ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুশান্ত মজুমদার

কেশব গুপ্ত ॥ অনেক ভিড়ের থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ১১:০৯, ৩ এপ্রিল ২০১৯

কেশব গুপ্ত ॥ অনেক ভিড়ের থেকে ফিরে

একত্রিশ মার্চ ২০১৯ রবিবার, মৌসুমের প্রথম ঝড়ে বিদ্যুত চলে যাওয়া গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কেশব গুপ্তর লৌকিক জীবনাবসানের আকস্মিক খবর এলো। এ-দিন সকালে রাজধানী থেকে অনেক দূর গ্রামীণ আবহাওয়ায় তাঁর নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তিনি চোখের ঢাকনা চিরক্ষণের জন্য টেনে নেন। দৈনিক সংবাদের চিফ রিপোর্টার সালাম জুবায়ের অন্য একজনের ফেসবুক থেকে মৃত্যুর সংবাদ সংগ্রহ করে আমাকে ফোনে জানান। অনেক দিন হলো, ঢাকা শহর ছেড়ে অনেক ভিড়ের থেকে ফিরে দূর মফস্বলে নোয়াখালীর বাদুরিয়ায় তিনি স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। রাজধানী যাঁরা কেশব গুপ্তর কর্মপ্রবাহ ও জীবন যাপন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন, তাঁরা কেউই আজ আর বেঁচে নেই। কেশব গুপ্ত কবিসাহিত্যিক ছিলেন না অথচ কবি-সাহিত্যিকদের অনিবার্য বন্ধু ছিলেন। তিনি ছিলেন অধ্যবসায়ী পাঠক। কবিদের সংগঠন ‘পদাবলী’র কবিতা অনুষ্ঠানের সফল আয়োজকদের একজন। পদাবলীর প্রতিটি ব্রুশিয়ারে কেশব গুপ্তের নাম আছে। প্রতিষ্ঠিত নাট্য সংগঠনের নাটক মঞ্চায়নেও তিনি যথাসাধ্য নেপথ্যে কাজ করেছেন। দেশের সাহিত্য সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিকী ‘সচিত্র সন্ধানী’র তিনি ছিলেন কর্মাধ্যক্ষ। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন সক্রিয় সংস্কৃতিসেবী। সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদক ও সন্ধানী প্রকাশনী স্বত্বাধিকারী গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ কেশব গুপ্ত পত্রিকার বিষয় নির্বাচন ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশে তাঁর সুবিবেচনা পেশ করতেন। এ-জন্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও কবি বেলাল চৌধুরীর মনের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। কবি শামসুর রাহমান, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর গভীর সখ্য। কাইয়ুম চৌধুরীর কল্যাণে কেশব গুপ্ত বরেণ্য শিল্পীদের প্রয়োজনে বরাবর সাড়া দিয়েছেন। মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা, আচরণের কারণে পল্টনের ফুটপাথ থেকে কথাকলি প্রিন্টার্সের কর্মজীবীর, এমনকি ব্যাংকের সাধারণজনের প্রিয় দাদা হয়ে ওঠেন তিনি। এজিবির সামনের রাস্তার ভেতরে গাছপালা ভর্তি পুরনো যে বাসায় চিরকুমার, নিঃসঙ্গ কেশব গুপ্ত থাকতেন তার আশপাশের টং দোকানি থেকে রাস্তার ওপাশের ভাসমান বাজারের মাছ-তরকারি বিক্রেতা পর্যন্ত ছিল তাঁর গুণমুগ্ধ। কখনো কোন মানুষের সঙ্গে তাঁর সামান্য মনোমালিন্য হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। স্বল্পভাষী, মৃদু কণ্ঠের কেশব গুপ্ত নীরবে কাজ করতে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে জটিল হিসাবের বিষয়, বিভিন্ন মুদ্রণের কাজে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। দিনের বাকি সময় কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফুরিয়ে দিতেন। পুরনো দিনের বহু স্মৃতির সাক্ষী এই মানুষটি নিজের স্মরণ থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক ঘটনা বলতে পারতেন। তাঁর রসবোধ ও আড্ডাপ্রিয়তার জন্য তরুণ থেকে বয়সী সাংবাদিক তাঁর সঙ্গ নিতে ছিলেন আগ্রহী। পানাহারে কখনোই তাঁর কার্পণ্য ছিল না। কেশব গুপ্ত ছিলেন নোয়াখালীর অবস্থাপন্ন বাদুরিয়া মজুমদার বাড়ির কামিনী দত্তগুপ্তের পুত্র। নিজ নামের শেষে পদবি ব্যবহারে দত্ত তিনি রাখতেন না। কেন রাখতেন না তিনি নিজে কখনো বলেননি। পারতপক্ষে কেশব গুপ্ত নিজের সম্পর্কে বলাবলি আদৌ পছন্দ করতেন না। তাঁর বাড়ির এলাকার বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য জায়গা দান করেছেন এ’কথা তাঁর কাছের বহুজনও জানতেন না। কাকরাইলের পাইওনিয়র রোডের জংধরা পাতলা লোহার রেলিং দেয়া নড়বড়ে অতি পুরনো কাঠের সিঁড়ি ধরে উপরে দোতলার ছোট দু’রুমে কেশব গুপ্ত থাকতেন সেখান থেকে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে ঘাড়ে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যেতেন। উপলক্ষ, গ্রামের বাড়ি গিয়ে কোন গাছ বা জায়গা বিক্রি করা। এই টাকায় তিনি শুধু নিজের জীবন যাপন নয়, আত্মীয়-স্বজন থেকে ঢাকার প্রতিবেশী হতদরিদ্র শিশু-কিশোরদের লেখাপড়ার জন্য তিনি দু’হাতে ব্যয় করতেন। ফেরত পাওয়ার কোন প্রত্যাশা তাঁর ছিল না। কেশব গুপ্ত যে বাসার দোতলায় থাকতেন তার নিচতলায় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। হালকাপাতলা, ক্লিন শেভ্ড, পাজামা ও ফুল শার্ট পরা মানুষটি বিছানায় চুপচাপ টানটান শুয়ে আছেন। তাঁর দুই ভাইপো সজল ও পরিমল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রÑ বাম রাজনীতির কর্মী। এঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে আমি পাইওনিয়রের বাসায় গিয়ে দুপুরের আহার করেছি। আমার নিজের তখন ঘাস-ফড়িংয়ের মতো এখানে-সেখানে দিনযাপন। পরে সচিত্র সন্ধানীতে কর্মসূত্রে কেশব গুপ্তর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। উপলব্ধি করেছি, সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের পারিবারিক নিজস্ব মানুষ হয়ে উঠেছিলেন কেশব গুপ্ত। ভাই-বোন সবার তিনি দাদা। কম্পোজিটর-ফোরম্যান-পেস্টার-পিয়নের দাদা হওয়ায় তাঁকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও এঁদের বিবিধ সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দিতে হতো। ধর্ম-বর্ণের কোন ভেদাভেদ তাঁর কাছে ছিল না। একটি প্রাচীন বংশে জন্ম নেয়া কেশব গুপ্ত ক্ষত্রিয় হয়েও উচ্চবর্ণের গৌরব কখনো ধারণ, চিন্তা-চেতনায় তা লালনও করেননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেশব গুপ্ত বড় একা হয়ে পড়ে ছিলেন। রুমে তাঁর সঙ্গে বাস করতো একগাদা বিড়াল। এই বিড়ালদের খাওয়াতে মাছ জোগাড়ে তাঁকে প্রায় প্রতিদিনই তৎপর থাকতে হতো। একে একে একই ধ্রুবের পথিক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকের মৃত্যু কেশব গুপ্তের মনের জোর হয়তো কমিয়ে দিয়েছে। বয়স ও উদ্বেগের কারণে একাধিক অসুখ তাঁর শরীর দখল করে। আত্মীয়-স্বজন, যে দুই ভাইপো এক সময় তাঁর সঙ্গে বসবাস করতো সবাই জীবন-জীবিকার টানে দূরে চলে গেলে কেশব গুপ্ত একা ঠা-া নুন-জর্জর পুরনো দেয়াল ঘেরা রুমে স্থির ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন। মৃত্যুর সময় কেশব গুপ্তর বয়স কত ছিল? বয়সের গাছপাথর তাঁর নেই। দাদাকে কখনও বয়স জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাঁর চেহারা-শারীরিক কাঠামো দিয়ে বয়স ধরা যেত না। দাদার অত্যন্ত নিকটজন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বেলাল চৌধুরী, গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদও তাঁর বয়স জানতেন না। বাংলাদেশের গ্রামজীবন ছেড়ে তাঁর ভাই-বোন ওপারে পশ্চিম বাংলার স্থায়ী বাসিন্দা হলে কেশব গুপ্তকে আমি একাধিকবার বলেছি- আপনি বয়সের শেষ দিনগুলোর জন্য ওদের কাছে চলে যান, এখানে আপনাকে কে দেখবে। কেশব গুপ্ত, আমাদের অন্তরতরেষু দাদা আমাকে বলেছেন- চারা গাছ এক জায়গা থেকে তুলে আরেক জায়গায় পুঁতে দিলে বাঁচবে। আমি বুড়ো গাছ। ওখানে গেলে আমার শেকড় কাজ করবে না। এখানেই জন্ম, এই মাটিতেই শেষ শ^াস রাখতে চাই। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×