ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক অপু

কাজাখস্তান ॥ পদত্যাগ করেও হাতে ক্ষমতার সুতা

প্রকাশিত: ১২:২৩, ৩ এপ্রিল ২০১৯

কাজাখস্তান ॥ পদত্যাগ করেও হাতে ক্ষমতার সুতা

কোন লৌহমানব যদি ত্রিশ বছর ক্ষমতায় থাকেন তখন যুক্তিসঙ্গতভাবেই ধরে নেয়া হয় যে একমাত্র সামরিক অভ্যুত্থান অথবা মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তবে কাজাখস্তানে ১৯৮৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নূর সুলতান নজরবায়েভ তৃতীয় একটি পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। গত ১৯ মার্চ তিনি বেতার-টিভিতে মধ্য এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ এই দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটা যুগের অবসান হলো। সেটা শুধু কাজাখস্তানের নয় বরং এই অঞ্চলের ৭৮ বছর বয়স্ক নজরবায়েভ ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া সোভিয়েত যুগের শেষ নেতা। সাবেক এই ইস্পাত শ্রমিক যখন ক্ষমতায় আসেন কাজাখস্তান তখনও ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। তাঁর নেতৃত্বেই দেশটি ১৯১১ সালে স্বাধীন হয়। তখন থেকেই তিনি দেশ পরিচালনা করে এসেছেন। নজরবায়েভ শেষ অবধি শোম্যান হিসেবেই থেকে গেছেন। তিনি সরাসরি সম্প্রচারিত টিভিতে পদত্যাগ পত্রে সই দেন। ২০ মার্চ সিনেটের চেয়ারম্যান ৬৫ বছর বয়স্ক কাশিম-ঝোমার্ট তোকায়েভ সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নজরবায়েভের মেয়াদের বাকি সময়টুকুর জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি নজরবায়েভের সম্মানার্থে তার প্রতিষ্ঠিত রাজধানী আস্তানার নতুন নামকরণ করেন নূর সুলতান। আর দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম নগরী স্কাইমকেন্টের প্রধান সড়কের নতুন নাম রাখা হয় নজরবায়েভ। দীর্ঘদিন ধরেই গুজব চলছিল যে নজরবায়েভ পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন যদিও তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালই ছিল। তাই তার পদত্যাগের ঘোষণায় কোন গুঞ্জন ওঠেনি। কাজাখস্তানের ১ কোটি ৮০ লাখ নাগরিকের পুরো অর্ধেক নজরবায়েভ ছাড়া অন্য আর কোন নেতার কথা জানত না। নজর বায়েভ পদত্যাগের ঘোষণায় বলেন, নতুন প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার সময় এসেছে। তবে তার পদত্যাগকে সম্মানজনক বিদায়ের চেয়ে একটা কূটকৌশলের মহড়া বলা যেতে পারে যার বদৌলতে তিনি নতুন নেতার ক্ষমতায় উত্তরণকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবেন। ঠিক যেমন এতগুলো বছর কাজাখস্তানের রাজনীতির প্রতিটি দিক তিনি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। তা ছাড়া নজরবায়েভের এক বিশেষ আইনগত মর্যাদা আছে যার বদৌলতে তাকে অবসর পরবর্তী অধ্যায় যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার আনুষ্ঠানিক পদবি হলো জাতির নেতা। এই পদাধিকারবলে তিনি এখনও নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করবেন। এর ফলে তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ করার অধিকারও তার থাকবে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যেসব কাজ করেছেন তার জন্য তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের মামলা করা যাবে না। তার ও পরিবারের সম্পদ বাজেয়াফত করা যাবে না। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা দারিগা নজরবায়েভা সিনেটের চেয়ারম্যান হিসেবে তোকায়েভের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ফলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সারিতে তিনিই পরবর্তী ব্যক্তি। কাজাখস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করে নজরবায়েভ আক্ষরিক অর্থে দেশটিকে মানচিত্রে স্থান দিয়েছেন। সে কথাটা তিনি পদত্যাগপত্রে উল্লেখও করেছেন। বিশাল ও শক্তিমান দুই প্রতিযোগী রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে এবং আমেরিকার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখে তিনি মানচিত্র রক্ষাও করেছেন। দেশের এক শ’রও বেশি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে সম্প্রীতির মধ্যে রেখেছেন। দেশকে সোভিয়েত উত্তর যুগের অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে বের করে এনে পেট্রোডলারভিত্তিক সমৃদ্ধিও এনে দিয়েছেন। তবে নজরবায়েভ বলেননি দেশের সমৃদ্ধিতে জনগণ যতটা না লাভবান হয়েছে তার চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে তার আনুকূল্যপ্রাপ্ত উচ্ছিষ্টভোগীরা। সে দেশে গণতন্ত্রের নামে যা আছে তা এক প্রহসনমাত্র। ভোটে কারচুপি, সমালোচকদের জেলে পোড়া, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এগুলো তিন দশক ধরে চলছে। বিরোধী দলকে অস্তিত্ববিহীন করা হয়েছে। দেশটিতে আগামী বছরের শেষদিকে নির্বাচন হওয়ার কথা, তার আগেও হতে পারে। নজরবায়েভ তার পছন্দের কোন প্রার্থীর নাম বলেননি। তাই বলে যে তার মনের মধ্যে নেই তা নয়। সেটা তোকায়েভ হতে পারেন কিংবা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত তরুণ লেফটেন্যান্ট আসকার মামিনও হতে পারেন। যিনিই হোন সুতা থাকবে নজরবায়েভের হাতে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×