ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নাগরিক শান্তি কমিটি ॥ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ৯ এপ্রিল ২০১৯

ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নাগরিক শান্তি কমিটি ॥ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল দিনটি ছিল শুক্রবার। মুক্তির নেশায় রণাঙ্গনে সশস্ত্র সংগ্রামে বীর বাঙালী। মুক্তিযুদ্ধকে আরও সুসংগঠিত করা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী। তাই আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের প্রচেষ্টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সহায়তার আশ্বাস পাওয়া যায়। এর পরই কারাবন্দী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের দেয়া ছোট্ট একটি বিমানে ঘুরে ঘুরে সকলকে কলকাতায় জড়ো করেন। একাত্তরের এই দিন (৯ এপ্রিল) তারা একটি নতুন সরকার গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। লে. জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে শপথ নেন। টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী। ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের কার্যক্রমের মধ্যে এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঘোষণায় বলা হয়, এই ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে বিভিন্ন শহরের শান্তি কমিটিগুলো কাজ করবে। এই কমিটিকে আরও কো-অপ্ট করার ক্ষমতা দেয়া হয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে বেতার ট্রান্সমিটার অপসারণের নির্দেশ দেয়। ময়মনসিংহের মধুপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর নথের পটুয়া স্টেশনের কাছে একটি ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্থাপন করে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা বিমান ও কামানের গোলার সমর্থনপুষ্ট হয়ে পাঁচদোনাতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটে গোপালদী বাজারে চলে যায়। সিলেট বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকা ব্যতীত পুরো সিলেট মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। পাকবাহিনী অবস্থানরত এ দুটি এলাকা দখলের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানি বিমানবন্দর আক্রমণ করে। পাকবাহিনী নড়াইল মহকুমা শহরে বিমান হামলা চালায় এবং যুগপৎ দাইতলা থেকে অভিযান চালিয়ে পাকসেনারা নড়াইল দখল করে নেয়। ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ খান মালেকের নেতৃত্বে পাকবাহিনী বদরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্সের ওপর আক্রমণ করে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে পিছু হটে খোলাহাটিতে চলে যায়। মেজর শওকত হাবিলদার তাহেরসহ ১০ জন সৈনিক নিয়ে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট থেকে এক মাইল উত্তরে পাকবাহিনীর ঘাঁটি কৃষি ভবন আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে পাকিস্তানীদের একজন ক্যাপ্টেন ও একজন সুবেদারসহ ২০ জন নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকিস্তানিরা কৃষি ভবন ছেড়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা কালুরঘাট ও মদুনাঘাট দখলের চেষ্টা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, পাকিস্তানের বৃহত্তর বন্দর চট্টগ্রাম থেকে সমাজবিরোধীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রদ্রোহীদের নির্মূলে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতারা ও পাকিস্তানপ্রিয় জনগণ। বেনাপোল সীমান্তে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে সারাদিন ধরে সংঘর্ষ চলে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৭৮নং সামরিক আদেশ জারি করেন। এই আদেশ বলে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ রোধের অজুহাতে যে কোন ব্যক্তিকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা লাভ করে সামরিক কর্তৃপক্ষ। ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মাওলানা নুরুজ্জামান ঢাকার ঘরে ঘরে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য প্রদেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। গোলাম আযম রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাহায্যের নামে তাদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করছে। আসলে ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিতে চায়। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে প্রতিটি পাকিস্তানী মুসলমান জীবন দেবে, কোনক্রমেই পাকিস্তানের অখ-তা বিনষ্ট হতে দেবে না। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে শরণার্থীদের বাঁধভাঙ্গা স্রোত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করছে, সঙ্গে আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের সদস্য, প্রায় সকল এমএনএ-এমপিও চলে এসেছেন। পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে ৪১ জন সাবমেরিনার প্রশিক্ষণরত ছিল। সেই সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালী এবং এরা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যার খবর শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে আটজন বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন এবং ১৯৭১ এর এই দিন ভারতের দিল্লীতে এসে পৌঁছান। এই আটজনের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে মোট ২০ জনের গেরিলা দল গঠন করে তাঁদের ভারতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের রণাঙ্গনে পাঠানো হয়। কলকাতার ইংরেজী দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার ১৯৭১ এর ৯ এপ্রিল সংখায় প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ ঢাকার ঞযব চধশরংঃধহ ঙনংবৎাবৎ, গড়ৎহরহম ঘবংি, দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ এবং আজাদ- এই দৈনিক পত্রিকাগুলো পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকাগুলোর অধিকাংশ সাংবাদিক ও কর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। পশ্চিমা বর্বরেরা বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার জন্য উক্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর নাম বা এড়ড়ফরিষষ ব্যবহার করছে। উক্ত খবরে আরও বলা হয় দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও ঞযব ঢ়বড়ঢ়ষব-এর কার্যালয় ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ ভোরে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ইউএনআই, পিটিআইএর বরাতে হিন্দুস্তান টাইমস ‘মুজিবের লোক রাজশাহী পুনর্দখল করেছে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী মুক্ত করেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অন্যত্র চলে গেছে। পাকিস্তানী প্লেন আজ উত্তর অংশে নাপাম বোমা বর্ষণ করে আরও কিছু ধ্বংস সাধন করেছে। প্রায় সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী রাজশাহীতে বিজয় অর্জন করে। প্রচ- সংগ্রামের পর সৈয়দপুর থেকে তাঁরা পাকিস্তানী সেনাদের তাড়িয়ে দেয়। যশোরে সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে। কুমিল্লায় একটি বড় যুদ্ধে পাকিস্তানীরা দুর্বল হয়ে আছে। এই খবর গতকালের। সিলেট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা খাদিমনগর সেনানিবাস দখল করেছে। এখানে প্রধান শহর থেকে সৈন্যরা আশ্রয় নিয়েছিল দু’দিন আগে। পাকিস্তানীরা সালুটিকর বিমানঘাঁটি এবং শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের চা-বাগান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায় যে, খুলনা শিল্পাঞ্চলের দখল নেয়ার জন্য যুদ্ধ চলছে। অনেক দিন চেষ্টার পর পরিস্থিতি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যাচ্ছে। শারীরিক সমস্যা থাকার পরেও বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দিন সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজশাহীর রিপোর্টে জানা যায় সেখানে পাকিস্তানীদের হার প্রায় নিশ্চিত। ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে এবং ২০০ জন আটক হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী রেডিও স্টেশনের সরঞ্জাম মেরামত করছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×