ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ২৮ জুন ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-৩৪ কম্যুনিস্টদের নিয়ে মুখরোচক চুটকি অহরহ শোনা যেত সেই কালে। বস্তুতপক্ষে, এই বার্লিনেই এক বাঙালী ভদ্রলোকের কাছে এ ধরনের একটি জোক্ শুনেছিলাম। দুই বার্লিনের মাঝখানের দেয়ালের দুই পাশে কিছু তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চিম বার্লিনে দাঁড়ানো তরুণেরা কলা খাচ্ছে। পূর্ব বার্লিনের তরুণরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘তোমরা কী খাচ্ছো?’ জবাবে ওরা বলল, ‘আমরা কলা খাচ্ছি। তোমাদের ঐপারে কি কলা আছে?’ জবাবে বার্লিনের এরা বলল, ‘না, আমাদের কলা নেই, তবে কম্যুনিজম আছে’। পশ্চিম বার্লিনীরা একটু বোকা হয়ে গেল। কিন্তু হেরে তো যেতে পারে না। তাই তারা জবাব দিল ‘ঠিক আছে, কোন একদিন আমাদেরও কম্যুনিজম হবে।’ পূর্ব বার্লিনীরা হেসে বলল, ‘সেই দিন তোমাদের কলা থাকবে না।’ বার্লিনে আসার আগেই যখন বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম তখন বার্টল্ট ব্রেশ্ট-খ্যাত ‘বার্লিনার অন্সম্ব্ল্’-এর বিষয়ে বিস্তর জেনেছি। ইচ্ছে ছিল বার্লিনে এসে এই বিখ্যাত থিয়েটারটি অবশ্যই দেখতে হবে। এটির প্রতিষ্ঠাতা বার্টল্ট ব্রেশ্ট এবং তাঁর স্ত্রী হেলেনা ভাইগেল। ১৯৪৯-এ পূর্ব বার্লিনে তাঁরা এই থিয়েটারটি প্রতিষ্ঠিত করেন। ’বার্লিনার অন্সম্ব্ল’-এর সঙ্গে যুক্ত হবার আগেই বার্টল্ট ব্রেশ্ট নাট্যকর্ম শুরু করেছিলেন। প্রথমে জার্মানির অন্তর্গত ব্রেশট্-এর জন্মস্থান হগ্স্বার্গে এবং পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অত্যাচার এড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নিউইয়র্ক শহরে। নিউইয়র্কে থাকার সময় তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয় সেই সময়ের বিখ্যাত অভিনেতা চার্লস লটনের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও তাঁকে আবার পূর্ব জার্মানিতে ফিরে আসতে হয় তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের জন্য। তিনি সাম্যবাদী ছিলেন। সাম্যবাদবিরোধী মার্কিনী প্রশাসনের সেটি মনঃপূত হয়নি। বার্লিনে ফিরে বেশিরভাগ কাজ তিনি করেছিলেন এই ’বার্লিনার অন্সম্ব্ল’ থিয়েটারে। তিনি এই নাট্যশালার জন্য নতুন কোন নাটক লেখেননি। তবে তাঁর পুরনো নাটকের মধ্য থেকে মাদার কারেজ, ককেশান চক সার্কেল, লাইফ অব গ্যালিলিও ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন করা হয়েছিল। তবে নাটক মঞ্চায়নের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি ব্রেশট্ এখানে করেছিলেন, তা হলো তাঁর নাট্যরীতি, যা এপিক থিয়েটার নামে খ্যাতি লাভ করেছে, সেই রীতির চর্চা, অনুশীলন এবং তার আলোকে তরুণ অভিনেতাদেরকে প্রভাবিত করা। ১৯৭৪ সালে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে মানুষের কতগুলো মৌলিক বিষয়ের ব্যাপারে সেখানকার সরকার অত্যন্ত সচেতন ছিল। আহার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, বস্ত্র এবং শিক্ষা-এই বিষয়ের অন্তর্গত। মনে আছে আমাদের দোভাষী ক্যারেন বলছিল যে, ও এবং ওর স্বামী যে দু’কক্ষ বিশিষ্ট এ্যাপার্টমেন্টে বাস করে সেই ধরনের একটি এ্যাপার্টমেন্ট পুঁজিবাদী পশ্চিম বার্লিনে নিদেনপক্ষে দশগুণ বেশি ভাড়া হবে। খাদ্য আর বস্ত্রের ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি এবং সেইবারই পশ্চিমা বিশ্বে বেড়াতে গিয়ে জেনেছি কত সস্তায় এইসব কেনাকাটা করা যায় পূর্ব জার্মানিতে। বস্তুতপক্ষে পশ্চিম বার্লিনের অধিবাসীদের অনেকেই সাপ্তাহিক ছুটিছাটায় পূর্ব বার্লিনে কেবল খেতে আসতো। একদিনের ভিসার জন্য দেয় ছিল পাঁচ ফেনিগ। সেটা দিয়েও খুবই সস্তায় তারা পেট ভরে খেয়ে আবার পশ্চিম বার্লিনে ফিরে যেত। অতএব, পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনের প্রবেশ পথে শনি অথবা রবিবার দিন মানুষের বিরাট বড় লাইন দেখা যেত। আমরা অর্থাৎ আমি এবং মুস্তাফা নরূ-উল ইসলাম স্যার পাঁচ-ছয় ফেনিগের মধ্যে আমাদের এক বেলার খাবার খেতে পারতাম। সেই ’৭৪-এ বাংলাদেশে ফার্মের মুরগির প্রচলন হয়নি। বিশাল বড় ঐ ধরনের মুরগি, যাকে তারা ব্রয়লার বলতো, প্রথম খেয়েছি পূর্ব বার্লিনে। মুরগি, স্যুপ এবং রুটি, মাঝে মধ্যে ভাত-এই ছিল আমাদের নিত্যদিনের খাবার। মাঝে মাঝে গরুর মাংস খাওয়া হতো, তবে ইউরোপীয় রেসিপিতে রান্না করা। হাঙ্গেরিয়ান বীফ গোলাশ আমার বড্ড পছন্দে ছিল। চর্বিদার গো-মাংস রান্না করা হতো বাটার অয়েল, প্রচুর পেঁয়াজ দিয়ে। খেতে ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। কখনও কখনও সসেজ, জর্মান পনির ইত্যাদিও খেতাম। তখন বয়স কম ছিল। অতএব, চর্বি-শর্করা ইত্যাদির পরিমাপ করার কোন প্রয়োজন পড়ত না। আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব জার্মানির অধিবাসীদের হাসি খুশিই মনে হতো। আমাদের বাংলাদেশ দূতাবাসের তখনকার অস্থায়ী প্রধান একবার গল্পচ্ছলে আমাকে বলেছিলেন যে, এর কারণ হচ্ছে জার্মান সরকার নাগরিকদের বলে দিয়েছে তাদের হাসি খুশি থাকতে হবে। সরকারের হুকুম অবশ্য পালনীয়। বেনেবেসোঁ বার্লিনে অবস্থিত ফোক্স ব্যুউনে থিয়েটারের প্রধান পরিচালক ছিলেন। সহজে তাঁর সাক্ষাৎ মেলে না। নিহায়ত রাষ্ট্রীয় অতিথি ছিলাম বলে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎ পাবার। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ’তাহলে তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো?’ আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব তখনও বাংলাদেশ সম্বন্ধে তেমন ধারণা রাখত না। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন যে, ‘তুমি বোধহয় জান না পূর্ব জার্মানি হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় দেশ, যা বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতার পর স্বীকৃতি দেয়।’ এ বিষয়টি সম্বন্ধে আমি অবগত ছিলাম এবং এও জানতাম ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে পূর্ব জার্মানি প্রথম দেশ যা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মনে পড়লো যে, আমাদের স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই অসংখ্য যুদ্ধাহত মক্তিযোদ্ধাকে পূর্ব জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকেই আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের শুরু। আমি এ সবই বেনেবেসোঁকে বললাম, কেননা নাটক সম্বন্ধে আলোচনা যত কম করা যায়, তত নিরাপদ বলে মনে হচ্ছিল। আমি পূর্ব জার্মানি যাবার আগেই জার্মান থিয়েটারের ওপরে বিভিন্ন বইপত্র থেকে যা সংগ্রহ করেছিলাম, তাতে বুঝতে পেরেছিলাম যে, উভয় জার্মানিতেই বেনেবেসোঁ নাট্য নির্দেশক হিসেবে শীর্ষ স্থানে রয়েছেন। দেখতে ছোটখাটো, ক্ষিণকায়, নীল চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিধারী বেসোঁ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজী ভাষা এবং সাহিত্য লেখাপড়া করেন তিনি। অতএব অবলীলায় ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
×