ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

টাইগারদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু আজ

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ২ জুন ২০১৯

টাইগারদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু আজ

মিথুন আশরাফ ॥ ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের সময় যখন লোকেশ রাহুল ও মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাটিং করছিলেন তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটে ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার লিখেন, ‘ইনিংস ঘোষণা করতে কোহলি এত সময় নিচ্ছে কেন?’ বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলাকে অপমান করেছেন মাঞ্জরেকার। শুধু মাঞ্জরেকারই নন, নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামও বাংলাদেশ দলকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতেছেন। ইনস্টাগ্রামে ১০ দলের গ্রুপপর্বের পারফর্মেন্স নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটি ম্যাচের বেশি জিতবে না তা লিখেন। মাঞ্জরেকার ও ম্যাককালামের অপমানের জবাব কী বিশ্বকাপের মঞ্চে দিতে পারবে বাংলাদেশ? তা দিতে পারবে কিনা সময়ই বলে দেবে। তবে আজই বিশ্বকাপের মিশনে নেমে পড়ছে বাংলাদেশ দল। চোট জর্জরিত টাইগাররা আজ নিজেদের প্রথম ম্যাচে লন্ডনের দ্য ওভাল ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে দ্বাদশ বিশ্বকাপের শুরু করতে চলেছে। এই প্রোটিয়া দলটি আবার আহত হয়ে আছে। প্রথম ম্যাচেই যে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে উড়ে গেছে। আর তাই চোট জর্জরিত টাইগাররা আজ আহত প্রোটিয়াদের বিপক্ষেই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে লড়াই করতে নামছে। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশা কী? প্রথম প্রত্যাশা, সেমিফাইনালে ওঠা। দ্বিতীয় প্রত্যাশা, সেমিফাইনালে উঠলে এক ম্যাচ জিতলেই যেহেতু ফাইনালে ওঠার সুযোগ থাকছে, সেই ফাইনালে ওঠা। তৃতীয় ও শেষ প্রত্যাশা, শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে খেলার সৌভাগ্য যদি হয়েই যায় তাহলে বিশ্বকাপ জেতার সুযোগটিও নিয়ে নেয়া যায়। একটি দিনইতো। দিনটিতে ভাল খেললেইতো বিশ্বকাপ জেতা হয়ে যাবে। এমনভাবে ভাবা যায়, স্বপ্ন অনেক বড় করেও দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে তার মিলও থাকতে হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট যে অবস্থানে আছে, সেই অবস্থান থেকে কী বিশ্বকাপ জেতা দল বাংলাদেশ? আবেগ বলছে, বলেছে সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অনেক কঠিন। এখনতো বাস্তবতা আরও কঠিনতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোটে জর্জরিত যে বাংলাদেশ দল। সর্বশেষ ওপেনার তামিম ইকবালও বাঁ হাতের কব্জিতে চোট পেয়েছেন। উরুর ব্যথা না সারতেই কব্জিতে চোট পান। মাশরাফি বিন মর্তুজার দুই পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ে টান পড়েছে। মুস্তাফিজুর রহমানের কাফ মাসলে টান লাগে। পিঠের ব্যথায় ভুগছেন সাইফউদ্দিন। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদতো কাঁধের চোটের কারণে এখনও বোলিংই করতে পারেননি। সাকিব পিঠের পেশির চোট থেকে মাত্রই মুক্ত হয়েছেন। রুবেল হোসেনও ছিলেন চোটে। সেরে উঠেছেন। ক্রিকেটারদের চোটই বাংলাদেশকে আসল সমস্যায় ফেলতে পারে। হাতে আর সময় নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেটাররা হাল্কা ব্যথা নিয়েই হয়তো খেলতে নেমে যাবেন। দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু শতভাগ কী এভাবে দেয়া সম্ভব? বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা যেমন স্বপ্ন আর বাস্তবতার বিচার করেছেন এভাবে, ‘বিশ্বকাপ জেতার কথা যেটা বললেন, অবশ্যই আছে। খুব কঠিন। কিন্তু অসম্ভব বলব না।’ কিন্তু কিভাবে সম্ভব? এবার বাস্তবতার কথা বললেন শেষবার বিশ্বকাপ খেলতে নামার অপেক্ষা শেষ হতে চলা মাশরাফি। বলেছেন, ‘অসম্ভব কোন কিছুই না। অবশ্যই সম্ভব। তবে কঠিন। অনেক কঠিন। এর আগে বিশ্বকাপ যে রকম ছিল গ্রুপ স্টেজে একটা বড় দলকে হারাতে পারলে যেটা হতো তাদের কামব্যাক করা কঠিন হয়ে যেত। লিমিটেড গেমস ছিল। এখানে নয়টা ম্যাচ। যারা প্রত্যাশা করছে সেমিফাইনাল খেলবে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক সুযোগ থাকবে। আমাদের ওই জায়গাটা খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্বকাপে এক মাসে নয়টা ম্যাচ খেলতে হবে। এখানে প্রতিটা ম্যাচ আমাদের জন্য সমান যাবে না। যেটা ম্যাচ খারাপ যাবে পরের ম্যাচে যেন সেই রেশটা না থাকে। এটা আসলে মেন্টাল ব্যাপার। কিছু নেতিবাচক ব্যাপারও আছে। হয়তোবা শেষ এশিয়া কাপ জিতলে এই ধরনের টুর্নামেন্ট কিভাবে জিততে হয় এটার অভ্যাস হতো। এটার অভ্যাস থাকা খুব জরুরী। এর আগে সেমিফাইনাল (চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে) হয়েছে বা কোয়ার্টার ফাইনাল (২০১৫ বিশ্বকাপে) আছে। ফাইনালও এশিয়া কাপে উঠে জিততে পারিনি তিনবার। যে মানসিক চাপ থাকে তখন হয়তো একটা দুইটা উইকেট ধসে পড়েছে ওই চাপটা ধরতে পারব। বড় টুর্নামেন্ট জিতলে পরে এই চাপ হ্যান্ডেল করা সহজ হয়। খুব কঠিন। কিন্তু অসম্ভব বলব না।’ মাশরাফি অধিনায়ক। শেষবারের মতো বিশ্বকাপে খেলবেন। তিনি দলের নেতা হওয়ায় অনেক বুঝেই পথ চলতে হয়। সবাইকে চাঙ্গা রাখতে হয়। কিন্তু বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান যা বলেন, সরাসরিই বলেন। যেটা হতে পারে সেটাই বলেন। তিনি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা এবারই দেখছেন, ‘বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ আছে। প্রকৃতই এবার আমাদের টুর্নামেন্ট (বিশ্বকাপ) জয়ের সুযোগ আছে বলে মনে করি। তবে অবশ্যই আমাদের ধারাবাহিক পারফর্ম করতে হবে। তা করতে পারলে নকআউট পর্বে উঠতে পারব এবং সেখান থেকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। এবার আমরা ভাল করব সে ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।’ সাকিব অভিজ্ঞতাতেও সামনে তুলে ধরেছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহীম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের এবার চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলা হবে। আর কোন দলেরই এমন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার বেশি নেই। এর সঙ্গে তিনবার বিশ্বকাপ খেলা রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, সাব্বির রহমান রুম্মন, মোহাম্মদ মিঠুন, আবু জায়েদ রাহী, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও লিটন কুমার দাসদের নৈপুণ্যে বড় কিছুর স্বপ্নই দেখছেন সাকিব। বলেছেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। দলে কয়েকজন খেলোয়াড় আছে যারা তিন-চারটি বিশ্বকাপে খেলেছে। এটা ভাল ব্যাপার। কারণ কি করা উচিত তা বুঝতে পারব। আমি আত্মবিশ্বাসী।’ দ্বাদশ বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ আজ নামছে। শুরুতেই জয়ের আশায় দল। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শুভ সূচনা করতে চায়। অধিনায়ক মাশরাফি যেমন বলেছেন, ‘গত চার বছরে আমরা ভাল করেছি। এই বিশ্বকাপে শুরুটা ভাল চাই। শুরুটা ভাল করলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বড় ইভেন্টে এটা জরুরী। শুরুটা ভাল হলে নির্ভর করা যায় কতদূর যাওয়া যাবে। আর আমাদের প্রথম প্রতিপক্ষ কিন্তু ফাফ ডু প্লেসিসের দল। আমাদের দলে সিনিয়র-জুনিয়র খেলোয়াড়ের মিশেল আছে। তারা টপ লেভেলের ক্রিকেট খেলছে। তাদের পারফর্মেন্সও দুর্দান্ত। আমরা আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জিতেছি। এটা আমাদের বিশ্বকাপে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।’ আত্মবিশ্বাস আছে। রোমাঞ্চও কাজ করছে। এখন জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করতে পারলেই হয়। মনে বিশ্বাস আছে, যদি ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়, ভাল খেলা যায়, তাহলে জেতা সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে নাকানি-চুবানি খেয়েছে। বোঝাই গেছে, যদি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখা যায়, তাহলে ম্যাচ জয় সম্ভব। ইংল্যান্ডের করা ৩১১ রান টপকাতে গিয়ে ২০৭ রানের বেশি করতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। হারও হয়েছে ১০৪ রানের বড় ব্যবধানে। প্রোটিয়ারা যতই হুঙ্কার দিক, দল যে নড়বড়ে তা বোঝা গেছে। এখন এই সুযোগ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারলেই হয়। বিশ্বকাপের মিশন শুরু করার আগে শুক্র ও শনিবার দুইদিন লন্ডনের ওভালে অনুশীলন করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। এর আগে ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষে শুরুতে লেস্টারে প্রস্তুতি ক্যাম্প করেছে। এরপর বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে কার্ডিফে ছিল বাংলাদেশ দল। সেখানে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায়। তবে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ৯৫ রানের বড় ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। বড় টার্গেটের (৩৬০ রান) সামনে পড়ে ২৬৪ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। বেহাল দশা হয়। ম্যাচটি খেলে বুধবার লন্ডনে পৌঁছায় বাংলাদেশ দল। বৃহস্পতিবার একদিন বিশ্রাম নেয়। শুক্রবার লন্ডনে যেখানে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ, সেখানে অনুশীলন করে। শনিবারও একই স্থানে অনুশীলন করে আজ বিশ্বমঞ্চে খেলতে নামবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। যে দলটিকে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সঙ্গে ২০১৫ সালে দেশের মাটিতে সিরিজেও হারিয়েছিল। এবার প্রোটিয়া দলটি নড়বড়ে। প্রথম ম্যাচেই বোঝা গেছে, সুযোগ বুঝে বিপাকে ফেলা যাবে। এ জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের সতর্কও থাকতে হবে। প্রথম ম্যাচ হেরে আহত হয়ে আছেন দলের ক্রিকেটাররা। যে করেই হোক জিততে চাইবে। বাংলাদেশকে হারিয়ে জয়ের ধারায় ফিরতে চাইবে। দলের অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিস যেমন বলেছেন, ‘এবার এটা লীগ প্রতিযোগিতা। আমাদের পারফর্মেন্স নিয়ে যতই হতাশ হই না কেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এ ভুলগুলো থেকে দ্রুত শিখতে পারি। কারণ পরে আরেকটি ম্যাচ আছে (বাংলাদেশের বিপক্ষে) এবং আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন আমরা আবার ভাল ক্রিকেট খেলতে পারি।’ বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বকাপে জয়ে ফিরতে বাংলাদেশকেই টার্গেট করছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এখন চোট দূর করে একাদশ মজবুত করে বাংলাদেশ নামতে পারলেই হলো। প্রোটিয়াদের হারিয়ে বিশ্বকাপে শুভ সূচনাটা হয়ে গেলেই হলো।
×