ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদ রানা

রাজশাহীর বাগধানী পালপাড়া

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৯ মার্চ ২০১৯

 রাজশাহীর বাগধানী পালপাড়া

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী রাজশাহী দখল করে প্রথমে এলাকার আদিবাসী ও হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ করে বাড়িঘর লুটপাট এবং গণহত্যা চালায়। ২৯ এপ্রিল দুপুর বেলা পাকিস্তানী বাহিনী ৭টা জিপি করে বাগধানীতে পালপাড়াটির চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানী সেনাদের আসার খবর পেয়ে পালপাড়ার গ্রামবাসী যে যেখানে পারে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় ও পলাতক অবস্থায় বাড়ি, পুকুরঘাট, ইক্ষু ক্ষেত ও জঙ্গল থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা ১০ জনকে ধরে ফেলে। তারপর পাকিস্তানী সেনারা তাদের পালপাড়ার হাজী ইসমোতুল্লার পুকুরপাড়ে (স্থানীয় নাম হ্যাড়াগরুতলা) নিয়ে গিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে একটি ডোবা ছিল। পাকিস্তানী বাহিনী লাশগুলো ডোবায় ফেলে দেয়। ওইদিন গণহত্যায় শিকারের ১০ জনের মধ্যে ৫ জন ছিলেন পালপাড়ার বাসিন্দা, অবশিষ্ট ৫ জন ছিলেন হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা। আগস্ট মাসের দ্বিতীয়ার্ধে গভীর রাতে মুক্তিবাহিনী বাগধানী পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে ৫ জন পুলিশ ও ২জন পাকিস্তানী দালাল (বাদল ও বড়গাছীর ওবেদ হাজীর ভাই) মারা যায়। ১৬ নবেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বাগধানী ব্রিজ অপারেশন করে। এই দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানী সেনারা ১৭ নবেম্বর মুগরুল মদনহাটি, হাড়দহে গণহত্যা-নির্যাতনের চালিয়ে পশ্চিমদিক দিয়ে বাগধানী গ্রামে প্রবেশ করে। পাকিস্তানী সেনাদের আসার সংবাদ পাওয়া মাত্র গ্রামটির অধিকাংশ গ্রামবাসী পালিয়ে নদীর পাড়ে, জঙ্গলে এবং পাশের গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যারা পালাতে পারেনি পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরে বেঁধে ফেলে। সেই সময় পাশের নদী দিয়ে একটি নৌকায় কিছু মানুষ হাটে ধান বিক্রি করে যাচ্ছিল। পাকিস্তানী সেনারা নৌকাটিকে থামিয়ে নৌকার মাঝি ও যাত্রীদের ধরে বেঁধে ফেলে। তাছাড়া তানোরের দিক হতে ৩ জন ভিক্ষুক আসছিল তাদের পাকিস্তানী সেনারা ধরে। পাকিস্তানী সেনাদের একটি দল দুয়ারী ব্রিজের পূর্ব দিক দিয়ে বাগধানী গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের যাকে পেয়েছে তাকে বেঁধে ফেলে। পাকিস্তানী বাহিনী সবাইকে বাগধানী গ্রামের কড়ইতলা মোড় থেকে দক্ষিণপূর্ব বিলের মধ্যে নিয়ে জমির আইলের ওপর এক রশিতে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। সে স্থানে ইক্ষু ক্ষেত ছিল। একজন গুলি করার সময় গুলি বিদ্ধ অবস্থায় ইক্ষু ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে নদী সাঁতরে মদনহাটি গ্রামে সামাদের বাড়ি গিয়ে ওঠে। সেখানে তার চিকিৎসা করানো হলেও পরের দিন মারা যায়। পাকিস্তানী বাহিনী গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। তাদের মধ্যে একজন পাকিস্তানী বাহিনী নির্যাতন করে যাওয়ার পড়ে আত্মহত্যা করেন। বাগধানী গ্রামের লুৎফর রহমান শেখ গণহত্যা সম্পর্কে বলেন, ‘মিলিটারিরা প্রথমে সকালে নওহাটা হয়ে মদনহাটি, পালপাড়া গণহত্যা চালিয়ে নদীপাড় হয়ে সকাল ৯টার সময় আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকেই ১২/১৪ জনকে ধরে ফেলে। ’৭১ সালে আমাদের গ্রামের পাশের নদী দিয়ে নৌকা চলত। কিছু লোক ধান বিক্রি করে চৌবাড়িয়া ও তানোরের দিকে যাচ্ছিল। মিলিটারিরা নৌকা থামিয়ে তাদের ধরে নিয়ে বিলের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। এই গ্রামের সবাইকে মিলিটারিরা বাড়ি থেকে ধরে আনে।’ সেদিন পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে গ্রামে ১৭ জনকে হত্যা করে। ১৭ জনের ৮ জন ছিলেন স্থানীয়। পাকিস্তানী সেনারা চলে গেলে গ্রামবাসী তাদের পরিবারের সদস্যদের বাড়ি এনে মাটি দেয়। কিন্তু বহিরাগতদের নাম পরিচয় না পাওয়ায় তাদেরকে গ্রামবাসী মিলে একটি গর্ত করে মাটিচাঁপা দিয়ে রাখে। বাগধানী-পালপাড়া গণহত্যায় পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগিতা করেন আবুল কাশেম। তিনি ভিক্ষুমিয়া নামেও পরিচিত। পালপাড়া যেখানে গণহত্যায় শিকার শহীদের গণকবরের স্থানটিতে এখন পুকুর। যে পুকুরটির নাম তীরপুকুর। স্থানটি এখন সংরক্ষণ করা হয়নি। তাছাড়া বাগধানী গ্রামে যে স্থানে বহিরাগত শহীদের সমাধি করা হয়েছিল তাদের গণকবরটির বর্তমানে কোন চিহ্ন নেই। যদিও পবা উপজেলার শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নওহাটা কলেজ মোড়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত করা হয়েছে। এই গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত রয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট’ প্রকাশিত হোসনে আরা খানমের গবেষণাগ্রন্থ ‘বাগধানী পালপাড়া গণহত্যা নির্ঘণ্টগ্রন্থ’ মালায়। লেখক : কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কগবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×