ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

গাইবান্ধায় চৈতালি মেলা

কুম্ভকারদের খেলনা তৈরির ধুম

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ৩০ মার্চ ২০১৯

 কুম্ভকারদের খেলনা তৈরির ধুম

এখন চৈত্র মাস। গাইবান্ধার গ্রামীণ প্রকৃতিতে লেগেছে চৈতালি হাওয়ায় গরমের ছোঁয়া। সেইসঙ্গে গাইবান্ধার কুম্ভকারদের গ্রামগুলোতেও আসন্ন চৈতালি মেলাকে কেন্দ্র করে মাটির খেলনা তৈরির ধুম পড়েছে। কেননা গ্রামীণ এই মেলাগুলোতেই মাটির খেলনার সব চাইতে বেশি বিক্রয় হয়। তদুপরি চৈতালি এবং বৈশাখী মেলার চাহিদা মেটাতেও এখন থেকেই খেলনা তৈরি করে তারা মজুদ করে রাখছে। কেননা এই মৌসুম সময়ে এ থেকে যা আয় হবে তা দিয়েই তারা তাদের অভাবের সময়টার পরিবারের চাহিদা পূরণ করবে। কুম্ভকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত পৌষ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এ সমস্ত মাটির খেলনা এবং মাটির নানা ধরনের বাসনপত্র এবং শো-পিচ এর চাহিদা থাকে প্রচুর। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত মাটির জিনিসের চাহিদা থাকে খুবই কম। বাঙালীর নিজস্ব কৃষ্টি ও গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চারু, কারু ও মৃৎশিল্প। এই মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জীবন জীবিকাকে জড়িয়ে এখনও গাইবান্ধার বিভিন্ন অঞ্চলে বিরুদ্ধ পরিবেশেও নিজ পেশাকে আঁকড়ে টিকে আছে কতিপয় কুম্ভকার পরিবার। এখন মাটিসহ নানা জিনিসের খেলনা তৈরি করে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এসব মৃৎ শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। উল্লেখ্য, গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাদিয়াখালী ও খোলাহাটী ইউনিয়নের পালপাড়া, শিবপুর, কলাকোপা, ধুতিচোরা, ফুলছড়ির রসুলপুর, কঞ্চিপাড়া, ভাষারপাড়া, সাঘাটার ঝাড়াবর্ষা, পুটিমারী, সুন্দরগঞ্জের বেলকা, পাঁচপীর, ধুবনী, চ-িপুর, কঞ্চিবাড়ী, শ্রীপুর, ধর্মপুর, সাদুল্যাপুরের রসুলপুর, দামোদরপুর, পলাশবাড়ীর হিজলগাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর, আরজিশাহপুর ও শক্তিপুর এবং পলাশবাড়ীর হিজলগাড়ী গ্রাম এখনও এ জেলার মাটির খেলনার গ্রাম হিসেবে পরিচিত অর্জন করে আসছে। এসব গ্রামের সাড়ে ৭শ’ পরিবার এখনও মৃৎশিল্প ও নানা খেলনা তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা এখনও এই পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বিভিন্ন আকর্ষণীয় আকারে মাটি দিয়ে তৈরি এবং চারু ও কারু পণ্যের পাশাপাশি শোলা, বাঁশ, কাঠ, লোহা, বেত ও তালপাতার তৈরি নানা খেলনা তৈরিতে ইতোমধ্যে তারা দক্ষতা অর্জন করেছে। এছাড়াও তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে মাটির তৈরি বর্ণালী নানা খেলনা, পুতুল, শোলার তৈরি ফুল ও পশুপাখি, মাটি আর মৃত পশুর পেটের চামড়ায় তৈরি ঢোলগাড়ী, বাঁশের বাশি, তালপাতার ক্যাচ্ ক্যাচি পাখি, কাগজের বাহারী ফুল, লৌহ নির্মিত বিভিন্ন সামগ্রীসহ অনেক কিছু। মূলত বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ যে মেলাগুলো হয়ে থাকে সে সব মেলাতেই এসব খেলনা বেচাকেনা হয় সব চাইতে বেশি। সে কারণে তাদের পণ্যের বেচাকেনার ভরা মৌসুম হচ্ছে ফাল্গুন-জ্যৈষ্ঠ ৪ মাস এবং আশ্বিন, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ এই ৪ মাস। অন্য সময়ে এসব জিনিসের চাহিদা কম থাকে বলে এ সময় তারা পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত থাকে বেশি। গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাদিয়াখালী ইউনিয়নের পালপাড়ার ঢোলগাড়ী, তালপাতা ও শোলার ক্যাচ ক্যাচি পাখির কারিগর শৈলেশ চন্দ্র পাল ও মঞ্জুরানী পাল জানালেন, বর্ষা মৌসুমে বান-বন্যার সময়টিতে এসব জিনিস তৈরি করাও সম্ভব হয় না বলে মৌসুমে অনেক আগেই খেলনা বানিয়ে মজুত করে রাখতে হয়। কিন্তু দরিদ্র এই খেলনার কারিগররা অর্থাভাবে চাহিদা মোতাবেক পণ্য মজুত করে রাখতে পারে না বলেই তারা তাদের চিরায়ত অভাব থেকে মুক্ত হতে পারছে না। একই কারণে রং, শোলা, চামড়াসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে না পারায় তারা উন্নতমানের খেলনা তৈরি করতে পারছে না বলে সুন্দরগঞ্জে মৃৎশিল্পী মঙ্গল চন্দ্র পাল ও কৃষ্ণারানী পাল। পলাশবাড়ির মাটির খেলনার কারিগর মাধবী পাল, মনোরঞ্জন পাল, খেলনা তৈরি ও রং দেয়ায় তাদের উন্নত প্রযুক্তি এবং রং ব্যবহারের কৌশল বিষয়ে সরকারী উদ্যোগে প্রশিক্ষিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এতে তারা মাটি, শোলা, বাঁশ, বেত দিয়ে অনেক উন্নতমানের এবং আকর্ষণীয় খেলনা তৈরি করতে পারতেন। এতে যেমন গ্রামীণ এই আদি শিল্পকর্মটি এবং তাদের কারিগররা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে জীবন জীবিকায় টিকে থাকতে পারত। -আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা থেকে
×