ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

লক্ষ্য দশ লাখ কোম্পানি গড়ে তোলা ;###;বাড়বে উৎপাদন, তৈরি হবে কর্মসংস্থান;###; বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে

ব্যবসাবান্ধব ॥ কোম্পানি আইন হবে

প্রকাশিত: ১০:০২, ২৮ জুন ২০১৯

 ব্যবসাবান্ধব ॥ কোম্পানি আইন  হবে

এম শাহজাহান ॥ কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যবসাবান্ধব করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে এক ব্যক্তিই কোম্পানি গঠন করতে পারবেন। এতে নতুন করে দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ কোম্পানি গড়ে উঠার সুযোগ তৈরি হবে। ফলে উৎপাদন বাড়বে, তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থানের। দেশে একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তিন থেকে দুই অঙ্কের ঘরে নেমে আসবে। মূল আইনের মোট ৪০৪টি ধারার সঙ্গে নতুন আইনে প্রায় ১৯টি ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে আইনটি বাস্তবায়নে আগামী জুলাই মাসের মধ্যে কোম্পানি আইনের ভেটিং বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, কোম্পানি আইনের আধুনিকায়নের দাবি দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে দেশে কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। পরিবর্তিত বিশ্বে দীর্ঘ ২৫ বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল বিশ্বে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে। পঞ্চম শিল্প বিপ্লব উদ্যোক্তাদের দ্বারপ্রান্তে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশেও কোম্পানি আইন সংশোধন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, কোম্পানি গঠনে স্বচ্ছতার অভাব, সার্টিফাইড কপি পেতে দীর্ঘসূত্রতা, পরিপূর্ণ অটোমেশনের অভাব, শেয়ারবদলে অস্বচ্ছতার সঙ্কট রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আইনী বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন বিডা, সিটি কর্পোরেশন, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন আমদানি এবং রফতানি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় উদ্যোক্তাদের প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এতে করে অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি গঠনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সবকিছুরই সমাধান হবে নতুন আইনে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোঃ মফিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সময়ের প্রয়োজনে এখন কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এমনভাবে কোম্পানি আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে যাতে দেশে একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হতে পারে। এ কারণে শিল্পের বিকাশ ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আইনটি অধিকতর যাচাই-বাছাই বা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি ভেটিং প্রক্রিয়া শেষ হলে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা যাবে। সংশোধিত আইনে যা থাকছে ॥ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ তে বড় ধরনের সংশোধনী আনা হচ্ছে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পরিচালিত হতে হবে পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। এই পর্ষদ বা বোর্ডের পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তবে প্রস্তাবিত আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘এক ব্যক্তি কোম্পানি’ হলো সেই কোম্পানি, যার বোর্ডে সদস্য থাকবেন কেবল একজন। পরিচালক এবং প্রধান ব্যক্তি একজন থাকেন বলে এ ধরনের কোম্পানি পর্ষদ সভা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিয়মের ছাড় পাবে। সংশোধিত কোম্পানি আইন-২০১৮ ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ওই সংশোধিত আইনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজীকরণ, এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন, কোম্পানির সাধারণ পাওনাদারদের ও সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ সমীচীন ও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে। সংশোধনীতে ১৯৯৪ সালের ১৮নং আইনের ২ ধারার (১) (ট) (ই) এর শুরুতে ‘এক-ব্যক্তি কোম্পানি ব্যতীত’ শব্দগুলো সংযোজন করা হবে। এছাড়া ১৯৯৪ সালের ১৮নং আইনের ২ ধারার (১) (ট) (ই) এরপর নতুন উপধারা (ঈ) সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংযোজনে বলা হয়েছে, এক-ব্যক্তি কোম্পানি বলতে একজন ব্যক্তি কর্তৃক গঠিত কোম্পানিকে বুঝাবে। কোম্পানি আইনে ১৯৯৪ সালের ১৮নং আইনের ৫ ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, পাবলিক লিমিটেড গঠনের ক্ষেত্রে সাত বা ততোধিক ব্যক্তি, প্রাইভেট কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি শব্দগুলোর পর ‘এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি’ শব্দগুলো সংযোজন করা হবে। ‘আইনানুগ যেকোন উদ্দেশে, নির্গমিত কোম্পানি গঠন করতে পারবে, এবং তা করতে চাইলে তাহারা তাহাদের শব্দগুলোর পর ‘বা তাহার’ শব্দ সংযোজিত হবে এবং ‘নাম সংঘ স্মারক’ শব্দগুলোর পর ‘বা স্মারকে’ শব্দগুলো সংযোজিত হবে। এছাড়া সংশোধিত আইনে ১৯৯৪ সালের ১৮ নং আইনের ৫ (গ) ধারার পর ৫ (ঘ) ধারা নতুনভাবে সংযোজন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এক-ব্যক্তি কোম্পানির স্মারকের নির্ধারিত ফরমে তাহার একজন উত্তরাধিকারী অথবা মনোনীত একজন ব্যক্তির নাম, তৎকর্তৃক লিখিত সম্মতিক্রমে, উল্লেখ থাকতে হবে যিনি একমাত্র শেয়ার হোল্ডারের মৃত্যুর পর ওই কোম্পানির সদস্য হবেন। এক-ব্যক্তি কোম্পানির নিবন্ধনকালে ওই কোম্পানির স্মারক ও বিধিসহ নিবন্ধন বইতে তার উত্তরাধিকার বা মনোনীত ব্যক্তির লিখিত সম্মতিও লিপিবদ্ধ করতে হবে। এছাড়া সংশোধিত কোম্পানি আইনে ৪০৫ ধারার পর ৪০৬ ও ৪০৭ ধারা সংযোজন করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১০৭ ধারা, ১৫১ (৪), ১৭১(১), ১৭১(১)(গ), ১৭১ (২) উপধারা সংশোধন করা হচ্ছে। ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স দুই অঙ্কের ঘরে আসবে ॥ বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আইন খুবই জটিল। এ কারণে দেশী বিদেশী বিনিযোগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। এই জটিলতার কারণেই বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। এ সূচকটি বিদেশী বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। নতুন কোম্পানি আইনে এই সূচক ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে বা কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য ঠিক করেছে। কোম্পানি (সংশোধনী) আইন, ২০১৮-এর খসড়া চূড়ান্ত করে ভেটিং এর জন্য গত মার্চ মাসে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি দ্রুত ভেটিং শেষ করার অনুরোধও জানানো হয়েছিল। কারণ এ আইনের সঙ্গে সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় এখনও ভেটিং কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, সংশোধিত কোম্পানি আইনের বিষয়গুলো অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আশা করছি আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আইনটির ভেটিং প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, গত মার্চেই আইনটির ভেটিং কার্যক্রম শেষ করে কোম্পানি আইনটি চূড়ান্ত করা হলে ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০১৯-এ কয়েক ধাপে এগিয়ে যেত বাংলাদেশ। কারণ ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০১৯ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে গণনা করা হবে। এ বিষয়ে সব মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করলে ২০২১ সালের মধ্যে ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে বা কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এছাড়া কোম্পানি আইন সংশোধন হলে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ছোট ছোট উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এখন ব্যবসার ধরন, পদ্ধতি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। এজন্য যুগোপযোগী ও বাস্তবতার নিরিখে কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বেগবান করা ও নতুন নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নীতিমালার সংস্কার, ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় হ্রাস, মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে ব্যবসা পরিচালনার সহজাত পরিবেশ তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নতুন ব্যবসা শুরুর জন্য নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমানো ও বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ হ্রাসের আহ্বান জানান। প্রস্তাবিত কোম্পানি আইন বাস্তবায়ন হলে অনেক নতুন কোম্পানি কর নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে এবং সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে ॥ ব্যবসা-সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে কোম্পানি আইন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি আইন এবং অর্ডিন্যান্স রয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানি আইন অনেক বড় আইনের একটি। প্রায় সব ধরনের ব্যবসায় এ আইনের দরকার পড়ে। ইতোমধ্যে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর তাদের কোম্পানি আইন পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশেও কোম্পানি আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। ১৯৮২ সালে যে কমিটি গঠিত হয়, তাদের প্রণীত রিপোর্ট ভারতে প্রণীত আইন ১৯৫৬-এর সঙ্গে মিল রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কৌশল এবং যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন কোম্পানি আইন ২০১৩-এর খসড়া তৈরি করা হয়। এই আইনটি সংশোধিত কোম্পানি আইন-২০১৮ হিসেবে ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র, মাঝারি বা এসএমই উদ্যোক্তা একটি অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। কাজেই সব ধরনের ব্যবসা পরিচালনের নীতি এ আইনে থাকা দরকার। নতুন আইনে ক্ষুদ্র ব্যবসাকে আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টায় (ধারা-৫) সুপারিশ করা হয়েছে।
×