ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

অগ্রসরমান বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১৭ মে ২০১৯

 অগ্রসরমান বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা

আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৯তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের এই দিনে ছ’বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। সেটি ৩৮ বছর আগের ঘটনা। তখনকার দিনের বাংলাদেশ ছিল ‘ভয়ঙ্কর বাংলাদেশ’। এক বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। লন্ডভন্ড সবকিছু। পরাজিত শকুনেরা পাকিস্তানতন্ত্রের এদেশীয় কাঠামো নির্মাণে বদ্ধপরিকর। তখন বঙ্গবন্ধু’র খুনীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে মদদপুষ্ট। খুনীচক্ররা দেশের সর্বত্র সারাদিন দাপিয়ে বেড়াত; আর রাতে কার্ফু থাকত। সেটাই হলো তাদের বহুদলীয় গণতন্ত্র। নিষিদ্ধ ঘোষিত সব রাজনৈতিক দলকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এগারো হাজার যুদ্ধবন্দীকে কারাগার থেকে বের করে দেয়া হয়। দেশটা তখন নব্য পাকিস্তানীদের উল্লাস মঞ্চে পরিণত করা হচ্ছিল। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য নয়াদিল্লী থেকে ঢাকা রওনা হওয়ার কয়েকদিন আগে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইক পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকালে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিভাবে গ্রহণ করেন এবং কোন্ উদ্দেশ্য সাধনে তা প্রয়োগ করবেন সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এক হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১১ মে তারিখে নিউজউইক-এ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বক্স-আইটেম হিসেবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় : ১৯৭৫ সালে সামরিক চক্র কর্তৃক ক্ষমতাদখলকালে নিহত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমনকি যে সরকারের মোকাবেলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। তিনি বলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কাজ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে আমি বিবেচনা করি তার মধ্যে থাকবে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা করা।’ নিজের কর্তব্য পালনে তাঁর পিতার অবদান সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। ‘তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রীতি ও ভালবাসা ছিল অপরিমিত’, শেখ হাসিনা বলেন। ‘আমাকে (আওয়ামী লীগের) সভানেত্রী নির্বাচিত করে পরোক্ষভাবে তাঁকেই সম্মান দেখানো হয়েছে। আমি তাঁর অসমাপ্ত কর্মকান্ড সম্পন্ন করতে পারব।’ [নিউজউইক, ১১ মে ১৯৮১] ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন, তখন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও বঙ্গবন্ধু’র কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহেনা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। বিদেশে ছিলেন বলেই তাঁরা রক্ষা পেয়েছিলেন। ‘হাসিনা : এ ডটারস্ টেল’ ডকু ফিল্মটা যারা দেখেছেন তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ আন্তরিক সহযোগিতায় তাঁরা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। সে সময়কার ইতিহাস অনেক অনেক নির্মম, অনেক অনেক কষ্টের। যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ঠিক সে সময়টাতে বঙ্গবন্ধু’র দুই কন্যাসহ বঙ্গবন্ধু’র জামাতা বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় রাতের খাবারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। সে ইতিহাসও ভীষণ নিষ্ঠুর ও হৃদয় বিদারক। তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তার সহধর্মিণীর আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি শীঘ্রই দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলবেন। বাঙালী জাতির মুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধু জীবন দিয়েছেন; বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। ওরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা তাঁর পক্ষে নিরাপদ হবে কি-না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। আমি হয়ত একটু ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু আমার বাবা যে আদর্শের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন তা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই ঝুঁকি নিতেই হবে।’ বাংলাদেশ সরকার তাঁর প্রত্যাবর্তন কী চোখে দেখবে জিজ্ঞেস করা হলে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেছিলেন, ‘তা আমি কী করে জানব? দেশে এখন সামরিক শাসন রয়েছে। যে কোন কিছু ঘটতে পারে।’ আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আদর্শের ক্ষেত্রে আমাদের কোন দৈন্য নেই। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছে তা-ই আমাদের দিক-নির্দেশক। সেই পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মকান্ডকে সফল করে তুলব।’ দীর্ঘ ৩৮ বছরের শেখ হাসিনার ক্রমাগত সংগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে পেয়েছি এক আত্মপ্রত্যয়ী, সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। ॥ দুই ॥ আজ শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পরিম-লে এক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ। তিনি এখন বাঙালী জাতির বিকল্পহীন অবলম্বন। পৃথিবীর সর্বত্রই তিনি সম্মানিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ৪০টি আন্তর্জাতিক ডিগ্রী ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব ল’ ডিগ্রীতে ভূষিত করে। এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জন ওয়েসলিং নিম্নে প্রদত্ত প্রমাণপত্র ‘সাইটেশান’ পাঠ করেন : ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ আপনার পিতা বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আর আপনিও বার বার নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে এবং নিজের জীবনকে বিপন্ন করে দেশে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। সরল অথচ তীক্ষ্ণ বাগ্মিতা দিয়ে আপনি দেশের জনগণের জন্য আপনার সংগ্রামের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তা হলো ‘ভাত ও ভোটের অধিকার’। প্রায়ই দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের জনগণকে ভোটের বিনিময়ে ভাতের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই পায় না। অথচ, আপনার সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের ভাত ও ভোট দুটোর নিশ্চয়তাই পাবে। ‘বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সাহস, আর এই সাহস কেবল তাদের ধৈর্যের পরিচায়কই নয়, এর দ্বারা নিজেদের সমৃদ্ধিও বয়ে এনেছে তারা।’ ‘যে বছর আপনি জন্মগ্রহণ করেন, সে বছর জনগণ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আর সেই কারণে আপনার পিতা সিকি শতাব্দী ধরে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেন। কিন্তু তাঁকে ও তাঁর জনগণকে একসঙ্গে স্বাধীনতার ফল ভোগ করার সুযোগ বেশি দিন দেয়া হয়নি। যেসব অফিসার আপনার পিতা, মাতা ও তিন ভাইকে হত্যা করেছে, তারা ভেবেছিল বাংলার মানুষের প্রতি আপনার পরিবারের সেবা-ভালবাসার সুযোগ তারা খতম করে দিয়েছে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা সুদূরপরাহত করতে পেরেছে। কিন্তু আপনাকে তারা গণনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিল।’ ‘আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল ধারায় প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। আর এই অস্থির প্রেক্ষাপটের বিপরীত ধারায় ছিল দুটো জিনিস। প্রথমত. বাংলার জনগণ এবং দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা। সে সময় সেই গণতন্ত্রের কথা কেউ ভুলে যায়নি, যার পরিপ্রেক্ষিতেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। আপনার সত্য কথা বলার অবিচল দৃঢ়তা আপনাকে অপশাসকদের কাছে বিপজ্জনক করে তুলেছিল। তারা আপনাকে আপনার পিতার বাসভবনে বন্দী করে রাখলেও আপনার উদ্যমকে, আপনার চেতনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশাল দুর্গের মতো পৈত্রিক বাড়ি ও তার উত্তরাধিকারের মধ্যে আটকে থাকলেও আপনার বসবাস ছিল সেই মুক্তির মধ্যে, যে মুক্তি হলো সাহসিকতার মুক্তি। আর আপনার পিতার একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সিকি শতাব্দী পর আজ আপনি সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন।’ ‘শেখ হাসিনা একজন মহান পিতার সুযোগ্য কন্যা, একটি যোগ্য জনগোষ্ঠীর মহান সেবক। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় গর্বের সঙ্গে আপনাকে ডক্টর অব ল ডিগ্রী প্রদান করছে।’ (দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা : ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭) শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। জননেত্রী, দেশরত্ন, ভাষাকন্যা ইত্যাদি নানা বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা হয়। পুরনো দিনের মানুষরা একান্ত নিজের মতো করে বলেন, ‘শেখের বেটি’। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার জন্যে কত প্রকার চেষ্টাই না করেছে। শেখ হাসিনাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। অনেকের মনে থাকার কথা ১/১১ সরকারের সময় ঢাকা শহরের ২৫ লাখ মানুষ শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে স্বাক্ষর দিয়েছে। শেখ হাসিনার সততা ও দেশপ্রেমের জন্যে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার কাছে কাজটাই বড়। দেশের সকল জনের কাজ, জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষের কাজ। আমজনতা নিশ্চিত করে বলতে পারে- শেখ হাসিনা আমাদের, শেখ হাসিনার কাজ আমাদের কাজ। শেখ হাসিনার বাংলাদেশের দিকে উন্নত দেশের নেতারা অবাক হয়ে বলেন, মাননীয় শেখ হাসিনা, আপনি তো উন্নয়ন বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন। শেখ হাসিনার চিন্তায় একটা জীবন্ত রূপ আছে। যে মৌল প্রত্যয়গুলো নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন তা কোনদিনই পরিবর্তিত হয়নি। কয়েকটি মূল সূত্রে এই প্রত্যয়গুলো বিধৃত। সূত্রগুলো এই মানবতায় বিশ্বাস, শান্তি, প্রীতি, ঐক্য ও সঙ্গতিতে সমাজ-আদর্শের সন্ধান, সর্ববিধ নিপীড়ন, সঙ্কীর্ণতার বিরোধিতা। যে পথ সহজ সরল, যে পথ কেন্দ্র থেকে বহুমুখী সে পথকে একমাত্র পথ হিসেবে গণ্য করা। ২০১৫ সালেই ইউনেস্কোর মহাসচিব ইরিনা বোকোভা শেখ হাসিনার হাতে ‘পিস্ট্রি’ পদক তুলে দিয়েছিলেন। তার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ ইউনেস্কোর মহাসচিবের বক্তব্যের সারার্থ। ‘এই সাহসী নারী আলোকবর্তিকা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পথ দেখাচ্ছেন।’ সত্যিই তো শেখ হাসিনার জীবন কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখন এটা শুধু একটি নামই নয়, এটা একটি প্রতিষ্ঠান। Work is worship- যার জীবনের মূলমন্ত্র। কর্ম-জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এক অসাধারণ জীবন তাঁর। শেখ হাসিনা বাঙালী জাতির ralling point, cementing bond। জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশের জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটি রূপক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্যাটার্নেও সাদৃশ্য খুব বেশি। ত্যাগ, প্রজ্ঞা, ঐক্যচেষ্টা, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, ভাবাদর্শেও যুগোপযোগী সমন্বয় ইত্যাদি সবকিছুর দিক দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পিতা-পুত্রীর মধ্যে অদ্ভুত মিল। পার্থক্য শুধু প্রেক্ষাপটগত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিকাশ ঘটেছিল বিজাতীয় পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, আর শেখ হাসিনাকে লড়তে হয়েছে ১৯৭৫-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতানা বিনাশী প্রতিবিপ্লবের বেনিফিশিয়ারিদের বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার সর্বাত্মক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। ॥ তিন ॥ ১৯৮১ সালের ১৭ মে দিনটি কেমন ছিল? ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক সংবাদ-এর শিরোনাম সংবাদে উল্লেখ করা হয় ‘... রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল রাত পর্যন্ত মিছিল। শুধু মিছিল আর মিছিল। প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। স্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে। গতকালের ঢাকা ন’বছর আগের কথাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে এসেছিলেন, সেদিন স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলে গিয়েও লাখ লাখ জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল এক নজর দেখবার জন্য। গতকালও হয়েছে তাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাকে একবার দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয়েছিল জন সমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছ’ঘণ্টা।’ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কয়েকদিন পর নয়াদিল্লীতে এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর রাজনীতিতে ফিরে আসাকে তিনি কিভাবে দেখছেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘রাজনীতি আমার রক্তে মেশানো। ছাত্রজীবনে আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। পরবর্তীকালে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম, এটা ঠিক নয়। জন্মের পর থেকে আমি কর্মচঞ্চল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ছিলাম। আমার পুরো জীবনটাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতির জন্যই মা-বাবা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছি। আমি রাজনীতির সঙ্গেই আছি। নতুন করে রাজনীতিতে এসেছি বলতে পারেন না। নতুন করে রাজনীতিতে প্রবেশের প্রশ্ন ওঠে না।’ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা দৃঢ়তায় বলতে পারেন, ‘ ৭২ বছরের জীবনে ৬০ বছরই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।’ সত্যি তো তাঁর চেয়ে জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই। আমার চেয়ে রাজনীতিবিদ ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফ্রি টমাস, কিউ সি এবং অব্রে রোজ, সলিসিটার বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডন বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন পেশ করেন। জিয়া-চক্রের নির্দেশে তাদের ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল মনে করেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকান্ডে জিয়া নিজে জড়িত থাকা সম্পর্কে তথ্য চাপা দেয়া সম্ভব হবে না বলেই তদন্ত কমিশনের সদস্যদের ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি। ১৯৮১ সালে ২৮ জানুয়ারি আজীবন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রামরত লর্ড (ফেনার) ব্রকওয়ে ভিসা নামঞ্জুর সম্পর্কে হাউস অব লর্ডস-এ এক লিখিত প্রশ্ন পেশ করেন। তিনি জানতে চান, ব্রিটিশ সরকার এর কারণ জানতে চাইবে কি না। এ রকম ভয়াবহ অবস্থার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘রিফিউজি জীবনের যন্ত্রণা কি আমার মতো কেউ জানে না’। এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ৩১টি বই লিখেছেন, এবং ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস্ অফ ইন্টেলিজেনস্ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বই সম্পাদনা করেছেন। তাঁর লেখা বই ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ বই পড়লেই বোঝা যায় তিনি মানবতার জন্যে কতটা লড়াকু। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে ১৪ বার বক্তব্য দিয়েছেন; পৃথিবীতে আর কোন সরকার প্রধানের সে সুযোগ হয়নি। গতবার পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব নেতৃবৃন্দ একসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী বছর সেপ্টেম্বরে (২০১৯) জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আপনিই করবেন।’ তাদের এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শেখ হাসিনার অভিবাসন নীতি সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ এক সময় ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হতো। ৩৮ বছর আগে শেখ হাসিনা দেশে না আসলে এই দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পেতাম না। আজ প্রিয় মাতৃভূমি আত্মমর্যাদা, সমৃদ্ধ, উন্নয়ন বিস্ময়ের প্রতীক হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার অংশ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দুই দশক আগে এই কবিতায় বলা হয়েছিল শেখ হাসিনাই হবেন বাঙালী জাতির বিকল্পহীন অবলম্বন। শেখ হাসিনা আপনার বেদনা আমি জানি, আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে আপনি পা রেখেছেন মাত্র। আপনা পথে পথে পাথর ছড়ানো। পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি কান্তার মরুপথ। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×