ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও

সবুজ পাহাড় আবার রক্তে রঞ্জিত হতে পারে

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৭ মে ২০১৯

  সবুজ পাহাড় আবার রক্তে রঞ্জিত হতে পারে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সবুজ পাহাড় আবার রক্তে রঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনের পরে বেশ কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর পাহাড়ের অবস্থা অনেকটা গুমোট। উপদলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উপজেলা নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় ৮ নির্বাচনী কর্মকর্তাকে হত্যার রেশ এখনও পাহাড়ে রয়ে গেছে। হঠাৎ করে কোন ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক না বলে মনে করছেন গোয়েন্দারাও। বেশ কয়েক দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার পাহাড়ে অন্য রকম বাতাস বইছে। খুনের ঘটনা যে কোন বছরের তুলনায় অনেক বেশি ঘটছে। কখন যে কি ঘটবে তা বলা মুশকিল। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রতি রাতেই পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ‘পেট্রোল’ বাড়িয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র জানায়, প্রতি মুহূর্তে পাহাড়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ হুমকি দেয়া হচ্ছে। ১৮ মার্চ বাগাইছড়িতে উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় ৮ জন নিহত এবং ১৮ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরই পাল্টা-পাল্টি হামলার হুমকি আসছে। বেশ কিছু দিন ধরে ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা মন্তব্য ছেড়ে দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি আমলে নিয়ে তৎপর রয়েছেন। সশস্ত্র গ্রুপগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে। পাহাড়কে অশান্ত করতে তারা সবসময় তৎপর। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় নিয়ে একে অপরের শক্তির জানান দিচ্ছে। সন্ত্রাসী এসব গ্রুপের কারণে প্রাণহানি ও ভোগান্তির শিকার হন নিরীহ মানুষ। ভয়ে ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছেন তারা। গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০ জনের মতো মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, শান্তিচুক্তির আওতায় সেনাবাহিনী এরইমধ্যে অনেক ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা। যেসব এলাকা থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হচ্ছে-সেসব এলাকায় রাতারাতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো ওইসব এলাকা দখল ও পাল্টা দখলের খেলায় মেতে উঠছে। এতে বাড়ছে খুনোখুনি, চাঁদাবাজি আর অপহরণ ধর্ষণের মতো ঘটনা। পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ২৪০ নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি এক ব্রিগেড সেনা সদস্য সরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে চার ব্রিগেড কাজ করছে। এগুলো রয়েছে-রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও গুইমারায়। ২০০৮ সালে কাপ্তাই থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে অরক্ষিত এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাপত্তাহীন। এ অবস্থায় প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো পুনস্থাপন করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আরও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। রাঙ্গামাটি শহরের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে এখানে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে পারলেও এখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফিরে যায়। কিন্ত সেখানেও যে খুব নিরাপদ তা নয়। শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেসব জায়গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিরাপদ আস্তানা গড়ে তুলতে পেরেছে। যেসব সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেসব জায়গা দখল করে নিয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। সেখানে তৈরি করছে নিজেদের আধিপত্য। এতে বাড়ছে চাঁদাবাজি আর খুনোখুনি। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা সেনাক্যাম্পগুলো আবারও স্থাপনের দাবি জানান। পাহাড়ে প্রতিযোগিতা করে চলছে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি। এসব সংগঠন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে শান্তিপ্রিয় পার্বত্যবাসীর জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা টোকেন কিংবা রসিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ী, সরকারী বেসরকারী চাকরিজীবী কেউই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক অস্ত্রসমর্পণ করে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। আর ওই দিনই প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শত শত উপজাতি পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানায়। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ’৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে দুই সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। তারপর থেকেই চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা, খুনোখুনি। ’১০ সালের ১০ এপ্রিল জেএসএস ভেঙ্গে সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন) গ্রুপ। এবার শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘাত- কখনও জেএসএস-ইউপিডিএফ আবার কখনও জেএসএস (সন্তু)- জেএসএস (এমএন)। কখনও কখনও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। চুক্তির পর গত ২১ বছরে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দ্বন্দ্বে উভয় পক্ষে ৮ শ’র বেশি মানুষ খুন হয়েছে। আহত হয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ। পাহাড়ের মূল সংগঠনগুলোর পৃথক অঙ্গসংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামসহ একাধিক শাখার সংগঠন রয়েছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে রয়েছে এম-১৬, একে-৫৬, একে-৪৭, উজি গান, জি থ্রি, মার্ক ফোর এলএমজি, এসএমজি ও রকেট লাঞ্চারসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েই চলেছে। চুক্তির আগে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএসকে চাঁদা দিলে নির্বিঘ্নে করা যেত ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এসব সংগঠনের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন কোন সেক্টর নেই যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে না। তবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করা হয় বনজ সম্পদ ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। এছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন টোল কেন্দ্র, বাজার ডাক, ফসলের জমি, জুম চাষ, গবাদিপশু এমনকি চাকরিজীবীদেরও বার্ষিক চাঁদা দিতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের মালিক, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা একাধিক সংগঠনকে ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক চাঁদা দিয়ে পরবর্তী বছরের টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বিদেশী দাতা গোষ্ঠী ও সংস্থা এবং এনজিওর কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা না দিলে অপহরণের শিকার হতে হয়। গোয়েন্দা সূত্রমতে, ট্রাক, বাস বা কোস্টার প্রতিটি বার্ষিক চাঁদা হিসেবে সংগঠনগুলোকে ৬ থেকে ৯ হাজার টাকা, জীপ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা, বেবিট্যাক্সি ১ হাজার থেকে ১৫শ’ টাকা, রিক্সা ২শ’ ও ৩শ’, ব্যবসায়িক পাস ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বড় সাইজের বাঁশ প্রতি হাজার ৪শ’ থেকে ৬ শ’, উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ১০ থেকে ১৫ ভাগ, রাস্তা, সেতু কালভার্ট ও বিল্ডিং জেএসএস ১০%, কড়ই কাঠ, গর্জন, চাপালিশ ও সেগুন প্রতি ঘনফুট ৪০ থেকে ৬০ টাকা, প্রতিটি শ্রেণীর গোলকাঠ ফুট প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা, কলা, আদা হলুদ, সবজি, ধান ও চাল ভর্তি ট্রাক প্রতি ৪শ’ থেকে ৬শ’ টাকা, প্রতিটি বাছুর ৫০ থেকে ৭৫ টাকা, ষাঁড় বা গরু ১শ’ থেকে ১৫০ টাকা, ছাগল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, রাইস মিল প্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করছে। এছাড়াও কৃষক ও জুমচাষীদের একর হিসাব করে চাঁদা দিতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব উপজাতি চাকরিজীবী রয়েছেন তাদেরও বার্ষিক একটা চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে মৌসুমি চাঁদা। যেমন বৈসাবি উপলক্ষে পাহাড়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়। কিছুদিন আগে সমাপ্ত সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী খরচের জন্য বিপুল অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হয়েছে। আবার নির্বাচনে হেরে গিয়েও নির্বাচনী ক্ষয়ক্ষতি উঠানোর জন্য চিঠি দিয়ে নতুন করে চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর প্রায় ৩শ’ কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা আদায়ের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬ উপজেলা ছাড়াও ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে তাদের রয়েছে কালেক্টর।
×