ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্প, মেডিক্যাল, প্রাণিজ এবং অন্যান্য বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ;###;বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের বিরূপ প্রভাব জীববৈচিত্র্যের ওপর ;###;দেশে বছরে মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশই পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখে

দূষণ উদ্বেগজনক

প্রকাশিত: ১০:০৮, ৮ এপ্রিল ২০১৯

দূষণ উদ্বেগজনক

নিখিল মানখিন ॥ বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখে। সারাবিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর হার ১৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশ দূষিত হওয়ার এই মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য, প্রাণিজ এবং অন্যান্য বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ যেন আজ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাবও পরিবেশের ওপর পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ হয়ে থাকে। বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়। গত এক যুগে দূষণ ও পরিবেশের বিচারে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবেশ ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অব্যাহত থাকে জীবনচক্র। তবে মানুষের জীবনচক্রে গৃহপালিত প্রাণীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আবার প্রাণীদেরও বেঁচে থাকতে নির্ভর করতে হয় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। পরিবেশের বিপর্যয় মানে জীবনের বিপর্যয়। প্রাণিস্বাস্থ্য, প্রাণী উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তঃসম্পর্কিত জটিল প্রক্রিয়া, যার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে রোগের প্রাদুর্ভাব, উৎপাদন ব্যবস্থাসহ আরও অনেক কিছু। বৈরী জলবায়ুর করাল গ্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশও। এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশ দূষণ। দূষণের দোষে দূষিত হয়ে উঠছে চারপাশ। শিল্প বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য, প্রাণিজ এবং অন্যান্য বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গৃহপালিত প্রাণী। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে চারণভূমির অভাবে প্রাণী খাদ্যের অভাব হচ্ছে। তাপজনিত, ব্যাক্টেরিয়াজনিত এবং সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। অতিবৃষ্টি, উচ্চতাপমাত্রা এবং খরার ফলে মানুষের অজান্তেই সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক শক্তিশালী ভাইরাস। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, ভেক্টর প্রভাবিত এবং খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা রোগ হয়ে থাকে। নদীর এক কূল ভেঙ্গে গড়ে উঠছে আরেক কূল। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন পরিবেশ, যা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবার, পানি আর বায়ু ছাড়া জীবজগতের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। যদিও খাবার বা পানি ছাড়া আমরা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু বায়ু ছাড়া দিন, ঘণ্টা দূরে থাক; আমরা সর্বোচ্চ তিন মিনিট পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারি। ফলে নির্মল বায়ুসেবন প্রতিমুহূর্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ আমাদের চারপাশের পরিবেশের এই বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ু দূষণ। যার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রভাবশালী চিকিৎসা জার্নাল ল্যানসেট জুন, ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদন বলেছে, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ মানুষ বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা ও ৩০ শতাংশ মানুষ জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট দূষণের শিকার। যা একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে যাচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশের যেমন দ্রুত অবনতি হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এ অবনতি হয়েছে আরও দ্রুত। বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাস হয়েছে। কিন্তু জনবিস্ফোরণ, বনাঞ্চলের অভাব ও ঘাটতি এবং শিল্প ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবের দরুন দেশের পরিবেশ এক জটিল অবস্থার দিকে পৌঁছতে যাচ্ছে। বায়ু দূষণ বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বায়ু সেবন করে। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ নামক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের ক্রমমাত্রায় আমাদের ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এ প্রতিবেদন বলছে, গত ২৫ বছরে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে যদিও চীন এ তালিকায় আগে প্রথম অবস্থানে ছিল। আমাদের দেশ বায়ুদূষণের বড় কারণ হচ্ছে, যাচ্ছেতাইভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা। কলকারখানার কালো ধোঁয়া, নগরায়নের কাজ সময়মতো শেষ না হওয়া এবং যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এমন উন্নয়ন কাজ পরিচালনার কারণে বাতাস ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ পিএম ২.৫ এর মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পিএম ২.৫ হচ্ছে এমন এক ধরনের কঠিন বা জলীয় অতি সূক্ষ্মকণা যা আড়াই মাইক্রোন বা তার নিচে চওড়া। এর কণা এতই সূক্ষ্ম যে খুব সহজেই প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে হার্ট হয়ে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যা শ্বাসতন্ত্রের নানাবিধ রোগ যেমন হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি পড়া থেকে শুরু করে এমন ছোটখাটো অসুখ, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসসহ হার্ট এ্যাটাক এবং ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. এ আতিক রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে মানুষের তৎক্ষণাৎ বা দ্রুত মৃত্যু হয় না। এটা একধরনের নীরব ঘাতকের মতো। এর কারণে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণই হচ্ছে এই বায়ুদূষণ। আমাদের দেশে পরিবেশ আইন আছে। সরকারের উচিত হবে, শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই আইন মেনে চলতে বাধ্য করা। আর দূষণ কমানোর জন্য নানামুখী ব্যবস্থা তো নিতেই হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। আর ট্রাফিক জ্যামের কথা আগেও বলেছি। এর কারণে যেমন আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি স্বাস্থ্যগত ক্ষতিও হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এ কারণে আমাদের এই জ্যাম কমাতে হবে। এসব পদক্ষেপ নেয়া হলে আমরা বায়ুদূষণের মারাত্মক প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকতে পারব, যদি পুরোপুরি সম্ভব নাও হয়। শব্দ দূষণ ॥ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তারিখসহ একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি জানান, শ্রবণ-শক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা ও রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা, সামাজিক কর্মকান্ড থেকে পরিহার বা প্রত্যাহার, সামাজিক প্রত্যাখ্যান ও একাকিত্ব, সতর্কতা হ্রাস ও ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার মতো ক্ষমতা হ্রাস; কর্মক্ষমতা ও উপার্জন শক্তি হ্রাস এবং মানসিক ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য খর্ব হয়ে থাকে। শব্দ দূষণের ফলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা ঘটতে পারে। সরকারের পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী দূষণের মাত্রা বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি দূষণ রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দূষণ বাড়ছে। যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ছে শহরগুলোতে। উন্নয়ন কর্মকান্ড বাড়ছে এবং গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে গেছে। তবে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। ট্যানারি কারখানাগুলো ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ইটভাঁটির বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি। শুধু সরকারী পদক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় মানুষের সচেতনতাও প্রয়োজন বলে জানান অতিরিক্ত মহাপরিচালক।
×