ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের বিপদ লুকিয়ে থাকে যে মেঘের আড়ালে

প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

 কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের বিপদ লুকিয়ে থাকে যে মেঘের আড়ালে

শাহীন রহমান ॥ কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাত দেশে নতুন নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে কালবৈশাখী এবং বজ্রপাতের জন্য যে মেঘ সবচেয়ে বেশি দায়ী তা হলো ‘কিউমুলো নিমবাস মেঘ। চৈত্র বৈশাখ মাসে এই মেঘ থেকেই সাধারণত কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। এই সময় উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে হঠাৎ এই ধরনের মেঘ জমে মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। এই সময় আকাশে এই ধরনের মেঘ জমলে কালবৈশাখী ও বজ্রপাতের আশঙ্কা শতভাগ বেড়ে যায়। এ কারণে এই মেঘ জমার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেলে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত উগান্ডায় হলেও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে এ ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। আকাশে কিউমুলো নিমবাস টাইপের মেঘ দেখা দিলেও বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে। এই মেঘ দেখতে সুন্দর হলেও এর আড়ালেই বিপদ লুকিয়ে থাকে। এই মেঘ মাটির ২ কিলোমিটার ওপর থেকে ওপরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্তম্ভ আকারে থাকে। বজ্রপাতের পাশাপশি এ মেঘ থেকে শিলা বৃষ্টিও হয়। এই মেঘ তৈরির সময় বাইরে অবস্থানকালে যদি দেহের ও মাথার লোম খাড়া হয়ে যায় তাহলে ভাবতে হবে বজ্রপাতের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সেখানে এক ধরনের ইলেক্ট্রনিক চার্জ তৈরির কারণেই কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে চৈত্র বৈশাখ মাসে কিউমুলো নিমবাস মেঘ বেশি জমছে। ষড়ঋতুর এই দেশে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য মাস ঝড় বাদলের সময় হিসেবে পরিচিত। এ সময়ে আকাশে মেঘ জমলেই কালবৈশাখী বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। মেঘ সৃষ্টি হলে বজ্রপাতের ঘটনা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। হয়ত পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। আবহাওয়াবিদদের মতে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে গ্রীষ্মকাল সময়টাতে বজ্রপাতের মাত্রা অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বজ্রপাত বিধ্বংসীরূপ নিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী চৈত্র বৈশাখ মাসে এ দেশে সবচেয়ে বেশি কালবৈশাখী এবং বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এ বছর মধ্য চৈত্র থেকে কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখী অব্যাহত রয়েছে। কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাত উভয় কারণে প্রায় প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে তালগাছসহ উঁচু গাছ পালা না থাকায় বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে। প্রতিবছর প্রায় ২শ’র বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে বজ্রপাতের কারণে। এক দিনের বজ্রপাতে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বজ্রপাত এবং কালবৈশাখীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য যা আগে করতে হবে তা হলো আকাশের উত্তর-পশ্চিম দিকে এই মেঘ জমা হতে দেখলেই দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। তা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এটি জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করেছে সরকার। এটিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বজ্রপাতে নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়াও হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতর থেকে এ বিষয়ে আগাম সতর্ক বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতির আভাস পাওয়া মাত্র আবহাওয়া অধিদফতর সতর্কতা জারি করছে সঙ্গে সঙ্গে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে আগে সচেতনতা তৈরি করা জরুরী। বজ্রপাত যেহেতু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটি দুর্যোগ, যার হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গড়ে ২শ’ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বজ্রপাতে। এ হার বিশ্বে দ্বিতীয়। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মূলত বাইরে বা খোলা স্থানে অবস্থানের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় দেশে তাল, খেজুর, নারিকেল ও সুপারি গাছের আধিক্য থাকার কারণে বজ্রপাত হতো মূলত এসব গাছের ওপর। এসব গাছের কারণে মানুষ বেঁচে যেত। ফলে বজ্র নিচে নেমে আসত না। কিন্তু উঁচু স্থানের অভাবের কারণে অথবা এসব উঁচু গাছপালার অভাবের কারণে তা এখন সরাসরি মানুষের ওপর পড়ছে। এছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সম্প্রতি দেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। উষ্ণায়নের কারণেই চৈত্র বৈশাখ মাসে কিউমুলো নিমবাস মেঘের বেশি আধিক্য দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এফআর সরকার বলেন, ঠিক কি কারণে আকাশে ভয়াবহ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে, ক্রমান্বয়ে কেনই বা বিধ্বংসী রূপ গ্রহণ করে এর সঠিক কারণ বিজ্ঞানীদের জানা না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বে উষ্ণায়নের প্রভাবে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বাড়ছে। এ কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া মন্ডলে তাপমাত্রা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ লক্ষ গুণ বেশি। ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের শোষণ ক্ষমতা একেবারে কমে এসেছে। ক্রমেই পৃথিবীর উষ্ণায়ন বাড়ছে। এ কারণে বজ্রপাত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
×