ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের কোন বীমা নেই

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ৫ এপ্রিল ২০১৯

অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের কোন বীমা নেই

রহিম শেখ ॥ দেশে শিল্প-কারখানা ও আমদানি-রফতানি পণ্যের বীমা করা থাকলেও বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের কোন বীমা নেই। ভবন নির্মাণের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকের শর্ত মোতাবেক অগ্নিবীমা করেন ভবন মালিকরা। এরপর ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের পর বীমা নবায়ন করেন না তারা। অথচ গত ১০ বছরে দেশে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ৭৩ হাজারের মতো। অর্থাৎ, বছরে গড়ে ১৭ হাজার ৩৮৭টি করে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। এসব অগ্নিকা-ে গড়ে বছরে ১২২ জনের প্রাণহানি ছাড়াও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। জানা যায়, স্বেচ্ছায় কোন ব্যক্তি কোন সম্পদের অগ্নি বীমা করেন না। অগ্নি বীমার অধিকাংশ পলিসিই গ্রাহকরা করে থাকেন বাধ্য হয়ে। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা অনুসারে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কোন শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ভবন নির্মাণ করা হলে এসব সম্পত্তির অগ্নি বীমা করা হয়ে থাকে। ফলে অগ্নি বীমার অধিকাংশ গ্রাহক তার অগ্নি বীমা পলিসি সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। এসব সম্পত্তির অগ্নি বীমার ক্ষেত্রে ব্যাংক যেহেতু নিজেও একটি পক্ষ সে কারণে ঋণ গ্রহীতা এসব বীমা গ্রাহক পলিসি করতে ব্যাংকের ওপরই নির্ভর করে থাকে। অনেক সময় ঋণ গ্রহীতা ওই বীমা গ্রাহক জানেন না কোন কোম্পানিতে পলিসি করা হয়েছে। সে কোম্পানির দাবি পরিশোধের সক্ষমতা বা গ্রাহক সেবার মান কেমন। এসব না জানার কারণে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অধিকাংশ গ্রাহককে হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। অনেক সময় সঠিকভাবে পলিসি না করার কারণে তারা বীমা দাবিও পান না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীমা কোম্পানিগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন মালিকরা বীমা করতে চান না। তবে শিল্পকারখানাগুলো বীমা করে। তিনি বলেন, এসব ভবনকে অগ্নিবীমার আওতায় আনতে সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বা সিটি করপোরেশনের কর পরিশোধের ক্ষেত্রে অগ্নিবীমা থাকা বাধ্যতামূলক করলেই এটি সম্ভব। ফায়ার সার্ভিসের একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা দেখা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে মোট অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৭৫। অর্থাৎ, বছরে গড়ে ১৭ হাজার ৩৮৭ করে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। এসব অগ্নিকা-ে গড়ে বছরে ১২২ জনের প্রাণহানি ছাড়াও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১০ বছরে দেশে অগ্নিকা-ের ঘটনা প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে। ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩১০ আগুনের ঘটনায় প্রাণ গেছে ২২৯ জন, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৩০ কোটি টাকার। ২০০৯ সালে দেশে ১২ হাজার ১৮২ অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১২০ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের দুজন সদস্যও রয়েছেন। ওই বছর আগুনে আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৩০৬ কোটি টাকা। পরের বছর অগ্নিকা-ের ঘটনা আরও বেড়ে হয় ১৪ হাজার ৬৮২। তাতে ২৭১ জনের প্রাণহানি ছাড়াও ৩২৬ কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায়। ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫ অগ্নিকা-ের ঘটনায় ২৯৩ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে প্রাণ যায় ৩৬৫ জনের। পরের বছর ২১০ জন নিহত হয় অগ্নিকা-ের ১৭ হাজার ৫০৪ ঘটনায়। ওই বছর মোট আর্থিক ক্ষতি হয় ৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ১৭ হাজার ৯১২ অগ্নিকা-ে নিহত হয় ১৬১ জন। ২০১৪ সাল থেকে অগ্নিকা-ে নিহতের সংখ্যা কমে আসে। ওই বছর ১৭ হাজার ৮৩০টি ঘটনায় ৭০ জনের প্রাণহানি ও ৩৫৯ কোটি টাকার সম্পদহানি ঘটে। পরের বছর ১৭ হাজার ৪৮৮ অগ্নিকা-ে নিহত হয় ৬৮ জন। ২০১৬ সালে ৫২ জনের প্রাণ যায় ১৬ হাজার ৮৫৮ ঘটনায়। তাতে আর্থিক ক্ষতি হয় ২৪০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫ অগ্নিকা-ে ৪৫ জনের প্রাণহানির সঙ্গে সম্পদ পুড়ে ২৫৭ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ১৬২ অগ্নিকা-ে ৫৫ জনের প্রাণহানির সঙ্গে সম্পদ পুড়ে ২১৭ কোটি টাকার। জানা গেছে, দেশে ব্যবসারত নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে যেসব বীমা পলিসি ইস্যু করা হয় এর অধিকাংশই মোটর বীমা। অন্যান্য বীমার বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় শুধু বাধ্যতামূলক হওয়ায় এই পলিসি গ্রহণ করছেন গ্রাহকরা। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নন-লাইফে প্রায় ২০ লাখ পলিসি ইস্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ লাখই মোটর বীমা। রাস্তায় মামলা ও জরিমানা থেকে পরিত্রাণ পেতে এই মোটর বীমা পলিসি গ্রহণ করেন তারা। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে শুরু করে অনেক ভবন এখনও বীমার আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নন-লাইফ ২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে বীমা পলিসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯২ হাজার ৪১৫। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিসি রয়েছে মোটর বীমার, ১৪ লাখ ২ হাজার ৪৫৭। অর্থাৎ ৭০ শতাংশ পলিসিই মোটর বীমার। তবে প্রিমিয়াম সংগ্রহের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে অগ্নি বীমা পলিসি। ৪৯ শতাংশ প্রিমিয়াম এসেছে অগ্নি বীমায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্নি, নৌ কার্গো, নৌ হাল, মোটর ও বিবিধ বীমার ১৯ লাখ ৯২ হাজার ৪১৫ পলিসি বিক্রি হয়েছে। এসব পলিসির বিপরীতে ৩ হাজার ৪শ কোটি ২৬ লাখ টাকা প্রিমিয়াম এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিসি বিক্রি হয়েছে মোটর বীমার, ১৪ লাখ ২ হাজার ৪৫৭। এ খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ২৯৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ নন-লাইফ বীমা খাতের ৭০ শতাংশ পলিসি এবং ৯ শতাংশ প্রিমিয়াম এসেছে এই মোটর বীমায়। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে অগ্নি বীমায়। গত বছর ২ লাখ ৩ হাজার ৫৫৫টি অগ্নি বীমা পলিসির বিপরীতে ১ হাজার ৬৭১ কোটি ২১ লাখ টাকা প্রিমিয়াম এসেছে। অর্থাৎ নন-লাইফের ৪৯ শতাংশ প্রিমিয়াম এসেছে অগ্নি বীমায়, সংখ্যার দিক দিয়ে মোট পলিসির ১০ শতাংশ। এছাড়া নৌ কার্গো বীমায় ৩ লাখ ৫ হাজার ৪৯৮ পলিসি বিক্রি হয়েছে। যা মোট পলিসির ১৫ শতাংশ। এ খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ৬৯ কোটি ১১ লাখ টাকা, যা খাতটির গ্রস প্রিমিয়ামের ৩১ শতাংশ। আর নৌ হাল বীমা খাতে ২ হাজার ৬৮০ পলিসির বিপরীতে ৪৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা প্রিমিয়াম এসেছে। যা মোট পলিসির দশমিক ১৩ শতাংশ এবং গ্রস প্রিমিয়ামের ১ শতাংশ। নন লাইফে বিবিধ বীমা খাতে সর্বমোট ৭৮ হাজার ২২৫ পলিসি বিক্রি হয়েছে, যা মোট পলিসির ৪ শতাংশ। খাতটিতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ৩১৮ কোটি ২ লাখ টাকা, যা গ্রস প্রিমিয়ামের ৯ শতাংশ। সাধারণ বীমা করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো মোট প্রিমিয়াম পায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্নিবীমা থেকে প্রিমিয়াম পায় ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। গত বছর ২ হাজার ৭১ কোটি টাকার অগ্নিবীমা দাবির মধ্যে ৬৮২ কোটি টাকার বীমাদাবি নিষ্পত্তি হয়েছে। অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার দাবি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বেসরকারী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে মোটর বীমা পলিসি বাড়লেও প্রিমিয়াম বাড়ছে না। কারণ রাস্তায় চলতে মোটর বীমা বাধ্যতামূলক তাই এই বীমা নিচ্ছেন গ্রাহকরা। সরকার যদি অগ্নি বীমাসহ আরও কিছু পলিসি বাধ্যতামূলক করে তাহলে বীমা ব্যবসার পরিধি বাড়বে, মানুষের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
×