বেশ সহনীয়। ফলে বলা যায়, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে বেশ সতর্কতার সঙ্গেই ঋণ নিচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের অর্থ প্রয়োজন। নিজম্ব সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশকে বিদেশী সাহায্য নিয়েই উন্নয়ন করতে হবে। সহজ শর্তে চীন থেকে ঋণ পাওয়া গেলে সেই ঋণ নেয়ায় দোষের কিছু নেই। তবে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কারণে চীনের ঋণের ফাঁদ নিয়ে বাংলাদেশ বেশ সতর্ক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার বেশির ভাগই সহজ শর্তের এবং সুদের হারও কম। আবার বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও অনেক বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৪.৩ শতাংশ। প্রতি বছর বাংলাদেশকে যে ঋণ ফেরত দিতে হয়, তা দেশটির রফতানি আয় এবং রেমিটেন্সের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। সুতরাং এই বিদেশী ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য কোন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারবে না। তবে ভবিষ্যতে ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে কী শর্তে ঋণ নেয়া হচ্ছে, সুদের হার কী এবং সেটা যেন খুব চড়া না হয়, সে বিষয়েও সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। চীন সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, বিদেশী অর্থায়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে যেন বাংলাদেশ না পড়ে, সে দিকেও আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। সামার ডাভোস সম্মেলনে ‘কো-অপারেশন ইন দ্য প্যাসিফিক রিম’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনায় শেখ হাসিনা নির্দিষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমার সময়ে বাংলাদেশ কখনই ঋণের ফাঁদে পড়বে না’। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে পড়ার পর থেকে বাংলাদেশ নিয়েও প্রশ্ন আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। বাংলাদেশও কী চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে শঙ্কা দূর করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গড় মাত্রার অনেক নিচে রয়েছে। অর্থাৎ জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বর্তমানে জিডিপির ১৪ দশমিক ৩ শতাংশের মতো। এর আগের বছর ১২ শতাংশ ছিল। অথচ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৬৬ শতাংশ এবং ভারতের ঋণ ৩৪ শতাংশ। আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জিবুতি ঋণ সঙ্কটের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। দেশটির সরকারী ঋণ ২০১৪ সালে ছিল জিডিপির ৫০ শতাংশ। এটা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৫২ কোটি ডলার। মূলত বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণের কারণে গত ৫ বছরেই দেশের বিদেশী ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে ঋণের পাইপলাইনে ৪ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার জমা আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের নেয়া এই ঋণের ভারিত গড় সুদ হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। গড়ে ৮ বছরের রেয়াতকালসহ ঋণ পরিশোধের গড় মেয়াদ প্রায় ৩১ বছর। ফলে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশের বর্তমানে যে বিদেশী ঋণের স্থিতি রয়েছে, তা কোনভাবেই উদ্বিগ্ন হওয়ার পর্যায়ে যায়নি। বাংলাদেশের মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) তুলনায় এ বিদেশী ঋণ ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশী ঋণকে উদ্বেগজনক বলা হয় না। এর বেশি হলে তখন উদ্বেগজনক বলে ধরা হয়। বর্তমানে আমাদের বিদেশী ঋণের যে স্থিতি রয়েছে, তা ২০৫৭ সালেই পরিশোধ হয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন ঋণ না নিলে বর্তমান স্থিতির জন্য দাতাদের কাছে ২০২৭ পর্যন্ত এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৬০ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করতে হবে। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১১ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ ফেরত দেয়া হয়েছিল। আমাদের যে ঋণ ফেরত দিতে হয়, তা আমাদের রফতানি আয় এবং রেমিটেন্সের মাত্র ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং প্রতিবছর আমাদের যে রাজস্ব আহরণ হচ্ছে তার মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সুতরাং এই বিদেশী ঋণ আমাদের অর্থনীতির জন্য কোন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা যেসব প্রকল্প নিয়েছি, সেটা যদি জনগণের স্বার্থে নিয়ে থাকি, ঋণের বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন যদি ঠিকমতো আসে এবং নেগোশিয়েশন যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নাই। এই তিনটি বিষয় আমি নিশ্চিত করি।’ এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও বলছেন, ‘দেশের স্বার্থরক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। দেশটির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে যাতে কোন ফাঁদে পড়তে না হয় সে জন্য বাংলাদেশ সতর্ক রয়েছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থরক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। এর আগেও আমরা চীনের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করেছি। কিন্তু সব ঋণ নেইনি।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণের প্রধান সমস্যা হলো সুদের হার। কনসেশনাল লোন বা সহজ শর্তের ঋণে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হলো ঋণের সুদ যদি চড়া হয়। কনসেশনাল ঋণের সুদের হার সাধারণ কম হয়, আর বেশি সুদ হয় বায়ার্স বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের ক্ষেত্রে। তবে এক্ষেত্রে নেগোসিয়েশন বা দরকষাকষি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরকষাকষি করে ঋণের সুদের হার যতটা কম রাখা যায় এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ যত বাড়ানো যায় ততই দেশের লাভ। এতদিন স্বল্পোন্নত দেশ থাকার কারণে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশকে কনসেশনাল ঋণ দিয়ে এসেছে। এসব ঋণে কোন সুদ ছিল না। শুধু দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে গেছে। ফলে ঋণের শর্ত কঠিন করেছে বিশ্বব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংকের ঋণদানকারী সংস্থা আইডিএ (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন) ঋণের ওপর ১ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদারোপ করা হয়েছে। এতদিন আইডিএ ঋণে কোন সুদ ছিল না। এ সুদের সঙ্গে চলমান সার্ভিস চার্জ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ হবে। সব মিলিয়ে এই ঋণের সুদ হবে ২ শতাংশ। এছাড়া ঋণ পরিশোধের সময় আট বছর কমিয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। পাশাপাশি আগে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) ছিল। এখন সেটি করা হয়েছে ৫ বছর। এসব শর্ত ও সুদ হার ১ জুলাই ২০১৮ থেকে কার্যকর হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, তিন বছরের (২০১৫ থেকে ২০১৭) মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় ‘গ্যাপ কান্ট্রি’ হিসেবে এখন গণ্য করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। তাই সস্তা ঋণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোন দেশ এই অবস্থানে থাকলে সস্তা ঋণের সুবিধা আর পায় না। বিশ্বব্যাংকের এই নতুন সুদহার প্রথম কার্যকর হয়েছে ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট এ্যান্ড লাইভলিহুডস (সুফল)’ প্রকল্পে। এ প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংক থেকে ১৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। সুদ বৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেছেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে। এই সুযোগে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্য বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আমাদের যদিও ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বেড়েছে। তারপরও চড়া সুদে ঋণ গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। যাতে যে উদ্দেশ্যে এবং যে প্রকল্পে ঋণ নেয়া হয় সেই উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পালন হয়। তা না হলে চড়া সুদের ঋণের বোঝা বেড়ে যেতে পারে। ইআরডি সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করছে তা ২০১৬ সালে চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী। ওই সমঝোতা অনুযায়ী ঋণের শর্তাবলির বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে পাঁচ প্রকল্পে ঋণের সুদহার হবে ২ শতাংশ। তবে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ঋণ-সংক্রান্ত যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর সুদহার বেড়ে হয়েছে ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ফি এবং শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে। চীন সাধারণত দুই প্রকার ঋণ দেয়। এর একটি হলো- গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল)। অন্যটি প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি)। উভয় ঋণের সুদহার এর আগে ধরা ছিল ২ শতাংশ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে ঋণ চুক্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দাবি করে চীন। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে আলোচনা করে অবশেষে জিসিএল ঋণে সুদহার ২ শতাংশ এবং পিবিসি ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে বিদ্যুত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা বাড়াতে চীনের সঙ্গে পাঁচটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। যাতে মোট চীনা সহায়তার পরিমাণ ১৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর মধ্যে তিনটি চুক্তির আওতায় বিদ্যুত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ১৪০ কোটি ২৯ লাখ ডলার ঋণ পাবে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) অধীনে ২৮ কোটি ৪ লাখ ডলার ব্যয়ে গ্রিড নেটওয়ার্কের উন্নয়নে একটি কাঠামো চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। এছাড়া অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার অনুদান পাবে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সরকারের আমন্ত্রণে ১ থেকে ৫ জুলাই চীন সফর করেন। আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি চীন তাদের আর্থিক পরাক্রমকে কাজে লাগিয়ে বহু দেশকে ঋণের নাগপাশে বেঁধে ফেলছে, আমেরিকাসহ বহু পশ্চিমা অর্থনীতিই এই অভিযোগ করে আসছে বহু দিন ধরে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিভাষায় চীনের এই নীতিকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’ হিসাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে চীনের এই ঋণের পরিমাণটা ঠিক কত, এই ঋণের শর্তগুলোই বা কী, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য বা পরিসংখ্যান পাবলিক ডোমেইনে কখনও তেমন একটা ছিল না। এ জাতীয় তথ্য প্রকাশ করার ব্যাপারে চীনের তেমন সুনাম নেই, ফলে এই কথিত ডেট ট্র্যাপের বহরটা ঠিক কত তাও অজানাই রয়ে হিয়েছিল। শুধু যখন ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে হামবানটোটা বন্দর চীনের হাতে তুলে দিতে হয়েছে, কিংবা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে মালয়েশিয়া বাতিল করে দিয়েছে চীনা রেল প্রকল্প, তখনই হইচই হয়েছে চীনের ঋণ নিয়ে। পরে আবার তা চীনের কুশলী কূটনীতিতে থিতিয়েও গেছে। কিন্তু সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনের দেয়া ঋণের সঠিক পরিমাণ কত, সেই তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে নানা বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে। কোথাও সে দেশের সরকার নিজেই তা কবুল করছে, কোথাও আবার অনুসন্ধানী গবেষণায় তা বেরিয়ে আসছে। এসব গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে এমনকি ভারত পর্যন্ত কীভাবে চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে এবং কোন দেশ কীভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। পাকিস্তান ॥ চীনের ‘অল-ওয়েদার ফ্রেন্ড’ বলে পরিচিত পাকিস্তান সম্প্রতি প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে, শুধু চলতি আর্থিক বছরেই তারা চীনের কাছ থেকে ৬৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। গত ১০ মাসে তাদের মোট বৈদেশিক ঋণের যা পরিমাণ, তার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি এসেছে শুধু চীন থেকেই। তবে পাকিস্তান এই তথ্য নিজে থেকে প্রকাশ করেনি, আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপেই তাদের এ কথা জানাতে হয়েছে। ইসলামাবাদের পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানাচ্ছে, আইএমএফের ৬০০ কোটি ডলার বেল-আউট প্যাকেজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দেয়া প্রধান শর্তই ছিল চীনা ঋণের সব শর্ত ও পরিমাণ তাদের প্রকাশ করতে হবে। এরপরই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আর্থিক উপদেষ্টা ড. আবদুল হাফিজ শেখ এই তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। মালদ্বীপ ॥ ভারত মহাসাগরের এই ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্রেরও চীনের কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ১৪০ কোটি ডলারের বেশি। মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রী ইব্রাহিম আমিরকে উদ্ধৃত করে গত বছরের ডিসেম্বরে এ তথ্য জানিয়েছে নিক্কে এশিয়ান রিভিউ। মাসপাঁচেক আগে টোকিও সফরে গিয়ে মালদ্বীপের নতুন অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, এরই মধ্যে তার দেশ প্রায় ৬৭ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ফেলেছে। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই (মার্চ ২০১৯) বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে খরচের মাধ্যমে এর পরিমাণ ৮৫ কোটি ডলারে ঠেকবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। আরও একটা খুব দামি তথ্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি, সেটা হলো চীনের দেয়া ঋণে সুদের হার কত। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সহজ শর্তে দেয়া ঋণে চীনের সুদের হার হল ১ দশমিক ৫ থেকে ২ শতাংশ। তবে সভেরেন গ্যারান্টি স্কিমে দেয়া ঋণগুলোতে সুদের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত। মালদ্বীপের আর্থিক উন্নয়ন মন্ত্রী ফায়াজ ইসমাইল নিক্কে এশিয়ান রিভিউয়ের কাছে বলেছিলেন, ‘সভেরেন গ্যারান্টির আওতায় নেয়া ঋণে যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলো আমাদের অর্থনীতিতে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেটাই আমরা এখন খতিয়ে দেখছি।’ শ্রীলঙ্কা ॥ বৈদেশিক ঋণের পাহাড় কীভাবে একটা দ্রুত বিকাশশীল অর্থনীতির চাকাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে, গত কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কাকে তার ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা তাদের দক্ষিণ উপকূলের হামবানটোটা বন্দরকে ৯৯ বছরের লিজে চীনের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হওয়ার পর সেই ধারণাই আরও জোরালো হয়েছে। সম্প্রতি ‘দ্য ডিপ্লোমেট’ পত্রিকায় শ্রীলঙ্কান অর্থনীতিবিদ ও গবেষক উমেশ মোরামুদালি লিখেছেন, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের চেহারা আসলে যা ভাবা হচ্ছে, তার চেয়েও অনেক বেশি সাংঘাতিক ও বিপর্যয়কর এবং সেটার জন্য চীনের ঋণ একা দায়ী নয়, বরং এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশী ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীনের কাছ থেকে এসেছে। তিনি আরও জানাচ্ছেন, হামবানটোটা বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে শ্রীলঙ্কা যে ঋণ নিয়েছিল তার জন্য প্রতিবছর যে টাকা শোধ করতে হচ্ছে, সেটা শ্রীলঙ্কার মোট বার্ষিক ঋণ পরিশোধের ৫ শতাংশও নয়। অন্যভাবে বললে, হামবানটোটা আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। বছর দুয়েক আগে বিবিসির এক প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা সরকারের মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে, যা থেকে আন্দাজ পাওয়া যায় ওই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্কট আসলে কত গভীরে। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলেই শ্রীলঙ্কার চীন নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের ভেতর শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণের ৬০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে, আজ যার চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে দেশটিকে। নেপাল ॥ নেপালে গত বছর কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, চীনের প্রতি তাদের নরম মনোভাবের কথা সুবিদিত। পুরনো বন্ধু দিল্লীর দিক থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে কাঠমান্ডু যেভাবে বেজিংয়ের দিকে ঝুঁকেছে, তা ভারতকেও সম্প্রতি বেশ বিচলিত করেছে। নেপাল ও চীনের প্রস্তাবিত যে যৌথ প্রকল্পটির দিকে এখন এ অঞ্চলের নজর কেন্দ্রীভূত, সেটি হলো- ট্রান্স হিমালয়ান রেলওয়ে। বেজিং থেকে তিব্বতের লাসা (পরে শিতাসে) পর্যন্ত বিস্তৃত রেলপথকেই সম্প্রসারিত করে হিমালয়ের বুক চিরে কাঠমান্ডুতে এনে ফেলাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। আর এর ভালমন্দকে ঘিরে নেপালের ভেতরেও এখন বিতর্ক তুমুল। কেউ বলছেন এটা নেপালের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, কারও মতে এটা শ্বেতহস্তী হয়েই পড়ে থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার কারটিন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত নেপালি অর্থনীতিবিদ জগন্নাথ অধিকারী তার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে (‘দ্য কনভারসেশন’) বলেছেন, চীনের ঋণ তারা আদৌ শোধ করতে পারবে কিনা, এই আশঙ্কার মধ্যেও অনেক ছোট দেশই প্রবল উৎসাহে চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নেপালও তাদের অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী ওলি গত বছরের জুনে বেজিং সফরে গিয়ে চীনের সঙ্গে ২৪০ কোটি ডলার মূল্যের আর্থিক সমঝোতায় সইও করে এসেছেন, যার মধ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প থেকে বিদ্যুতকেন্দ্র অনেক কিছুই আছে। ট্রান্স হিমালয়ান রেলওয়ে (যা বেল্ট রোডেরই অংশ) বাস্তবায়নে চীন পুরো টাকাটা অনুদান হিসেবেই দিক, প্রধানমন্ত্রী ওলি এখন সেটাই চান। তবে চীন বলছে, তারা খুব সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে, কিন্তু অনুদান নয়। এই জটটা খোলেনি বলেই এখনও ওই রেলপথ নির্মাণের কাজও থমকে আছে। গবেষক জগন্নাথ অধিকারীর কথায়, ‘নেপালের পরিণতি যাতে শ্রীলঙ্কার মতো না হয়, সেজন্য খুব সাবধানে তাদের পা ফেলতে হবে। নেপালও চীনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, সেটা বোধহয় আমরা খুব শীঘ্রই টের পাব।’ ভারত ॥ বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায় যে ভারত, সেই দেশটিও কিন্তু চীনের স্পনসর্ড এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। গত বছরই (২০১৮) ভারত ওই ব্যাংক থেকে দেড়শ’ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে, আরও তিনশ’ কোটি ডলার পাইপলাইনে আছে। ফলে এআইআইবির ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর মধ্যে ভারতই শীর্ষে। ভারতের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প রূপায়নেই এই অর্থ খরচ হচ্ছে। ভারত অবশ্য দাবি করে থাকে, যদিও এআইআইবির প্রধান স্পন্সর হলো চীন, কিন্তু এটি কোন চীনা ব্যাংক নয়। কাজেই এআইআইবি থেকে নেয়া ঋণকেও ভারত ‘চাইনিজ ডেট’ বলতে রাজি নয়। বাংলাদেশ ॥ বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে চীনের কাছ থেকে এর মধ্যেই ৫৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এই ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় নেয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পদ্মা ব্রিজ রেলওয়ে লিংক, দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ লাইন, কর্ণফুলীর নিচে টানেল, টেলিকম খাতের আধুনিকীকরণ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং জুয়া দাবি করেছেন, বাংলাদেশ বা কোন দেশকেই ঋণের ফাঁদে ফেলা তাদের লক্ষ্য নয়। ‘আমরা সবাইকে সহযোগিতারই চেষ্টা করছি, কাউকেই ডেট ট্র্যাপে ফেলতে চাইছি না’। সম্প্রতি বেজিংয়ে চীনের ‘এক অঞ্চল এক পথ’ পরিকল্পনাবিষয়ক ফোরামের দ্বিতীয় বৈঠক বিষয়ে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং জুয়া জানিয়েছেন, চীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে সহজ শর্তে ১২ দশমিক ৩ বিলিয়ন আরএমবি (চীনা মুদ্রা) ও বায়ার্স ক্রেডিট হিসেবে ৩ দশমিক ৯ মার্কিন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঋণের সুদের হার ২-৩ শতাংশ, যা অন্য কোন বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হারের চেয়ে কম। তিনি জানান, চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশ ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আরও পাঁচটি প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা পর্যায়ে আছে। উল্লেখ্য, এবারের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে সেই পাঁচটি চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়েছে। সাহায্যের নামে চীনা ঋণের ফাঁদ পাতার অভিযোগ নাকচ করে রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘এক অঞ্চল এক পথ’ পরিকল্পনা বিষয়ক ফোরামের দ্বিতীয় বৈঠকে যারা অংশ নিয়েছে তারা সবাই চীনা ঋণে লাভবান হওয়ার কথা বলেছে। এ ছাড়া একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে যাতে প্রকল্প বাছাই করার সময়ই ঝুঁকি নিরূপণ করা যায়। এতে এমন ফাঁদ তৈরি হবে না। এর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ২০১৬-এর অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন দ্বিপাক্ষিক স্তরে প্রায় ২৬ কোটি ডলারের আর্থিক সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অনেক দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমেই তখন লেখা হয়েছিল, ‘ঢাকায় এসে কার্যত ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে দিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট শি’। তবে চীনের আর্থিক সহায়তা যে মোটেই অনুদান ছিল না, বরং তার বেশিরভাগটাই আসলে মোটামুটি সহজ শর্তে ঋণ, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও এক্ষেত্রে ‘দেখেশুনে পদক্ষেপ নেয়ার’ পক্ষেই মতো দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘চীনের ঋণ যেন ওপেন টিকেট না হয়ে যায়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। অর্থাৎ যেনতেন প্রকল্পে যেন ঋণ না নেয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করাটা জরুরী।’ কী শর্তে ঋণ নেয়া হচ্ছে, সুদের হার কী এবং সেটা যেন খুব চড়া না হয়, সে বিষয়েও তিনি সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, রফতানিমুখী খাতে সহায়তা দেবে যেসব প্রকল্প, সেখানে ঋণ নিলেই ভাল। কারণ রফতানি থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রায় চীনের ঋণ পরিশোধও তুলনায় সহজ হবে। ফলে একদিকে বিগ-টিকেট উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের হাতছানি, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া ঠেকানো, এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বিধান করেই চীনা ঋণ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। এসব তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে মোটামুটি পরিষ্কার, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় প্রায় সব দেশেরই যথেষ্ট পরিমাণে চীনের ঋণ নেয়া আছে। কারও পরিমাণ কিছুটা কম, কারও বেশি। সঙ্কটের মাত্রাতেও ফারাক আছে। দিল্লীর থিংকট্যাংক রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের অধ্যাপক ও গবেষক অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে বলছিলেন, এটা সবার জন্য ট্র্যাপ বা ফাঁদ হবে কিনা বলা মুশকিল। তবে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অনেক ছোট দেশই চীনের দেয়া অর্থকে প্রথমে গ্র্যান্ট বা অনুদান হিসেবে ধরে নেয়। তারা মনে করে, চীন বিনা পয়সায় বেল্ট রোডের আওতায় তাদের দেশেও কিছু অবকাঠামো বানিয়ে দেবে। কিন্তু আসলে এখানে ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু হয় না। তিনি বলেন, ‘চীনের ঋণে সুদের হার হয়তো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের চেয়েও কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে শূন্য তো নয়। কাজেই ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই ঋণ নেয়ার ব্যাপারে অতি সতর্ক থাকতেই হবে, বিশেষ করে যেসব দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সমস্যা আছে।’
×