ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দালাল চক্রের প্রতারণায় শত শত পরিবার

লিবিয়ায় আটকে থাকা বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

লিবিয়ায় আটকে থাকা বাংলাদেশী

নিজস্ব সংবাদদাতা, ভৈরব, ১৬ জানুয়ারি ॥ ইউরোপের দেশ ইতালিতে অবৈধভাবে প্রবেশের উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে ভৈরবসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার শতাধিক যুবক। তবে এভাবে অবৈধভাবে ইতালিতে পাড়ি জমাতে গিয়ে লিবিয়ায় বাংলাদেশী দালালচক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। সেখানে যুবকদের আটক রেখে অর্থের জন্য চালানো হয় নির্যাতন। ভৈরবে রয়েছে দালাল চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভৈরব থেকে শতাধিক যুবক লিবিয়ার বিভিন্ন শহরের অবস্থান করে। ওই যুবকদের কিছু সংখ্যক দালালদের মোটা অংকের টাকা দিতে নৌ পথে চোরাইভাবে ইতালি পৌঁছিয়ে দিলেও বেশিরভাগ যুবকই ইতালিতে প্রবেশের পথ মিলছে না। ইতালিতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে লিবিয়াতে আটকে থাকা যুবকদের জিম্মি করে বাংলাদেশে তাদের পরিবারে কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েক দফায় লাখ লাখ টাকা। দালালদের জিম্মিদশায় আটক থাকা ভৈরবের যুবকদের অনেকই টাকার বিনিময়ে মুক্তি পেয়ে লিবিয়া থেকে ফেরত আসছে দেশে। লিবিয়া থেকে ফেরত ও আটককৃত যুবকদের পরিবারের অভিযোগ, ভৈরবের কতিপয় দালালচক্র অল্প টাকায় ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় পাঠানোর পর ওই চক্রের সদস্যরা তাদের জিম্মি করে শারীরিক নির্যাতনসহ পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফা টাকা আদায় করে থাকে। এমন অভিযোগ লিবিয়ায় আটককৃত ও ফেরত আসা ভৈরবের ভুক্তভোগী পরিবারের। সম্প্রতি ভৈরব পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার আকাশ, জুম্মন, শুভ, বাদশা , শাওন, ছালমান, সারুফ, আছিফ ও পিয়ার হোসেনসহ কয়েকজন লিবিয়ায় বাংলাদেশী দালালচক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেশে ফেরত আসে। তারা জানায়, আমাদের লিবিয়ায় পাঠানোর পর লিবিয়ায় অবস্থাররত ভৈরবের দালাল আমাদের আটক করে রাখে। পরে আমাদের লোহার রড দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে রক্তাক্ত করার চিত্র পরিবারের কাছে পাঠায়। এমন দৃশ্য দেখে আমাদের পিতামাতা লিবিয়ার দালালদের কথামত বাংলাদেশী দালালদের হাতে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এসব অমানবিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে ভৈরবের বিভিন্ন গ্রামের বেশ কয়েকজন দালালের নাম পাওয়া গেছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগে। অভিযুক্ত দালালদের মধ্যে রয়েছে ভৈরব পৌর এলাকার জুুয়েল, খোকন, উজ্জ্বল ও পার্শ্ববর্তী বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার পিন্টু, সহিদ মিয়া, সিলেটের শাহাবুদ্দিন, চট্টগ্রামের মুসলিমসহ কয়েকজন। ওই চক্রটি বাংলাদেশ ও লিবিয়া অবস্থান করে ইতালি পাঠানোর নাম করে দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় অবস্থনরত যুবকদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করছে। দালালরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। লিবিয়ায় আটক উপজেলার গোছামারা গ্রামের দ্বিন ইসলাম, বায়াজীদ ও সারওয়ারের বাড়িতে সরেজমিন গেলে দ্বিন ইসলামের পিতা আজাহার মিয়া জানান, আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পিন্টু ও শাহাবুদ্দিন লিবিয়ানদের সঙ্গে মিলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলতে চাইলে জীবন বাঁচাতে আমাকে ফোন দেয় বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর জন্য। উজ্জ্বলকে ৩ হাজার দিনার দেয়ার কিছুদিন পর আবারও আটক করে তার ছেলেকে। ছেলেকে ছাড়াতে হলে পিন্টু ২০ হাজার দিনার দাবি করে। তার কথামত আমার ছেলেকে ছাড়াতে লিবিয়ায় ১০ হাজার দিনার ও দ্বিন ইসলামের মা আমেনা বেগম বাংলাদেশে পিন্টুর স্ত্রীর কাছে ১ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর ছাড়া পায়। বায়াজীদের বাবা আওয়াল মিয়া জানান, ভৈরবের তাঁতারকান্দির জুয়েলের মাধ্যমে আমার ছেলেকে ইতালির উদ্দেশ্যে দেড় বছর আগে লিবিয়া পাঠায়। লিবিয়া যাওয়ার পর বাংলাদেশী দালাল শাহাব উদ্দিন ও পিন্টু সাগরপথে ইতালি পাঠাবে বলে আমার ছেলেকে আটকিয়ে রেখে মারধর করে। এ পর্যন্ত তিনবার আমার ছেলেকে তারা আটকে রাখলে বাড়ি থেকে পিন্টুর বউকে ১ লাখসহ মোট ৭ লাখ টাকা তাদের দেয়া হয়। শেষবারের টাকা নিয়ে আমার ছেলেকে ইতালি না পাঠিয়ে পিন্টু সে নিজেই লিবিয়া থেকে ইতালি চলে যায়। আমি এখন দেনার দায়ে ভিটেমাটি ছাড়া। দেনার দায়ে আমার মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নাই। সারওয়ারের বড় ভাই দেলোয়ার জানান, পিন্টু আমার ছোটভাই সারওয়ারকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১ লাখ টাকা নেয়ার পর ওইখানে মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। আমার ভাইকে রুমে আটকে রেখে উল্টো ঝুলিয়ে রড দিয়ে নির্যাতন করা হয়। আমার ভাইকে বাঁচাতে ধারদেনা করে আরও ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠালে আমার ভাই ছাড়া পায়। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা যুবক শুভর মা পঞ্চবটি এলাকার ঝুমুর বেগম জানান, আমি বিধবা নারী চার সন্তান নিয়ে সেলাইর কাজ করে সংসার চালাই। আমার স্বামীর দেয়া স্বর্ণালঙ্কার বিক্রিসহ ধারদেনা করে দালাল জুয়েলের কথায় লিবিয়া পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়। সে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাতে লিবিয়ায় শহীদ নামে দালাল দেড় লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর কথা বললে আমি আমার একটু জায়গা বিক্রি করে শহীদের কথামত শহীদের বউ ও আরাফাত নামে একজনকে ভৈরব বাজারে গিয়ে দেড় লাখ টাকা দিয়ে আসি। পরে আমার ছেলেকে ইতালিতে পাঠানোর জন্য রাবারের বোটে তুলে ডাংকির সময় অতিরিক্ত বোঝাই করার কারণে বোটটি সাগরে ফেটে যায়। তখন কোস্টগার্ডের লোকজন এসে আমার ছেলেসহ সঙ্গের লোকদের উদ্ধার করে জেলে পাঠায়। কয়েক মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার ছেলে দেশে ফেরত আসে। এ ঘটনারয় আমার প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ হয়। আমি এখন আমার সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ভুক্তভোগী যুবক পিয়ার হোসেন জানান, পাসপোর্টের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা এবং লিবিয়া পৌঁছার পর ৪ লাখ টাকায় আমাকে ইতালি নেবে খোকনের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয়। আমাকে লিবিয়া পৌঁছানোর পর সম্পূর্ণ টাকা আমার পরিবারের লোকজন খোকনকে পরিশোধ করে দেয়। খোকন সমস্ত টাকা বুঝে পাওয়ার পরও লিবিয়ার দালালদের তাদের পাওনা টাকা না দেয়াায় সে খানকার দালাল রাসেল ও খোকনের সহযোগী মুসলিমসহ অজ্ঞাতনামা দালালরা আমাকে একটি নির্জন বাড়িতে আটকে রাখে। সেখানে আটকে রেখে আমাকে ৬ দিন নির্যাতন করা হয়। ৬ দিন পর খোকন লিবিয়ায় রাসেলকে টাকা দেয়ার পর আমাকে ছেড়ে দেয়। রাসেল আমাকে ছাড়লেও মোসলিম টাকাটা পেয়ে আমার পাসপোর্ট রেখে দেয়। পরে লিবিয়া প্রবাসী এক বাংলাদেশীর নিকট আশ্রয় নেই। সেখান থেকে খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারবার ফোন করলেও সে আমার কোন কল রিসিভ করেনি। খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রায় তিন মাস খেয়ে না খেয়ে ওইখানে অনেক কষ্টে দিনগুলো কাটাই। পরে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে একজন বাঙালীর সহযোগিতায় দালালদের কাছ থেকে ৭ হাজার টাকার বিনিমিয়ে আমার পাসপোর্ট ফিরে পাই। খোকন আমাকে ইতালি পাঠাবে তো দূরের কথা সে আমাকে লিবিয়ার বেনগাজী থেকে ত্রিপলিও পাঠায়নি। পরে আমি দেশে ফেরত আসি। ভৈরব (জগন্নাথপুর ও তাঁতারকান্দি) পৌর ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ ফজলু মিয়া বলেন, ভুক্তভোগী অনেকই আমাকে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। উজ্জ্বলসহ অনেকই জড়িত রয়েছে বলে শুনেছি। অভিযোগের ভিত্তিতে দরবার করে অনেকর আংশিক টাকাও উদ্ধার করে দিয়েছি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সত্যতার ভিত্তিতে অভিযুক্ত দালালদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করতে চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি। ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত সাদমীন বলেন, অবৈধ মানব পাচার অত্যন্ত ঘৃণিত একটি কাজ। আমি বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছি, যারা অবৈধ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।
×