ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ! ॥ আলী যাকের

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

 মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ! ॥ আলী যাকের

সদ্য স্বাধীন দেশে অনেক ব্যবসায়ী ভেবেছিলেন যে বিজ্ঞাপন ব্যবসা শুরু করে রাতারাতি ধনকুবের হওয়া যায়। সেজন্য তখনকার ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বিজ্ঞাপনের এজেন্সি দোকান খুলে বসেছিল। আমার সহকর্মীদের অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা হয়তো ভেবেছিলেন যে এই রকম একটি প্রতিযোগিতামূলক আবহে আমরা শেষমেশ টিকতে পারব কিনা। এর পেছনে আরও একটি বড় কারণ ছিল এই যে নব্য ধনীদের অনেকেই বিজ্ঞাপন ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন পর্ব-২৫ আবেগতাড়িত হয়ে আমার পুরনো কর্মস্থল এশিয়াটিকে তো ফিরে এলাম কিন্তু স্বীকার করতেই হয় যে সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনীতি এতই নাজুক ছিল যে এখানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া যে আদৌ শুরু হবে সে সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। অথচ আমরা সবাই জানি যে ব্যবসা এবং শিল্পায়ন উন্নতমানের না হলে বিজ্ঞাপনের কোন প্রয়োজন পড়ে না। অতএব, আমাদের অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে তখন। অধিকাংশ মাসে আমরা যারা উচ্চাসনে সমাসীন ছিলাম, কখনই পুরো বেতন নিতে পারিনি। প্রচ- পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই সময় আমার কাজ ছিল, বাজারজাতকরণ সম্বন্ধে নব্য ব্যবসায়ীদের শিক্ষিত করা। অনেক সময় গেছে এই কাজটির পেছনে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি একটি চলমান অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। পুরনো কারখানাগুলো ঠিকঠাক করে উৎপাদন শুরু করা হয়। দু’চারটে ভোগ্যপণ্যের শিল্প কারখানায় নিজস্ব পণ্য তৈরি শুরু হয়। আবার বাইরে থেকে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করে আনা হতো সেগুলোর বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াতে মনোযোগ দেন আমদানিকারকরা। খুবই মৃদু মন্দ গতিতে আমাদের ইস্ট এশিয়াটিকের ব্যবসা সামনের দিকে এগুতে থাকে। সেই সময়ের ব্যবসাবাণিজ্য সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য এখানে তুলে ধরা সঙ্গত হবে বলে আমি মনে করি। মনে আছে, তৎকালীন লিভারব্রাদার্সের মার্কেটিং ম্যানেজার আমাকে বলেছিলেন, ‘পণ্য বিক্রি করা আমাদের সমস্যা নয়। আমাদের মূল সমস্যা হলো ভোক্তার প্রয়োজনের পণ্যগুলো তার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। রাষ্ট্রের জন্য এখনকার প্রয়োজন হলো, বিধ্বস্ত রাস্তাঘাটগুলোকে পুনঃনির্মাণ করা এবং যানবাহন আমদানি করা।’ এই বক্তব্য থেকে বোঝা যাবে বাংলাদেশের ব্যবসার তখনকার অবস্থাটি কেমন ছিল। অর্থাৎ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছিল বিক্রেতার বাজারে। এখানে ক্রেতা সিদ্ধান্তের কোন স্থান ছিল না। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে আমার ইস্ট এশিয়াটিক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়ত ভুল হয়েছিল। সেই অস্থিরতার সময়ে আরও অনেক সহজ উপায় ছিল হয়তো একটি সচ্ছল জীবন গড়ে তোলার। কিন্তু আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পরে এসে আমি উপলব্ধি করি যে কোন বিষয় নিয়ে লড়ে যাওয়ার পেছনে যে আত্মশ্লাঘা আছে তার তুলনা হয় না। বিশেষ করে ওই পরিশ্রমের ফলে সাফল্য যদি আসে। কেবল ৮ জন সহকর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ এ আমার এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়াটিকের ওপরে ভর করে। আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৪টি প্রতিষ্ঠান। যাকে আমরা ’এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি’ বলে জানি। আমাদের নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা সাড়ে ৬০০ এর বেশি। আমি জানি যে নীতিগত দিক থেকে ব্যবসায়ের সাফল্যতে উচ্ছ্বসিত হওয়া হয়তো বালখিল্যতা কিন্তু ওই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সাফল্য অর্জনের যে মানসিকতা যার বাস্তবিক রূপ হচ্ছে লড়ে যাওয়ায় সেইটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মার্কিন মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’, যে বাক্য এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বপ্নটি আমাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দেয়। আমি কোনভাবেই আমার সাফল্যকে মহৎ হিসেবে বিবেচনা করি না। তবে এই সাফল্যের পেছনে যে একটি জেদ কাজ করেছিল, যুদ্ধ করার একটা মনোবৃত্তি, তা নিয়ে যথেষ্ট আত্মতৃপ্তি আমার আছে। আজ হয়তো নিঃশঙ্কোচে বলাই যায়, ‘আমার একটা জেদ ছিল।’ আমার সেই জেদ, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে মুখ ঘুরিয়ে না নেয়ার যে প্রবণতা সেটা এ পর্যন্ত কখনও আমাকে হতাশ করেনি। শুরুতে কষ্ট হলেও শেষমেশ আমি সাফল্য দেখেছি। এই প্রত্যয় নিয়ে জীবনের সাতটি দশক পার করে এলাম। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, ‘এবং পেছন ফিরে তাকাইনি কখনও’। এই বাক্যটির সত্যতা আমার জীবনে আমি প্রত্যক্ষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসে যখন এশিয়াটিকের কাজ শুরু করলাম আবার, তখন আমার একটা পরিকল্পনা ছিল। আমি চেয়েছিলাম যে বাংলাদেশে, বাজারজাতকরণের একটি মূল উপাদান - ‘ভোক্তার সঙ্গে যোগযোগ’ এই বিষয়ে একটি যথার্থ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে আমার সেই ইচ্ছে পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করেছে এশিয়াটিকের সাফল্যের মাধ্যমে। শুরুতে যেমন হয়ে থাকে, সদ্য স্বাধীন দেশে অনেক ব্যবসায়ী ভেবেছিলেন যে বিজ্ঞাপন ব্যবসা শুরু করে রাতারাতি ধনকুবের হওয়া যায়। সেজন্য তখনকার ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বিজ্ঞাপনের এজেন্সি দোকান খুলে বসেছিল। আমার সহকর্মীদের অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা হয়তো ভেবেছিলেন যে এই রকম একটি প্রতিযোগিতামূলক আবহে আমরা শেষমেশ টিকতে পারব কিনা। এর পেছনে আরও একটি বড় কারণ ছিল এই যে নব্য ধনীদের অনেকেই বিজ্ঞাপন ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তাদের পয়সার কোন কমতি ছিল না। এদিকে আমরা প্রত্যেকেই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে এই পেশাদার সেবামূলক ব্যবসাটিকে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে গেছি। আমার সবসময়ই এই রকম ধারণা ছিল যে যেহেতু আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে এই ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলাম এবং এই কাজের পেশাদারিত্ব সম্বন্ধে আপোসহীন ছিলাম সেহেতু আমরা সফল হবই। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে আমাদের একাগ্রতা, দূরদৃষ্টি এবং সততার কারণে এশিয়াটিক বাংলাদেশের বৃহত্তম বিজ্ঞাপন এজেন্সি। কেবল তাই নয় আমি আগেই বোধহয় উল্লেখ করেছি যে বিজ্ঞাপন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কাজসমূহ যেমন : মার্কেট রিসার্চ, মিডিয়া সংক্রান্ত কর্মকান্ড, জনসংযোগ, বিজ্ঞাপন নির্মাণ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এই সকল বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্ম আমরা দিয়েছি। ফলে আমরা যেমন বলে থাকি, ‘যে কোন যোগাযোগের প্রয়োজনে আমরা যথাযথ সেবা প্রদান করতে পারি।’ এই একটি অবস্থায় আমরা নিজেদের উন্নীত করতে পেরেছি।
×