ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৮ এপ্রিল ১৯৭১

কলকাতার ভবানীপুরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক

প্রকাশিত: ১০:৪২, ৮ এপ্রিল ২০১৯

 কলকাতার ভবানীপুরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মুক্তি সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে দেশে স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রকাশনা প্রায় অসম্ভব। ঠিক সেই মুহূর্তে মুজিবনগর ও মুক্তাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আত্মপ্রকাশ করে কয়েক ডজন নিয়মিত-অনিয়মিত পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সাময়িকী। এ সংবাদ সাময়িকীগুলো বাংলার মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচার করত। আর এর মাধ্যমে দেশের ভেতরে-বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। একাত্তরের এই দিনে চাঁদপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে হাজীগঞ্জ ডাক বাংলোতে পাকবাহিনী প্রতিরোধ নিয়ে এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ডা. আবদুস সাত্তার, ড. আবু ইউসুফ, হাবিবুর রহমান, সাইদুর রহমান, বি এম. কলিমুল্লাহ, আলী আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার মঞ্জুরুল করিম পরিস্থিতি নিয়ে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং নোয়াখালী প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করেন। ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজ সিলেট জেলা মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা নামক স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। ৫ ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকবাহিনী আর্টিলারী ও মর্টার ব্যবহার করে। মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদের অভাবে পিছু হটে নড়াইলে অবস্থান নেয়। রাত ১টায় সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানি লালমনিরহাট থানা হেড কোয়ার্টারে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা ‘ফির্ডগান’ আর্টিলারি ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বদরগঞ্জ প্রতিরক্ষা ব্যুহে আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দেন। ভূষিরবন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে এবং দশ মাইল নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। কুড়িগ্রামে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলনে কুড়িগ্রাম, রৌমারী, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গমারী এলাকা যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই এলাকাকে রংপুর সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। রংপুর সেক্টরকে সুবেদার বোরহানউদ্দিনের নেতৃত্বে পাটগ্রাম এবং সুবেদার আরব আলীর কমান্ডে ভুরুঙ্গমারী এই দুটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। রংপুর সেক্টরের দায়িত্বে থাকেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তা লে. কর্নেল লিমাইয়া, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শালুটিকর বিমানবন্দর এবং লক্কাতুরা এলাকা থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এদিন নরসিংদীর পাঁচদোনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে পাকসেনারা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনা দলের ১৫৫ জন প্রাণ হারায় এবং ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়ে পিছু হটে। কালিহাতী সেতু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৯টি শরণার্থী শিবির খোলা হয়। এদিন জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘ মহাসচিব উ’থান্টের কাছে প্রেরিত এক নোটে বলেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ যোগাচ্ছে। ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী যে তৎপরতা চালাচ্ছে বিমানবাহিনী তাতে সাহায্য করছে। বিমান বাহিনী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) আস্তানায় ও যানবাহনের ওপর আঘাত হানছে। দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিবাহিনী) পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণভাবে যানবাহন চলাচলে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য রাস্তায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে তা অপসারণ করা হয়েছে। কালবিলম্ব না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রতিরোধ করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে-এ মর্মে কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ.এস.এম. সোলায়মান ঢাকায় এক বিবৃতি দেন। মুসলিম লীগ নেতা কাজী আবদুল কাদের করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অরাজকতার জন্য শেখ মুজিব ও বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ দায়ী। জাকার্তায় ইন্দোনেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে সেখানকার পাকিস্তানী দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দীঘি ইউনিয়নের মাইজখাড়া গ্রামে মোঃ মহারাজ, সেওতার মঙ্গল মিয়া, জয়ড়ার বাহেরউদ্দিন ও নোয়াখালীর আবদুল মান্নান মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর পারে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। তারা সবাই তারাঘাটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মচারী। মানিকগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটাই প্রথম শাহাদাৎবরণের ঘটনা। ত্রিমুখী আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে যায়। আদিবপুর এবং কুড়িগ্রাম সেক্টর হতে মুক্তি ফৌজের আরও দুটি দল সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। মধ্য বাংলাদেশে গঙ্গাসাগর সেতু উড়িয়ে দিয়ে শ্রীহট্ট জেলার রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সমসের নগর (সিলেট) বিমানঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। কলকাতায় ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বসহ যুবনেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বসহ যুব নেতাদের দিল্লী বৈঠকের ফলাফল তুলে ধরেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠন প্রসঙ্গে তিনি যে অবস্থানের কথা ইন্দিরাকে জানিয়েছেন, তাও উল্লেখ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নানকে খুঁজে বের করেন। তাদেরকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার বৈঠকের বিষয় অবহিত করেন এবং একটি সরকার গঠনের আশু প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতে সম্মতি দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন। দৈনিক জয়বাংলা বগুড়া জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গণের তথ্য সংবলিত বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ১৯৭১-এর এইদিনে ৮ম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বগুড়ার তরুণ মুক্তিফৌজের বীর সদস্যদের সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর পক্ষ হইতে ‘জয় বাংলা’ লাখো ছালাম জানাইতেছে। যে রকম বীরত্ব তাহারা প্রদর্শন করিয়াছেন এবং হানাদারদের যেভাবে উৎখাত করিয়াছেন তাহার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশি একটা পাওয়া যাইবে না। মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুসেনা অপরদিকে মামুলি বন্দুক-রাইফেলে সজ্জিত বগুড়ার বীর তরুণেরা চার পাঁচ দিন বাহিরের কোনরূপ সাহায্য ছাড়াই অবিরাম লড়াইয়ের পর বহিরাগত হানাদারদেরকে পশ্চাৎপসরণ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। এপিপির বরাতে দৈনিক পাকিস্তান পাকিস্তান জানায়, গতকাল ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখ-তা বানচালের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ করে। পাকিস্তান সরকার এটাকে দুঃখজনক মনে করে যে, ভারত জাতিসংঘ সনদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা সত্ত্বেও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি লঙ্ঘন করে জাতিসংঘের অন্যতম ভিত্তিই ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তনী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের কাছে এক মৌখিক বার্তায় একথা জানান। প্রাক্তন পাক কূটনীতিক কেএম সাহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন আমরা বাংলাদেশের অনুগত। বাংলাদেশের জনসাধারণ ইসলামাবাদ সরকারকে বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসকচক্র হিসেবেই গণ্য করেন। পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এই দুই পাকিস্তানী কূটনীতিক গতকাল ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসলামাবাসের শাসকদের বর্বরতার নজির ইতিহাসে নেই। নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর ব্যাপক হত্যালীলা কতদূর চালানো হয়েছে বিশ্বের জনমত তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তারা বলেন, ইসলামাবাদের ফ্যাসিবাদী সামরিক একনায়কত্বের সঙ্গে আমরা সম্পর্কোচ্ছেদ করেছি। আমাদের বিবেকের নির্দেশে ইসলামাবাদের চাকরি আমরা ত্যাগ করলাম। বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা দখলদার বাহিনী ছাড়া কিছুই নয়। এখন থেকে আমরা বাংলাদেশের কাছেই আমাদের আনুগত্য জানাচ্ছি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সুস্পষ্ট নির্দেশেই বাংলাদেশ সার্বভৌম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। আমরা পৃথিবীর সব সভ্য মানুষের কাছে সহানুভূতি ও সুনির্দিষ্ট সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। পৃথিবীর সব দেশকেই আমরা আবেদন করছি- সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×