ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ইতিহাস বিকৃতি ও আমাদের দায়

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২২ জুন ২০১৯

ইতিহাস বিকৃতি ও আমাদের দায়

এককালে গোয়েবলস বলেছিলেন একটা মিথ্যাকে বারবার বলতে থাকলে তা সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলস ছিল সভ্যতার ইতিহাসের সবচে জঘন্য এবং অন্তিমে পরাজিত স্বৈরাচার জার্মানির হিটলারের প্রচার সচিব। আমাদের বিএনপির বন্ধুরা প্রায় ৮ দশক আগের সেই পচা ব্যর্থ থিওরি নিয়ে এখনও মাঠ গরম করতে চাইছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাই সতর্ক থাকছে। এতে বরং সুবিধাই হলো এ কারণে যে, কে কোথায় কোন পথে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে তা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে সহজ হচ্ছে। যারা মিলিটারি জিয়াকে এখনও চ্যাম্পিয়ন বানাতে চাইছেন এবং এর মাধ্যমে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং কারাভোগকারী ও বিদেশে পলাতক খালেদাপুত্র তারেককে দায়মুক্তি দিতে চাইছেন তাদের উদ্দেশে বলতে চাই যার মূলই মিথ্যার ওপর তাকে ঢাল বানিয়ে কোন কিছু হাসিল করা যাবে না। কারণ, জিয়া নিজেই সংবিধানের ধারা কাটাকাটি করে ইতিহাস বিকৃতির ধারা শুরু করেন এবং এই পথে হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাসের একটি শব্দ আছে সেই আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তারপরও ওই মিলিটারিকে টেনে লম্বা করতে চাইছেন। যারা চাইছেন তাদের উদ্দেশে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরতে চাই : এক. মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এসে প্রথমেই যে কাজটি করেন তা হলো মিডিয়ায় ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘জাতির পিতা’ লেখা যাবে না। দুই. সেই সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলা যাবে না/লেখা যাবে না। তিন. জিয়া ১৯৭৬ সালে PPR (Political Party regulation) জারি করেন দেশের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধ করানোর জন্যে। এতে বলা হয় কোন দল বা দলের শীর্ষ নেতার নামের আগে-পরে কোন বিশেষণ লাগানো যাবে না- অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রধানের নাম শুধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ লিখতে হবে। নামের আগে-পরে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা লেখা যাবে না। জিয়া মুশতাকের সঙ্গে মিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও তার সাধ মেটেনি- এবার আদর্শিক বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করলেন। চার. বিএনপির নেতা-পাতি নেতা-নেত্রীরা দাবি করেন জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছেন, যা সর্বৈব অসত্য এবং বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রকৃত সত্য হলো জিয়ার চচজ-এর শর্ত অনুযায়ী কেবল রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্যে সেদিন আওয়ামী লীগকে নিবন্ধিত হয় বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা কথা বাদ দিয়ে। স্মৃতিভ্রম না হলে যে কথা এখনও মনে পড়ে তখন আবদুল মালেক উকিল এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছাড়া আর সব কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে ছিলেন। ঐ সময় মালেক উকিলের বনানীর বাসায় দলের কেন্দ্রীয় ৭ জন সদস্য নিয়ে একটি সভা হয় বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা শব্দ বাদ দিয়ে তারা দল নিবন্ধিত করবেন কি-না। আগেই বলেছি কেবল রাজনীতির মাঠে ফিরে আসার জন্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী চোখের জল মুছতে মুছতে নিবন্ধন ফরমে সই করেছিলেন। বরং জিয়া তার PPR-এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াত, মুসলিম লীগ এবং নেজামে ইসলামী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তাদের রাজনীতিতে আসার পথ করে দেন। পক্ষান্তরে তখনই সিপিবি এবং জাসদকে রাজনীতিতে আসার সুযোগ দেয়া হয়নি। এই জামায়াত-মুসলিম লীগ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী জেনারেল টিক্কা-রাও ফরমান আলীদের সঙ্গে মিশে শান্তি কমিটি, সশস্ত্র রাজাকার-আলবদর, আল-শামস বাহিনী সৃষ্টি করে। তাদের সহায়তায়ই বিশেষ করে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের (জামায়াতের ছাত্র সংগঠন, যা এখন ছাত্রশিবির) প্রত্যক্ষ মদদ ও পার্টিসিপেশনে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ এবং ৫ লক্ষাধিক মা-বোন নির্যাতনের শিকার হন। তাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু সরকার গণহত্যার দায়ে জামায়াত-মুসলিম লীগকে নিষিদ্ধ করে দেয়, একই সঙ্গে জামায়াত নেতা গোলাম আযম, শাহ আজিজুর রহমানসহ অনেকের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছিল। এই জিয়াই গোলাম আযমদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেন। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম, মিল্লাত এসব পত্রিকারও ছেড়ে দেন। দেননি দৈনিক সংবাদ ও বাংলাদেশ টাইমস। পাঁচ. মিলিটারি জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার (?) মিথ্যা তথ্য হলো মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার গ্রন্থ A Tale of Millions বা লক্ষ্য প্রাণের বিনিময় গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে- কিভাবে জিয়াকে পাকিস্তানী জাহাজের অস্ত্র খালাস করা থেকে on gun point কালুরঘাট বিদ্যুত কেন্দ্রে নেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি on behalf of Bangabandhu পাঠ করানো হয় এ জন্যে যে, একজন মিলিটারিকে দিয়ে পাঠ করালে মানুষ সাহস পাবে। তাও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি দেন ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, যা ঐদিনই তৎকালীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নানসহ বেশ কয়েকজন ঘোষণাটি পাঠ করেন। জিয়াকে দিয়ে পাঠ করানো হয় ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। তাছাড়া ২৭ মার্চ সকালেই বিশ্ব মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার নিউজ ছাপা হয়ে যায়। যেমন- BBC-২৭ মার্চ সকালের অধিবেশনে বলা হয়... ‘শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিবিসি) মার্ক টালি (বিবিসির সাংবাদিক)- ‘খবর পাওয়া গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। Witness to surrendar (জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক)- ‘যখন ২৬ মার্চ প্রথম গুলিটি ছোড়া হলো সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারী তরঙ্গের (ওয়েভলেংথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। এই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (Pepole republic of Bangladesh) হিসেবে ঘোষণা করলেন।’ এমনি ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে যে, ২৭ মার্চ সকালের বিশ্ব মিডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ ছাপা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন করা যায়- জিয়া যে ঘোষণাটি পাঠ করলেন ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেটি কি করে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের পরে ২৭ মার্চের কাগজে ছাপা হলো? তারপরও বিএনপি নেতারা বলবেন জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী বলবেন না। বস্তুত, টার্গেট হলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জিয়াকে সামনে নিয়ে আসা। যদিও সেই গুড়েবালি। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের ব্যক্তিত্বের কাছে বামুন জিয়াকে টেনে লম্বা করার যত চেষ্টা করা হবে ততই তা ছিঁড়ে যাবে। কারণ, জিয়া রাবার নন যে টেনে লম্বা করা যাবে। তবে জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় এক সেমিনারে বলেছেন- ‘জিয়াকে মিথ্যে ঘোষক বানানোর মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতির যে অপচেষ্টা বিএনপি শুরু করে তার জবার দেবার কথা ছিল ইতিহাসবিদদের। তারা সেদিন জবাব দেননি। জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাতে তাদের লাভ হয়েছে। আওয়ামী লীগকে বিতর্কে জড়াতে পেরেছে।’ গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মানিক মিয়া হলে এক সেমিনারে তিনি একথা বলেন। সেমিনারটির আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম(বোয়াফ)’। এর সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়ের সভাপতিত্বে এতে আলোচনায় আরও অংশ নেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বিএলএফ বা মুজিববাহিনী নেতা প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, ইতিহাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। আমারও সুযোগ হয়েছিল কথা বলার। আমি সোজা ভাষায় বুঝি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সাংবিধানিক এখতিয়ার ছিল কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ববাংলার জনগণ তাকে ১৬৭টি আসনে জয় দিয়েছিল। জিয়াকে ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার আগে কোন বাঙালী চিনতই না। তারপরও যারা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায় তারা ভন্ড মতবলবাজ। সেমিনারে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূর-উল আলম লেনিন একটি সুন্দর কথা বলেছেন- এ অঞ্চলে অনেক বড় বড় নেতার জন্ম হয়েছে। তারা কেউ শেখ মুজিব হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রে পিতা। হ্যাঁ, এটা ঠিক বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেন তখন জিয়া সেখানে পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। তাও হলো না। জিয়া তখন পাকিস্তানী জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করছিলেন চট্টগ্রাম পোর্টে। ঢাকা-২১ জুন ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় সংসদ সদস্য, সিনেট সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×