ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হামলার আশঙ্কায় গোয়েন্দা নজরদারি

শীঘ্রই আসছি... আইএস সমর্থক চ্যানেলে পোস্টার

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

শীঘ্রই আসছি... আইএস সমর্থক চ্যানেলে পোস্টার

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে হামলার পরিকল্পনা করছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। বাংলায় লেখা, ‘শীঘ্রই আসছি, ইনশাল্লাহ’... ইসলামিক স্টেটকে সমর্থনকারী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি পোস্টারের এমন ইঙ্গিত বহনকারী খবরের বিষয়টি খতিয়ে দেখাসহ নজরদারি শুরু করেছে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা। শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার পর সেই দেশ থেকে ফেরত আসা ১১ শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি এবং ফেরত আসা শ্রমিকদের প্রত্যেকের আলাদা প্রোফাইল তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কোন জঙ্গী সংগঠন বড় কোন ঘটনা ঘটাতে পারবে না, আমরা নজরদারি করছি, নিউজিল্যান্ডে হামলার পর জঙ্গী চ্যানেলগুলোতে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্ররোচনা দেয়া হচ্ছে, একটি হামলার জন্য যতগুলো রসদ লাগে এবং প্রস্তুতি লাগে তা তাদের নেই, জঙ্গী নেটওয়ার্ক আমরা ধ্বংস করেছি বলে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার রাতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে আইএস- বাংলায় লেখা, ‘শীঘ্রই আসছি, ইনশাল্লাহ...ইসলামিক স্টেটকে সমর্থনকারী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া পোস্টারটি প্রকাশ করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকাসহ নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। মুরসালাত নামে আইসিসের একটি শাখা সংগঠনের লোগোও রয়েছে পোস্টারের গায়ে। শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ হামলার পর এই পোস্টারটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। আইএসপন্থী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত বাংলায় লেখা একটি পোস্টারের সূত্রে এই হামলা পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া। শ্রীলঙ্কার একাধিক গির্জা ও হোটেলে ভয়াবহ হামলার কয়েকদিনের মাথায় এই কথিত হুমকির খবর সামনে এলো। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, পোস্টারে ‘শীঘ্রই আসছি ইনশাল্লাহ’ লেখার পাশাপাশি আল মুরসালাত নামে একটি গ্রুপের লোগো সংযুক্ত থাকায় তারা ধারণা করছে, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে হামলার ইঙ্গিত, যদিও প্রতিবেদনে ওই পোস্টারের কোন ছবি যুক্ত করা হয়নি পোস্টারে বাংলায় লেখা হয়েছে ‘শীঘ্রই আসছি’। সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ইসলামিক স্টেট বা আইএসের কেন্দ্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত স্থানীয় জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীনের (নব্য জেএমবি) মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থান জোরালো করেছে জঙ্গীগোষ্ঠীটি। জেএমবি কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্যে সদস্য নিয়োগ ও আস্তানা তৈরি করেছে। শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের পর এই পোস্টার প্রকাশকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া ছাড়াও সম্ভাব্য করণীয় বিষয়টিও মাথায় রেখেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গত ২১ এপ্রিল সকালে শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের অনুষ্ঠানে তিনটি গির্জা ও তিনটি পাঁচতারকা হোটেলে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় নিহত হয় ২৫৩ জন। এ ঘটনায় আহত হন ৫শ’রও বেশি। হামলার পর ইসলামিক স্টেট (আইএস) একটি ভিডিও প্রকাশ করে তার দায় স্বীকার করে। ওই ভিডিওতে হামলায় অংশ নেয়া সাত জনসহ জাহরান হাশিমকে আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে ভিডিওতে একমাত্র জাহরান হাশিম ছাড়া অন্যদের মুখ ঢাকা ছিল। তাদের সেদিনের আত্মঘাতী হামলাকারী বলে মনে করা হচ্ছে। এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশে হামলা করার পরিকল্পনার খবর সামনে আনলেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। প্রায় পৌনে ৩ বছর আগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর তার দায় স্বীকার করে বার্তা প্রকাশ করেছিল আইএস। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সংঘটিত ওই হামলায় ২০ জন দেশী-বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়। আর অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরেরদিন ভোরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে বাকি জিম্মি উদ্ধার করা হয়। তবে হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গীর সঙ্গে ওই রেস্তোরা কর্মী সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। শ্রীলঙ্কায় হামলার পর বাংলাদেশেও জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হামলা চালানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে গুলশান হামলায় জড়িতরা নিজেদের আইএস সমর্থক হিসেবে দেখিয়েছিল। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দলটির সঙ্গে বাংলাদেশী জঙ্গীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা উড়িয়ে দিয়েছিল সরকার। গুলশান হামলায় জড়িত থাকা নব্য জেএমবির সদস্যরা আইএস দ্বারা উদ্বুদ্ধ বলে মনে করা হয়। এই দলটির শাখা ভারতেও সক্রিয় বলে দেশটির গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি। সিরিয়ার বড় অঞ্চলে যখন আইএসের শক্ত অবস্থান, তখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশ নিয়ে আইসের বাংলা খিলাফত প্রতিষ্ঠার খবরও এসেছিল জঙ্গীগোষ্ঠীটির নিজস্ব প্রচার মাধ্যমে। বাংলাদেশের জামা’আতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেএমবিকে তাদের দলে সদস্য নিয়োগের জন্য কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তৎপর হতে দেখা যায়। ২০১৮ সালের বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম নামে এক জেএমবি সদস্যকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার বাবুঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দেশটির পুলিশ। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, কেন্দ্রীয় আইএসের মদদপুষ্ট স্থানীয় জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিনের (নব্য জেএমবি) মাধ্যমে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আইএসের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। নতুন সদস্য নিয়োগ এবং আত্মগোপনের জন্য জেএমবি সদস্যদের মাঝেমধ্যেই ভারতের কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র যাতায়াত রয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার বাবুঘাট এলাকা থেকে আরিফুল ইসলাম নামের এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৮ সালের বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের অন্যতম সহযোগী ছিল সে। এই বিস্ফোরণের আগে আরিফুলে ইসলামের গ্রেফতার হওয়া সহযোগী ব্যক্তিরা ভারতের আসামের চিরাঙ জেলায় স্থাপিত একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা স্বীকার করে বলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, গত জুলাইয়ে বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হাতে গ্রেফতার আইএস-জেএমবি সদস্য মোহাম্মদ মুসিরুদ্দিন ওরফে মুসাকে। তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। সেসময় তামিলনাড়ুর তিরুপুর জেলায় বহুদিন ধরে লুকিয়ে থাকা মুসিরুদ্দিন জানায় যে, ২০১৪ সালের খাগড়াগড়ে জোড়া বোমা হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জেএমবির অন্যতম নেতা আমজাদ শেখের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তিন বছর আগেও, নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনুরূপ পোস্টার প্রকাশ ও বিতরণ করেছিল জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরত আসা ১১ শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদ ॥ শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার পর সেই দেশ থেকে ফেরত আসা ১১ জন শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। জিজ্ঞাসাবাদে ফেরত আসা শ্রমিকদের এখন পর্যন্ত জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা মিলেনি- এ কথা জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা ফেরত আসা শ্রমিকদের প্রত্যেকের আলাদা প্রোফাইল তৈরি করছি। শনিবার দুপুরে মিন্টো রোডের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, শ্রমিকদের পুলিশি হেফাজতে নেয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যা জানা গেছে, তারা সাধারণ শ্রমিক ছিলেন। তাদের ওপরে ম্যানেজার ও সুপারভাইজার ছিল। তাই মালিকের সঙ্গে তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে পুরো সময়ে মাত্র দুইবার বা তিনবার মালিকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে। মালিকের সঙ্গে আসলেই অন্য কোন সম্পর্ক ছিল কি-না তা জানতেই শ্রমিকদের আনা হয়েছে।
×